![](https://www.leftsquad.in/wp-content/uploads/2022/09/ak-2-1024x512.jpg)
বার্লিন পাঁচিল ভেঙে গেলো। ভাঙলো সোভিয়েত। পুঁজিবাদ স্বদর্পে ঘোষণা করলো, “মার্কসবাদের মৃত্যু ঘটেছে, মৃত্যু ঘটেছে কমিউনিজমের। পুঁজিবাদ অজেয়।” দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে এই বার্তা। তবে কি এতো দিনে ইউরোপ সত্যি সত্যিই কমিউনিজমের ভূত ছাড়াতে পারলো? সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া গোটা পৃথিবী জুড়ে তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুঁজিবাদ।
কিছু মার্কসবাদী চিন্তা চেতনার মানুষের মনেও ধীরে ধীরে প্রশ্ন তৈরি হতে থাকে। গোটা বিশ্বের সাথে সাথে আমাদের দেশেও এই চিন্তা প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। প্রশ্ন উঠতে থাকে মার্কসবাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত কিছু শব্দ ও চিন্তা নিয়ে। বলা হতে থাকে, “শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রের দরকার নেই। দরকার নেই বিপ্লবের। শ্রেণী সমঝোতার মধ্যে দিয়েই অর্থাৎ সংসদীয় রাজনীতির মধ্যে দিয়েই পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। তাঁরা একথা ভুলে গেল, শুধুমাত্র বুর্জোয়া সংসদীয় রাজনীতির উপর নির্ভর করে ব্যাপক জনগণের জীবনে ‘আমূল পরিবর্তন’ ঘটানো যায় না। করা যায় না কোনো মৌলিক পরিবর্তন। তাঁরা বাস্তব অবস্থাকে উপেক্ষা করেই সুখের স্বর্গ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন।
ভূতের আবির্ভাব ______________
অপর দিকে সমস্ত ঘটনার দিকে নজর রেখে বাস্তব অবস্থাকে সঠিক ভাবে মূল্যায়ন করে বেশ কিছু মানুষ গোটা পৃথিবী জুড়ে খুঁজতে থাকলেন উত্তর। তারা আরও গভীর ভাবে মার্কসবাদের অধ্যায়ন করতে লাগলেন। বুঝতে চাইলেন, সত্যি সত্যিই কি মৃত্যু ঘটেছে কমিউনিজমের ভূতের? যে কথা প্রথমেই ঘোষণা করা হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহারে-
“ইউরোপ ভূত দেখছে – কমিউনিজমের ভূত। এ ভূত ঝেড়ে ফেলার জন্য এক পবিত্র জোটের মধ্যে এসে ঢুকেছে সাবেকী ইউরোপের সকল শক্তি – পোপ এবং জার, মেত্তেরনিখ ও গিজো, ফরাসি রাডিকালেরা আর জার্মান পুলিশগোয়েন্দারা।
এমন কোনও বিরোধী পার্টি আছে, ক্ষমতায় আসীন প্রতিপক্ষ যাকে কমিউনিস্টভাবাপন্ন বলে নিন্দা করেনি? এমন বিরোধী পার্টিই বা কোথায় যে নিজেও আরও অগ্রসর বিরোধী দলগুলোর, তথা প্রতিক্রিয়াশীল বিপক্ষদের বিরুদ্ধে পাল্টা ছুঁড়ে মারেনি কমিউনিজমের গালি ?
এই তথ্য থেকে দুটি ব্যাপার বেরিয়ে আসে।
এক। ইউরোপের সকল শক্তি ইতিমধ্যেই কমিউনিজমকে একটা শক্তি হিসাবে স্বীকার করেছে।
দুই। সময় এসে গেছে যখন প্রকাশ্যে, সারা জগতের সম্মুখে কমিউনিস্টদের ঘোষণা করা উচিত তাদের মতামত কী, লক্ষ্য কী, তাদের ঝোঁক কোন দিকে, এবং কমিউনিজমের ভূতের এই আষাঢ়ে গল্পের জবাব দেওয়া উচিত পার্টির একটা ইস্তাহার দিয়েই।
এই উদ্দেশ্য নিয়ে নানা জাতির কমিউনিস্টরা লন্ডনে সমবেত হয়ে নিম্নলিখিত ‘ইস্তাহারটি’ প্রস্তুত করেছেন; ইংরাজি, ফরাসি, জার্মান, ইতালীয়, ফ্লেমিশ এবং ডেনিশ ভাষায় এটি প্রকাশিত হবে।”
![](https://www.leftsquad.in/wp-content/uploads/2022/09/received_798503434619746.jpg)
ভূতের মৃত্যু!___________
