“আপোষ করার চাইতে বরং, উপোস করা ভালো”৷ উপোস করার কথায় মনে পড়লো, একজন রুশ, সোভিয়েত লেখক, সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদী সাহিত্যিক তিতোর কথা। যিনি পরিচিত সারা বিশ্বজুড়ে মাক্সিম গোর্কি  হিসাবে। গোর্কি কথার তিতো বা তিক্ত। ওঁনার আসল নাম আলেক্সেই ম্যাক্সিমোভিচ পেশকভ, রুশ ভাষায় Алексей Максимович Пешков। আজ ওনার মৃত্যু দিন। প্রয়াণ দিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

দুই শব্দবিশিষ্ট যে ম্যাক্সিম গোর্কিকে আমরা চিনি, ভয়ানক রকম আলাদা, অন্য রকমের মানুষ। গোর্কি সম্পর্কে একটি লেখায় জানতে পারি তাঁর ৩২ বছর বয়সের ছোট ও স্নেহধন্য লেখিকা নিনা বের্বিয়েরভা এক মন্তব্য থেকে, ‘গোর্কির সঙ্গে তর্ক করা এক অসম্ভব ব্যাপার। কোনো রকমেই তাঁকে আপনার মতো টানতে পারবেন না। কারণ, অপছন্দের জিনিস না শোনা এবং যে প্রশ্নের জবাব তাঁর জানা নেই, সেই প্রশ্ন একেবারেই কানে না তোলার এক অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা তাঁর।’ আলেক্সেই নামের এই ছেলেটি অসম্ভব দুঃসহ এক ‘তিক্ত’ জীবনের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে ক্রমশ যে ম্যাক্সিম গোর্কি হয়ে উঠতে লাগল। বাবা মারা যাবার পর মায়ের সঙ্গে এসে আশ্রয় নিলেন মামার বাড়ি নিজনি নভগরোদ শহরে। তিনি ৯ বছর বয়সে পিতৃমাতৃহীন হন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন গোর্কি। কিন্তু স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। প্রথম কারণ, দারিদ্র্যতা, দ্বিতীয় কারণ, দাদুর বাড়িতে পড়াশোনার কোনো পরিবেশই ছিল না বা পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তার কথা কেউ ভাবত না। ফলে তিনি ঘুরে বেড়ানোর পথটাকেই বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু স্কুলের বাঁধন ছিন্ন হলেও বইয়ের প্রতি তার আসক্তি তৈরি হয় এবং তিনি নিজে নিজেই লেখাপড়া করতে থাকেন। সম্পূর্ণই স্বশিক্ষিত এক মানুষ বলা যায় গোর্কিকে। কালে কালে, অন্তত শিল্পী ও সাহিত্যিকদের বিবেচনায় গণ্য করলে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় ব্যর্থ, অথচ প্রতিভার এমন মানুষ বিশ্বজুড়ে কম ছড়িয়ে নেই। অধিকন্তু বাঙালির ইতিহাসে ও সংস্কৃতি-ঐতিহ্যে এই বাস্তবতা প্রখরভাবে উজ্জ্বল। বাংলার পাঠকসমাজে সম্ভবত মা উপন্যাসের সূত্র ধরে গোর্কির পরিচিতি। কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় লেবার স্বরাজ পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসেবে যখন লাঙল বেরোয়, তখন তার প্রথম সংখ্যা (২৫ ডিসেম্বর ১৯২৫) থেকেই নজরুলবান্ধব নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের ভাষান্তরে মা ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে থাকে। শুধু মা কেনও, গোর্কির অধিকাংশ প্রধান রচনা তত দিনে তাঁর স্বদেশে বেরিয়ে গিয়েছিল। আলোচ্য তিন উপন্যাসসহ। ধারণা করা যায় বিগত চল্লিশের দশক যখন বঙ্গদেশে বামপন্থা রাজনীতি ও আন্দোলনের স্বর্ণযুগ, সে সময় রুশ ও স্ক্যান্ডিনেভীয় সাহিত্য প্রচুর অনূদিত হয়েছিল এবং সেসবের ভেতরে গোর্কির রচনা সন্দেহাতীতভাবে ছিল।

