মরিচঝাঁপি নিয়ে লেখা অমিতাভ ঘোষের ‘দ্যা হাংরি টাইড’ নামক একটি বই নিয়ে মাইনে পাওয়া বিজেপির আই.টি. সেলের কর্মীরা কিছু বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য তুলে লাগাতার ভাবে সোস্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করছেন। উক্ত বইটির নাম উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, 1লা ফেব্রুয়ারি 1979 সালে সরস্বতী পুজোর দিনে 15 জন শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে কমিউনিস্টরা, যাঁরা একটি কুঁড়ে ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল এবং সেখানেই সরস্বতী পুজোর আয়োজন করছিলো। একথা বলে হিন্দুদের উপর কমিউনিস্টদের আক্রমণের কথা, প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন এবং হিন্দুত্বের জিগির তুলে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে আসন্ন সরস্বতী পুজোর প্রাক্কালে মানুষ খেপাতে চাইছেন। সরস্বতী পুজো যা একটি উৎসবের মেজাজে গোটা বাংলা জুড়ে পালিত হয় তাকে হিংসাত্মক রূপ দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। 

অমিতাভ ঘোষের লেখা বইটির প্রতিটি তথ্য কোথা থেকে যে সংগ্রহ করা হয়েছে তার কোন উল্লেখ নেই। এমনকি যে সমস্ত তথ্য বইটিতে দেওয়া হয়েছে তার সত্যতা সম্পর্কেও কোনো প্রামাণ্য দলিল বা গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হয়নি। তা হলে এসব আজগুবি তথ্য উনি পেলেন কোথা থেকে? সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো, সরস্বতী পুজোর যে ঘটনার কথা বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে তা অতি ভয়াবহ। তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধী আনন্দ বাজার পত্রিকাও এমন একটি মোক্ষম সত্য কেন তখন তুলে ধরেনি? আনন্দ বাজার পত্রিকা তো সরস্বতী পুজোর (1লা ফেব্রুয়ারি) ঠিক আগের দিন অর্থাৎ 31শে জানুয়ারি, 1979 পুলিশের আক্রমণে বেশ কয়েকজন মারা গেছেন বলে একটা নামের তালিকাও প্রকাশ করে। যদিও ঐ তালিকায় নাম থাকাদের সকলকেই পরের দিনই সশরীরে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। এহেন আনন্দ বাজার পত্রিকা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে এতো বড় একটি কথা কেন চেপে গেল -একথার উত্তর একমাত্র বুড়ি গঙ্গাই জানেন। 


সেসময়ে সাংবাদিকতার নামে মরিচঝাঁপি নিয়ে মিথ্যা ও গল্পের গরু কে গাছে চড়ানোর কাজে যিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তার একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করতে চাই। 1979 সালের 29, জানুয়ারীতে আনন্দ বাজার পত্রিকায় লেখা হয়, “মরিচঝাঁপিতে এখন দশ থেকে বারো হাজার উদ্বাস্তু বসবাস করছেন, তাদের জীবিকা হলো…”। সেসময় মরিচঝাঁপি নিয়ে সুখরঞ্জন সেনগুপ্তই আনন্দ বাজারে লিখতেন। পরবর্তী কালে এই সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত “একালের কারবালা” নামক একটি বই লেখেন সেখানে তিনি বলেন, “মরিচঝাঁপিতে যখন পশ্চিমবঙ্গের সিপিআই(এম) সরকার ‘বনভূমি রক্ষা’র কেন্দ্রীয় আইন প্রয়োগ করে প্রায় 40 হাজার উদ্বাস্তু মানুষের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করল সেই সময় সেই দ্বীপে আড়াই থেকে তিন হাজার শিশুর বাসভূমি ছিল।” দেখুন, 29শে জানুয়ারিতে আনন্দ বাজারে লেখা দশ-বারো হাজার কয়েক বছরের মধ্যেই কিভাবে লাফিয়ে চল্লিশ হাজারে পরিণত হলো! 


জনগণের রায়ে সদ্য পরাজিত বামফ্রন্ট সরকারের বিরোধী নেতারা তখন যেভাবেই হোক সরকারের বিরুদ্ধে মানুষকে খেপিয়ে তুলতে চাইছিলো। কমিউনিস্ট বিরোধী পুঁজিবাদের সমর্থক একদল সাংবাদিক এই কাছে বিরোধীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সাহায্য করছিল। সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে আরও অতিরঞ্জিত করে তুলতে কখনো কখনো নিজেরাও মানুষ খেপানোর কাজে জড়িয়ে পড়তে থাকে। অস্ত্র সরবরাহ থেকে অর্থ সরবরাহ সব কাজেই তারা বিরোধীদের প্রত্যক্ষ ভাবে সাহায্য করতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, 11ই জানুয়ারি’ 1979 পুলিশ কাশীকান্ত মৈত্রসহ আরও কুড়ি জনকে গ্রেফতার করে (তথ্য:- গণশক্তি: 12ই জানুয়ারি, 1979)। এই কুড়িজনে মধ্যে অনেক MLA-রাও ছিলেন, যেমন- সন্দীপ দাশ, কিরণময় নন্দ, প্রবোধ সিংহ, বীরেন মিত্র, রবিশঙ্কর পান্ডে এবং বলাই দাশ মহাপাত্র। জনতা পার্টির নেতাদের মধ্যে ছিলেন, অশোক মুখার্জি, স্বরাজবন্ধু ভট্টাচার্য, নুর মহম্মদ প্রমুখ। আর ছিলেন সাংবাদিকেরা, অজিত চক্রবর্তী, উমাশঙ্কর হালদার, রাজকিশোর, শম্ভুনাথ, বিমল নন্দী, দিলীপ ঘোষ ও অশোক বসু। 


মরিচঝাঁপি নিয়ে বহু আষাঢ়ে গল্প তৈরী করা হয়েছে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য। কিন্তু অমিতাভ ঘোষের লেখা ‘দ্যা হাংরি টাইড’ বইটির কথা উল্লেখ করে বিজেপির আই.টি. সেল যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাচ্ছে সকলে মিলে তাঁর বিরোধিতা করা উচিত। বিশেষত যখন এর সাথে সরস্বতী পুজোর মতোন বাংলা ও বাঙালির একটি সর্বজন স্বীকৃত উৎসবের বিষটি যুক্ত রয়েছে। যুক্ত রয়েছে ছাত্র সমাজের মনোভাব গড়ে তোলার প্রশ্নটি। মরিচঝাঁপির প্রকৃত সত্য এই আষাঢ়ে গল্প দিয়ে বোঝা যাবে না, সে সত্য বুঝতে হবে ঐতিহাসিক সত্যের উপর ভিত্তি করে। সত্যের বদলে মিথ্যাকে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুদিন ধরে, অশুভ শক্তির এই ঘৃণ্য কৌশলকে সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের সাহায্য নিয়ে আমাদের রুখে দিতেই হবে।