বার্লিন পতন ও সোভিয়েত ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে ইউরোপীয় চিন্তাবিদদের মধ্যে বুর্জোয়া বর্গের উপযোগী ভাববিশ্ব আরও দৃঢ় ভিত্তি পেতে থাকে। এরফলে মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে আস্থা হারিয়ে ফেলতে থাকেন একদল বুদ্ধিজীবী; তাঁরা বলতে থাকেন, সমস্ত ধরনের ঐতিহ্য-সম্পৃক্ত তত্ত্ব অবান্তর হয়নি কেবল, মানবসত্তা এবং মানবতাবাদ বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে গেছে শূন্যে। এমনকি ফুকোর মতন চিন্তাবিদও ‘মানুষ’কে সাম্প্রতিক আবিষ্কার বলে ঘোষণা করেন; তিনি বলেন, এই আবিষ্কারের আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার মুহূর্তটি আসন্ন। কাব্যিক ঢঙে তিনি বলেন, বালির উপরে আঁকা ছবি যেমন সমুদ্রের জলে মুছে যায়-ঠিক তেমনই একদিন মানুষও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই চিন্তা স্বাভাবিক চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে চূড়ান্ত নির্বাসন ডেকে আনে। এহেন ভাববিশ্বে মার্কসবাদের মৃত্যু যে ঘোষিত হবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ এমন ভাবে তৈরি হচ্ছিল যাঁর ফলে মার্কসবাদের বুনিয়াদি চিন্তা চেতনাকে ওলটপালট করে তোলা যায়। এই ফাঁকে মার্কসবাদীদের নিজস্ব আয়ুধ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দ্রুত সে যায়গায় বিপরীত চিন্তা ভাবনাকে প্রতিস্থাপন করার কাজ ঘটা করে চালু হলো। পরিস্থিতিকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে নিজেদের মতো করে চিন্তা-চেতনার ব্যাখ্যা ও নির্মাণ করতে থাকেন একদল বুদ্ধিজীবী যাঁরা নিজেদের উত্তর-মার্কসবাদী বলে পরিচয় দিতে থাকেন। আসলে, মার্কসবাদের মৌলিক চিন্তা চেতনা থেকে দূরত্ব তৈরি করা এবং তাকে নস্যাৎ করে দেওয়াই ছিল এদের লক্ষ্য।
সঠিক মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে এগিয়ে চলাই তখনকার পরিস্থিতিতে হয়ে উঠলো দুরূহ। এ এক কঠিন পরিস্থিতি। প্রকৃত অর্থেই এযাবৎ কাল পর্যন্ত জানাবোঝাকে আবারও নতুন করে জানবার ও বুঝবার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। সাথেসাথে তাৎখনিক প্রতিক্রিয়ার সাথেও লড়াই চালিয়ে যাওয়া।
ইউরেকা! ইউরেকা! __________________
আধুনিক সমাজের ইতিহাসে এই যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ফরাসি দার্শনিক জাক দেরিদা প্রকাশ করেন একটি ঐতিহাসিক দলিল। ১৯৯৩ সালে ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হয় দেরিদার Specters of Marx বইটি, যেটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। তাঁর বিখ্যাত ‘বিনির্মাণ তত্ত্ব’কে আরও সহজ ও বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা করেন এই বইটিতে। ১৮৬৮-তে প্যারিসে ছাত্র বিক্ষোভ থেকে শুরু করে ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীর ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রতিকটা ঘটনাকে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করেন এখানে। তিনি দেখান এই প্রত্যেকটা ঘটনা থেকে কিভাবে ধীরে ধীরে অস্থিরতা, স্ববিরোধিতা, দ্রোহ, যন্ত্রণাকে সমাজে- মানুষের কাছে সহনীয় করে নির্মাণ করা হয়েছে। সোভিয়েতে, পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে সমস্ত ভুল করা হয়েছিল এবং পরিবর্তনশীল সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তত্ত্বকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে যেসব ঘাটতি থেকে গিয়েছিল-এর সমবেত প্রভাবে সমাজতন্ত্র হয়ে ওঠে মঞ্চসাজ-সর্বস্ব। তার উপর ছিল বিশ্ব পুঁজিবাদের প্রচ্ছন্ন ও প্রকাশ্য আক্রমণ। সবশেষে অস্ত্রপ্রযুক্তির মাধ্যমে সুপরিকল্পিত ভাবে আক্রমণ করা হচ্ছিল ভাবাদর্শগত ভিত্তিকে।
তথাকথিত চিন্তা চেতনার জগতে পরিচিত বুদ্ধিজীবীরাও শ্রেণি অবস্থান জনিত বাধ্যবাধকতায় বিশ্ব পুঁজিবাদের হাতের পুতুল হয়ে উঠেছিলেন। ফলে মার্কসবাদের ডেথ সার্টিফিকেটে শেষ পেরেকটি মারবার ব্যাকুলতা দেখাতে থাকেন ফুকো, লিওতার, বদ্রিলা প্রমুখ তাত্ত্বিকেরা। এঁরা বোঝাতে থাকেন- কোনো নির্মিতি, কোনো বিশ্বাসের বৈধতা এখন আর সম্ভব নয়। সোভিয়েতের পতনের পর ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা তো সদর্পে ঘোষণা করেন, ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ হলো। এরই সাথে সাথে চললো পুঁজিবাদের জয়গান। পুঁজিবাদ অজেয়। দেরিদা তাঁর বইতে এই অবস্থাকে সোজাসাপটা ভাবে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বারেবারেই সাহায্য নিয়েছেন উইলিয়াম শেকসপিয়রের। আরও সঠিকভাবে বলতে হলে বলা যায় শেকসপিয়রের লেখা “ম্যাকবেথ” নাটকটির।
