বৈদিক সাহিত্য ও শাস্ত্র থেকে সে সময়ের সামাজিক কাঠামোর একটা ছবি দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্যই সাহিত্যিকের স্বাধীনতা রয়েছে সেই কাঠামোকে অতিক্রম করবার। স্বাধীনভাবে স্বপ্ন দেখবার। নির্দিষ্ট সামাজিক অনুশাসন বা পরম্পরার কাঠামোর সমালোচনা করবার। সীমিত এই স্বাধীনতা সংস্কৃত সাহিত্যেও কখনও কখনও দেখা গিয়েছে। কিন্তু মোটের ওপর তা কখনোই লঙ্ঘন করা হয়নি, বরং তাকে প্রতিবিম্বিত করেছে মাত্র। সুতরাং আলোচনার শুরুতে মনুসংহিতার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তৎকালীন সমাজ ও তার কাঠামোটা কেমন ছিল আগে সে সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা থাকা দরকার।

এযাবৎ কাল পর্যন্ত বৈদিক সভ্যতার যেসকল ধর্মসূত্র, ধর্ম শাস্ত্র ও স্মৃতিগ্রন্থ আমরা দেখতে পেয়েছি তা থেকে এটা স্পষ্ট ভাবেই বলা যায় যে, সেসময়ে শূদ্রের স্থান ছিল বর্ণাশ্রম ভিত্তিক সমাজে সবার নীচে। আরও কিছুদিন বাদে জন্ম নেওয়া জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদের যুগে এসে বলা হলো যে, পূর্ব জন্মের কুকর্মের বা পাপের ফলেই এজন্মে শূদ্র হয়ে জন্মলাভ হয়েছে। অতএব পরবর্তী জন্মে যদি এর থেকে মুক্তি পেতে চাও তবে এজন্মে মন দিয়ে উচ্চ বর্ণের সেবা করে যাও এবং পূণ্য কামিয়ে যাও, এভাবেআগামী জন্মে উচ্চ বংশে জন্মগ্রহণ করার সুযোগ তৈরি হলেও হতে পারে। তাই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও অপরাপর উচ্চ শ্রেণীর সমস্ত হুকুম কোনও প্রশ্ন না করে তামিল করে যাও আর মৃত্যুর পর আগামী জন্মের জন্য ব্যাগ ভর্তি পূণ্য সঞ্চয় করে যাও। মনে রেখো, তোমার সমস্ত পাপ ও পূণ্যে হিসেব কিন্তু রাখা হচ্ছে এবং মৃত্যুর পর সেই সমস্ত পাপ ও পূণ্যের একটা ব্যালেন্সশীট তৈরি করা হবে যার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যে আগামী জন্মে তুমি কি হয়ে জন্মাবে। মজার ব্যাপার হল, পাপ ও পূণ্যের এত যে কড়াকড়ি তা কিন্তু শুধুমাত্র শূদ্র ও নারীদের উপরেই; ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা উচ্চ শ্রেণীর ক্ষেত্রে তার উল্লেখ প্রায় নেই বললেই চলে। তাই, পূণ্য কামাবার দায় একমাত্র শূদ্রের। এটাই মনুসংহিতার মূল কথা। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই মনুসংহিতার উপর ভিত্তি করে তৎকালীন সমাজের যে সামাজিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল তাতে শূদ্রের স্থান ছিল বর্ণাশ্রমের সবার নীচে।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, শূদ্র মানেই তারা দাস নয়। শূদ্রদের মধ্যেও যারা অগ্রতর কেবলমাত্র তারাই দাস। বাকিরা বৃত্তিজীবী। বৃত্তিজীবীরা আবার দুভাগে বিরক্ত, (এক) অনিরসিত ও (দুই) নিরবসিত। অর্থাৎ, জলচর ও জল-অনাচরণীয়। এই দ্বিতীয় ভাগে আছেন, বৃষল, পুল্কস, শ্বপাক, ডোম, চন্ডাল ইত্যাদি। সংস্কৃত সাহিত্যে এই দুধরনের শূদ্রের কথাই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়।

অর্থাৎ মনুসংহিতার যে অনুশাসন এবং তার উপর ভিত্তি করে যে সামাজিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল তার মূল সম্পদ ছিল উচ্চ বর্ণের হাতে। আরও সহজ করে বলতে হলে বলা উচিত, উৎপাদনের হাতিয়ারের মালিকানা স্বত্ব থেকে কেবল মাত্র শূদ্ররা বঞ্চিত ছিল। যেহেতু উৎপাদনের হাতিয়ারের মালিকানা স্বত্ব থেকে তারা বঞ্চিত ছিল তাই তাদের শ্রমের দ্বারা যে সম্পদ সৃষ্টি হতো তার ভোগ দখল করতো সমাজের উচ্চ বর্ণের মানুষেরাই। শূদ্ররা অর্থাৎ working class আজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে সম্পদ সৃষ্টি করতো -এভাবে তারা মনুর বিধান অনুযায়ী উচ্চ বর্ণের সেবা করে বিনিময়ে অনিশ্চিত পর জন্মের জন্য পূণ্য কামাতো মাত্র। ফলে, সমাজে সম্পদ উৎপাদন ও তার বন্টনের মধ্যে চূড়ান্ত অসাম্য বজায় ছিল। সমাজের মেহনতি মানুষেরা যেহেতু সম্পদের ভোগ দখল থেকে বঞ্চিত ছিল তাই তাদের জীবন ছিল দুর্বিসহ। অসাম্য বজায় রেখে আর্য ভাষাগােষ্ঠীর আধিপত্য বজায় রাখা জন্যই মনুসংহিতার প্রয়োজন ছিল, এবং মনুসংহিতা সুচারু রূপে সে কাজে সফল হয়েছিল।

