লেখা যখন লিখছি, তখন যুথবদ্ধ হিংস্র আক্রমণে গত ৪ ঠা মে ঘটে যাওয়া মণিপুরের দুই নারীর চরমতম অসম্মান নিয়ে সারা ভারত ক্রুদ্ধ বিক্ষোভে প্রতিবাদে উত্তাল। ঘটনাটি আটাত্তর দিন পরে লোকসমক্ষে আসায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাংবাদিকদের ডেকে অপরাধীদের ধিক্কার জানিয়ে কঠোর শাস্তি দেওয়ার ঘোষণা করলেও সংসদের বাদল অধিবেশনে কোন বিবৃতি যেমন দেন নি তেমনি তাঁর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের দুই মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, স্মৃতি ইরানী তাঁদের দলের মুখপাত্র অমিত মালব‍্যের সুরে সুর মিলিয়ে ভারতের অন‍্যান‍্য রাজ‍্যে বিশেষতঃ রাজস্থান,ছত্তিশগড়,পশ্চিমবঙ্গের মত অ-বিজেপি শাসিত রাজ‍্যেও ভয়ংকর নারীনিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষত মালদার গাজোলে প্রকাশ‍্য হাটে চুরির অভিযোগ এনে দুই আদিবাসী মহিলাকে বেধড়ক মারধর করে জামাকাপড় খুলে নেওয়ার ভিডিও সংবাদ মাধ‍্যমে প্রকাশ হওয়ার পরে তাঁরা সুর চড়িয়েছেন। যদিও বিজেপি শাসিত মণিপুরের মুখ‍্যমন্ত্রী নংথমবাম বীরেন্দ্র সিং ঘটনার আটাত্তর দিন পরে অপরাধীদের ফাঁসি হওয়া উচিত বলে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন গত চার মাসে নাকি এমন নারী নিগ্রহের ঘটনা আরও ঘটেছে।

মালদা জেলার গাজোলের বামনগোলার পাকুয়াহাটে দুই সিভিক ভলান্টিয়ারের উপস্থিতিতে আদিবাসী নারী নিগ্রহের ঘটনা যেমন অসহ‍্য এবং ধিক্কারযোগ‍্য,তেমনই ধিক্কারযোগ‍্য তেমনই ঘৃণ‍্য আমাদের রাজ‍্যের নারী ও শিশু কল‍্যাণমন্ত্রী ডাঃ শশী পাঁজার বিবৃতি -” সব কিছু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা উচিত নয়।” অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের আইন শৃঙ্খলা যে ভেঙ্গে পড়েছে নাগরিকদের সেই সমালোচনা ” নিছকই রাজনৈতিক”। নির্লজ্জ শাসকের স্বেচ্ছাচারিতার ওপর এখন ন‍্যূনতম আবরণটুকুও নেই।

যেমন নরেন্দ্র মোদি সহ বিজেপি এখন মণিপুরের নারীনির্যাতনের ঘটনাটিকে পৃথকভাবে দেখিয়ে গত চারমাস ধরে মণিপুরের জাতি সংঘর্ষের ফলে উদ্ভূত উত্তাল পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। অথচ একটি ভুয়ো ভিডিও ক্লিপিং ছড়িয়ে পড়ার কারণে যে ভয়ংকর আক্রমণ ৪ ঠা ফেব্রুয়ারি কুকিদের ওপর সংগঠিত হল তার জেরে পুলিশি প্রহরা থেকে উদ্ধার করা নারী পুরুষদের ছিনিয়ে নিয়ে যায় প্রায় কয়েকহাজার উন্মত্ত জনতা যাদের হাতে ধর্ষিতা নারীদের পরিবারের দুজন পুরুষ নিহত হয়েছিলেন।

তপশিলী উপজাতির স্বীকৃতি নিয়ে হাইকোর্টের রায়কে কেন্দ্র করে কুকি ও মেইতেইদের মধ‍্যে প্রবল অশান্তি শুরু হয় চারমাস আগে।

ইম্ফল-উখরুল-থৌবাল-কাকচিং-নামবল শহরগুলোর পরিস্থিতি গত চারমাসে মৃত্যুপুরীর মত। দাঙ্গা সাধারণত চারটে বিষয়কে কেন্দ্র করে শুরু হয়ে থাকে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়। বিজেপির ব‍্যর্থতায় মণিপুরে এই চারটি বিষয়ই মিশে গিয়েছে অশান্তির ইন্ধন নিয়ে। ফেক ভিডিওতে ভয়ংকর সব ছবি ছড়ানো হচ্ছে, যা আতঙ্ক বাড়িয়ে দিচ্ছে সর্বত্র। তাই ইন্টারনেটে নিষেধাজ্ঞা।