ষোড়শ শতকে লেখা এই বিখ্যাত নাটকটির প্রেক্ষাপটের সাথে তৎকালীন সময়ের এক অদ্ভুত মিল যেন খুঁজে পাওয়া যায়। নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে। যাঁরা নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতা কেড়ে নিতে চান, তাদের উপর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বাস্তব ও মানসিক প্রভাব এই নাটকে দৃশ্যায়িত হয়েছে। ম্যাকবেথে দেখতে পাই-
স্কটল্যান্ডের দুঃসাহসী সেনাপ্রধান ম্যাকবেথ তিন ডাইনির ভবিষ্যদ্বাণী থেকে জানতে পারেন যে, একদিন তিনি স্কটল্যান্ডের রাজা হবেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষার দ্বারা প্রলুব্ধ এবং নিজের স্ত্রীর কৃতকর্মের দ্বারা তাড়িত হয়ে ম্যাকবেথ রাজা ডানকানকে হত্যা করেন এবং স্কটল্যান্ডের সিংহাসন অধিকার করে বসেন। কিন্তু তারপরই অপরাধবোধ-প্রসূত এক মানসিক বিকৃতির বশে শত্রুতা ও সন্দেহের হাত থেকে নিজেকে রক্ষে করতে একের পর এক খুন করতে বাধ্য হন তিনি। সেই সঙ্গে ম্যাকবেথ হয়ে ওঠেন এক স্বৈরাচারী শাসক। একের পর এক ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড এবং তার অনুবর্তী গৃহযুদ্ধের ফলে ম্যাকবেথ ও তার স্ত্রী দু’জনেই উন্মাদ হয়ে যান। লেডি ম্যাকবেথ আত্মহত্যা করেন এবং ম্যাকবেথ ম্যাকডাফের হাতে পরাজিত ও নিহত হন।
ম্যাকবেথ যেভাবে ধীরে ধীরে স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল এবং নিজেকে অজেয় ভাবতে শুরু করেছিলেন ঠিক তেমনি ভাবেই সোভিয়েত পতনের পরে পরেই পুঁজিবাদও নিজেকে শত্রু মুক্ত, অজেয় ভাবতে শুরু করে। তারা স্বদর্পে ঘোষণা করে, পুঁজিবাদের পয়লা নম্বরের শত্রু মার্কসবাদের মৃত্যু ঘটেছে। ম্যাকবেথ যেন একটা রোগ। যে রোগাক্রান্তের ফলে একজন আদর্শবাদী, সত্যনিষ্ঠ মানুষ হয়ে ওঠেন চরম প্রতিক্রিয়াশীল স্বৈরাচারী। দেরিদা তাঁর বইতে বলেন, যেভাবে গোটা পৃথিবীর মানুষদের এমনকি মার্কসবাদী চিন্তা চেতনার মানুষদের মগজেও অমার্কসীয় চিন্তা চেতনাকে ধীরে ধীরে “নির্মাণ” করা হলো সেই নির্মাণেরও একদিন বিনির্মাণ ঘটবে। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, দেরিদা পুনঃনির্মাণের কথা কিন্তু বলেননি। তিনি বলেছেন বিনির্মাণের কথা। অর্থাৎ যা আগের থেকে সম্পূর্ণই পৃথক। আরও মজার বিষয় হলো, দেরিদা তাঁর বিনির্মাণ তত্ত্বটি নিজেই খন্ডন করেন তাঁর বিনির্মাণ তত্ত্ব দিয়েই। তিনি বলেন, এই বিনির্মাণেরও আবার বিনির্মাণ ঘটেবে এবং ঘটতেই থাকবে। কেননা প্রশ্ন থেকে কখনোই নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে সমাজকে টিকিয়ে রাখা যায় না। বিনির্মাণ তাই একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া।
![](https://www.leftsquad.in/wp-content/uploads/2022/09/IMG-20220912-WA0004.jpg)
ভূতের চোদ্দগুষ্টির জয়_____________________
দেরিদা তাঁর “Specters of Marx” বইটিতে ইচ্ছে করেই কমিউনিজমের ভূতের প্রসঙ্গটি এনেছেন। বার্লিন প্রাচীর ও সোভিয়েত পতনের পর বিশ্ব পুঁজিবাদ যে স্বস্থির নিঃশ্বাস নিতে চাইছিলো পুনরায় সেই ভূতকে ইউরোপ তথা বিশ্ব পুঁজিবাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার জন্যই হয়তো ভূতের প্রসঙ্গটি এনেছেন। তবে যদি এটাই সত্যি হয় তবে হলফ করে বলা যায় দেরিদার Specters of Marx আবারও পুঁজিবাদকে কমিউনিজমের ভূত দেখাতে অভূতপূর্ব ভাবে সাফল্য অর্জন করেছে।