তৎকালীন সমাজের এই বৈষম্যের সমাজের দুই শ্রেণীর মানুষের চরিত্রের মধ্যেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু সেটা একদিনে হয়নি, হয়েছে দীর্ঘকাল ধরে। আর  সামাজিক এই বিভাজনের মূলে যে ছিল মনুসংহিতা, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সংস্কৃত সাহিত্যেও এর অনেক উদাহরণ পাই; যেমন, কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ কাব্যগ্রন্থে আদর্শ রাজা দিলীপের সংলাপের মধ্যে সেসময়ের সমাজের যে ভিত্তি তা সম্পর্কে শুনি- মনুর খুঁড়ে দেওয়া পথটি থেকে তাঁর প্রজারা একচুলও এদিক ওদিক যেত না (১৪/৬৭)। এর দ্বারা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে গুপ্তযুগে মনুর বিধান ছিল অলঙ্ঘ্যনীয়।

এতো গেল সমাজের উপর মনুসংহিতার প্রভাবের কথা। কিন্তু এই আধিপত্যবাদী মনুসংহিতা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর চরিত্র গঠনের উপর কিরকম প্রভাব ফেলেছিল? এ বিষয়েও সংস্কৃত সাহিত্যে অনেক উদাহরণ আমরা দেখেছি। যেমন ধরুন, অভিজ্ঞানশকুন্তলায় একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে…যেখানে আমরা এক জেলেকে দেখতে পাই। যিনি মাছের পেটে রাজা দুষ্যন্তের আংটিটি পান। আংটিটি পেয়েই তিনি লোকাল থানায় (মজা করে বলছি) যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি চূড়ান্ত হেনস্থার শিকার হন। থানার ওসি থেকে বড়বাবু এমনকি একজন স্বাধারণ হাবিলদার পর্যন্ত কেউ মানতেই রাজি নন যে জেলেবাছাধন আংটিটি সত্যি সত্যিই মাছের পেট থেকেই পেয়েছেন। তাদের প্রত্যেকেরই বধ্যমূল ধারণা এই যে, বাছাধন আংটিটা চুরি করেছে; এখন বিপদ বুঝে গল্প ফাঁদছে। তো যাইহোক, শেষ পর্যন্ত ওই আংটিটা রাজা দেখলেন এবং তার স্মৃতি ফিরে পেলেন। জেলে বাবাজি আংটিটা নিয়ে আসার জন্য তাকে অনেক উপহার-তুপহার, মোহর ইত্যাদি দিলেন। উপহার পেয়ে ওই হতভাগ্য জেলে তার থেকে বেশ কিছু উপহার ও মোহর শর্ত মাফিক ওই থানার পুলিশদের দিয়ে দিলেন। এই গল্পটা থেকে সেই সময়ের সমাজের একটা চিত্র আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়। আমরা এই গল্পে যে যে চরিত্রগুলি দেখি তাদের মনুসংহিতার উপর ভিত্তি করে যে সামাজিক অনুশাসন, সেই অনুশাসন অনুযায়ী মূলত তিনটি বর্ণের মানুষদের দেখতে পাই- (এক) রাজা (Ruling Class), (দুই) পুলিশ (Ruling Class-এর অন্যতম হাতিয়ার এবং (তিন) জেলে, শূদ্র (মেহনতি মানুষ, প্রলেতারিয়েত শ্রেণী)। এই তিনটি শ্রেণীর মানুষের চরিত্র তিন রকম।

এক, রাজা অর্থাৎ Ruling Class-এর লোকেরা হলেন এমন যিনি, ব্যভিচারের সাথে যুক্ত, চরিত্রহীন এবং সত্যভ্রষ্ট।

দুই, পুলিশ হলো ঘুষখোর। দুর্নীতিগ্রস্থ এবং চূড়ান্ত ভাবে কামচোর। জনগণের কোনও কথাই তারা মন দিয়ে শুনতে চান না আর তার মধ্যে যদি তিনি সাধারণ মেহনতি মানুষ হন অর্থাৎ শূদ্র হন তবে তো কথাই নেই।  যেনতেন প্রকারে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে তার কাছে যৎসামান্যই যা কিছু আছে তা হাতিয়ে দেওয়াই হলো তাদের কাজ।

তিন, জেলে অর্থাৎ শূদ্র বা মেহনতি মানুষেরা হলেন অত্যন্ত সৎ। নিজের জীবন বিপন্ন হলেও কিছুতেই সততার পথ ছাড়তে তারা চান না।

এই ধরনের অনেক নেতা মন্ত্রীদের আমরা বর্তমান সময়েও দেখতে পাই। আর পুলিশ প্রশাসন সেকালেও দুর্নীতিগ্রস্থ ছিল আজকেও তেমনই আছে। কিন্তু জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে হাজার হাজার বছর ধরে জীবনের জয়গান গেয়ে চলেছেন মেহনতি মানুষেরাই। তা সে মনুসংহিতার যুগেই হোক কি বর্তমান যুগে। এদের কোনও পরিবর্তন হয়নি, হাজার হাজার বছর পরেও মেহনতি মানুষেরা একই রকম থেকে গিয়েছেন এবং একই রকম ভাবে দুঃখ যন্ত্রণার শিকার হয়ে চলেছেন। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সম্পত্তির মালিকানা স্বত্ব ভোগের এই ব্যবধান, সে যুগেও ছিল এযুগেও আছে…শুধুমাত্র Ruling Class-এর চরিত্র পরিবর্তন হয়েছে মাত্র, শোষন একই আছে।