মণিপুরে এখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বাইরে কিছু হচ্ছে না। মেইতেই বনাম কুকি-নাগাদের সংঘাত এখন হিন্দু খ্রীষ্টান সংঘাত। মেইতেইরা হিন্দু, কুকি-নাগারা খ্রিস্টান। শুরু হয়েছিল তপশিলি উপজাতি হওয়া নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইদের দাবি ঘিরে। কেন কুকিরা পাহাড়ে বাড়তি সুবিধে পাবে – নির্বাচনের সময় এই দাবি ঘিরে অশান্তি উসকানি দিয়ে বিজেপি বিধানসভা নির্বাচনে ফায়দা তোলার চেষ্টা করেছিল। সংঘর্ষের এখনকার পরিস্থিতিতে মায়ানমারের শরণার্থীরা কুকিদের পাশে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় উত্তেজনা বল্গাহীন। রাজ্য সরকারের হাতে নিয়ন্ত্রণ নেই।
হচ্ছে মূলত হিন্দু বনাম খ্রিস্টান গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে কয়েকশো চার্চ ভাঙা হয়েছে, মারা গিয়েছেন অজস্র কুকি বা নাগা, কেউ দিনের পর দিন ঘরছাড়া। মণিপুরের সমস‍্যা ঘোরালো হওয়ার পর আরএসএস সচিব দত্তাত্রেয় হোসবোলে এক বার্তায় বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় হিংসা এবং ঘৃণার কোনও স্থান নেই।’ ঘটনা হল, মোদি জমানায় এই প্রথম আরএসএস এই জাতীয় কোন বিবৃতি দিল কিন্তু তাতে কি লাভ?
৩ মের পরে ৪১ হাজার ৪২৫ জন মানুষ গৃহহীন। ১০১-এর বেশি মানুষ মৃত। ৬১৩৭ বাড়ি লুট হয়েছে বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ৩১৭-র বেশি চার্চ ধ্বংস। ১৭০-এর বেশি গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বাতাবরণে কোন হিংসাই এক তরফা থাকছে না। কুকিদের বিরুদ্ধে ও রয়েছে মন্দির ভাঙার অভিযোগ। তারা নাকি মায়নামারের শরণার্থীদের সাহায্য নিয়ে চেষ্টা করছে বিস্ফোরণের।

কিছুদিন আগে জিপের মধ্যে যেদিন দুই মহিলা এবং এক শিশুকে জ্বালিয়ে দেওয়া হল, সেদিন দেখা গেল মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং ও প্রাক্তন সেনা অফিসারদের পরস্পরবিরোধী বিবৃতি। মুখ‍্যমন্ত্রী যখন বারবার বলছেন উগ্রপন্থীরা আক্রমণ করছে স্থানীয়দের উপর। যেমন নয়াদিল্লি, মুম্বই বা কলকাতায় বলা হয়ে থাকে। কিন্তু দুই অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার বললেন, এখানে কোনও উগ্রপন্থী হামলা হচ্ছে না, এটা পুরোপুরি জাতিদাঙ্গা। মণিপুরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ আনার পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা চেষ্টা করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা। কিন্তু ততদিনে বিজেপির ৯ বিধায়ক প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিতে জানিয়েছেন রাজ্য সরকারের প্রতি আস্থা নেই মানুষের।

এই পরিস্থিতিতেই মণিপুরের স্থানীয় স্তরের অনেক বিজেপি কার্যকর্তা প্রশ্ন তুলে যাচ্ছেন, মণিপুরে কী করে খ্রিস্টানদের সংখ্যা বেড়ে গেল। মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ডে কেন আশি শতাংশের বেশি মানুষ খ্রিস্টান। ফলে বিজেপি শাসিত মণিপুরে জাতিদাঙ্গা থামানো অন্তত নরেন্দ্র মোদিদের কর্ম নয়। কারণ আজ দুই নারীকে ধর্ষণের পর নগ্ন করে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রকাশ‍্যে আসার পর ক্ষোভে ফেটে পড়ে অপরাধীদের ফাঁসির দাবি তোলা মুখ‍্যমন্ত্রী বীরেন সিং এই কিছুদিন আগেই কুকিদের মায়নামারে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। দক্ষিণ পন্থী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি হিংসার সঙ্গে সঙ্গে নারীনিগ্রহ ও ধর্ষণকে সংখ‍্যালঘুদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের পদ্ধতি হিসাবে বৈধতা দেয়। মণিপুরেও তার ব‍্যতিক্রম ঘটেনি।

একটা সময় নাগাল্যান্ডে জাতিগত দাঙ্গা রাজ্যের উন্নয়ন থমকে দিয়েছিল। মণিপুরের মতো ভারতের ক্রীড়াচর্চার শীর্ষস্থানীয় রাজ‍্যেও কি তেমনটা হতে চলেছে?