একজন লেখক হিসেবে সফল হওয়ার প্রায় ১৫ বছর রাশিয়ার বিভিন্ন প্রদেশ ঘুরে বেড়াতেন; এই অভিজ্ঞতাগুলি পরে তাঁর লেখার ওপর প্রভাব ফেলেছে। গোর্কি উদীয়মান মার্কসবাদী সামাজিক-গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি বলশেভিক পার্টির সাথে কিছুদিন যুক্ত থেকে কাজ করেছিলেন। ১৮৮৭ সালে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যান এবং দীর্ঘ ৫ বছর ধরে পায়ে হেঁটে সমগ্র রাশিয়া ভ্রমণ করেন। ১৮৮২ সালে সাহিত্য রচনা শুরু করেন। তিনি জেহুদিয়েল কামিদা  ছদ্মনামে লিখেছিলেন।  ম্যাক্সিম গোর্কীর সর্বপ্রথম রচনা গল্প ‘মাকার চুদ্রা’। সেটি প্রকাশিত হয় তিবিলিসির সংবাদপত্র কাভকাজে। যেখানে বেশিরভাগ সময় ককেশীয় রেলওয়ে কর্মশালার জন্য তিনি বেশ কয়েক সপ্তাহ কাজ করেছিলেন। সাংবাদিক হিসাবে প্রাদেশিক সংবাদপত্রে কাজ করছিলেন। প্রথাগত রচনার বাইরে গোর্কি তার লেখায় প্রাধান্য দেন সমাজের নিচুশ্রেণীর খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের জীবনের গল্পকে। ১৮৯৮ সালে তার লেখা প্রবন্ধ ও গল্প নিয়ে একটি সংকলন রেখাচিত্র ও কাহিনী প্রকাশিত হয়। ১৯০০ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ফোমা গর্দিয়েভ । ১৯০২ সালে লেনিনের সঙ্গে তার দেখা হয়। এরপর তারা ঘনিষ্ট বন্ধুতে পরিণত হন। এই সময় তিনি প্রেসের পর সরকারি নিয়ন্ত্রণ নিয়েও কথা বলেন। ওই বছর অনারারি একাডেমিশিয়ান অব লিটারেচার নির্বাচিত হন। কিন্তু জার নিকোলাস-২ তা রদ করেন। এর প্রতিবাদে আন্তন চেকভ ও ভ্লাদিমির করোলেঙ্কো একাডেমি ত্যাগ করেন। গোর্কি তখন সেন্ট পিটার্সবার্গে। কাজানের এক আন্দোলনে অনেক ছাত্র নিহত হলে তিনি লেখেন ‘দ্য সং অব দ্য স্টর্মি পেত্রল’ ‘ঝড়ো পাখির গান’ নামের বিখ্যাত কবিতা। এই কবিতা যেন বিপ্লবের মন্ত্র। ক্রমেই গোর্কি পরিচিত হয়ে উঠছিলেন লেনিনের আদর্শে। ওই সময় বহু বিপ্লবী নেতাই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তিনি হয়ে উঠলেন জার কর্তৃপক্ষের এক নম্বর শত্রু। আন্দোলন তুঙ্গে। ১৯০৫ সালের বিপ্লব নিয়ে লেখেন নাটক চিলড্রেন অব সান। নাটকটির প্রেক্ষাপট ছিল ১৮৬২ সালের কলেরার মহামারী। কিন্তু প্রতীকি অর্থ বাদ দিলে এটি উঠে সে সময়ের রাশিয়ার চিত্র। একই বছর তিনি তাঁর বিখ্যাত দ্য লোয়ার ডেপথ (নীচুতলা) নাটকটি লেখেন। এই নাটকের বাণী ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের সর্বত্র। তখন গোর্কির পরিচিতি রাশিয়ার সীমা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ইউরোপে। গোর্কি হয়ে ওঠেন ইউরোপের শাসিত মানুষের কণ্ঠস্বর। ১৯০৬ সালে দেশে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। গোর্কিকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা করা হলো। ওই খবরে বলশেভিকরা তাকে আইভান নরোদনির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে দলের তহবিল গঠনের জন্য পাঠান। তারা জার্মানি হয়ে ফ্রান্স ও অমেরিকায় যান। সেখানেই লেখেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য মাদার’। মা রুশ কথা সাহিত্যিক মাক্সিম গোর্কি রচিত এক কালজয়ী উপন্যাস যা ১৯০৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। জারের ভয়ে এই বই প্রথম প্রকাশিত হয় ইংরেজি অনুবাদে। পৃথিবীজুড়ে এ উপন্যাস ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। উপন্যাসটি বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত এবং উপন্যাসের প্রধান দুটি চরিত্র হল প্যাভেল ও তাঁর মা। রুশ ভাষায় লিখিত এই উপন্যাসটি পরবর্তী এক শত বৎসরে সারা বিশ্বের প্রায় সব ভাষায় অনূদিত হয়েছে যা বাংলা ভাষায় মা নামে প্রকাশিত হয়।

উইকিপিডিয়ায় এক মার্কিন তরুণীর মন্তব্য করেছিলেন “কমিউনিস্টদের আমি ঘৃণা করি’’। কিন্তু মাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসটি বার বার না পড়ে থাকতে পারি না। একবার ভেবে দেখুন এমন কী আছে ‘মা’ উপন্যাসটিতে! যা এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয় এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো প্রতি ঘৃণা থাকা সত্ত্বেও একজন ভোগবাদী মার্কিন তরুণীকে বাধ্য করে উপন্যাসটি বার বার পাঠ করতে। আন্তন চেখভ যেখানে শেষ করেছিলেন, সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল মাক্সিম গোর্কির ‘মা’-এর পথচলা। নিজেদের বিশ্রী জীবন বদলানোর সর্বাত্মক যুদ্ধে শরিক হয়েছে এই উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা। ‘মা’ উপন্যাসের মাধ্যমে বিশ্বের উপন্যাস সাহিত্যে আর একটি নতুন ধারার সংযোজন হয়েছে। মাক্সিম গোর্কিই পৃথিবীতে প্রথম লেখক, যিনি সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লবী শ্রমিকদের সংগ্রামের চিত্র অঙ্কন করেছেন। আর এই চিত্র ধারণ করে, পৃথিবীতে এই ধারার প্রথম উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে ‘মা’।

উপন্যাসটির মূল চরিত্রে আছেন একজন মা, যিনি জন্ম দিয়েছিলেন এক বিপ্লবী সন্তানের। তাঁর সেই সন্তান নিজেকে গড়েছিল এমনভাবে যেন খেঁটে খাওয়া মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে পারে। আর তাই শোষিত সমাজের মানুষগুলোর ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে লড়াই করে গিয়েছিলো সে শেষপর্যন্ত।  উপন্যাসে মা-এর একটি নাম আছে। পেলাগেয়া নিলভনা। কিন্তু সেই নামটি উচ্চারিত হয়েছে পুরো উপন্যাসে মাত্র দুবার। বাকি সময় তিনি শুধু ‘মা’। নিতান্তই সাধারণ একজন গৃহিণী ছিলেন তিনি। স্বামী বেঁচে থাকতে সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতেন। কারণ তার সঙ্গে কোনোদিনই মানবিক ব্যবহার করেনি স্বামী। সেই জীবনকেই স্বাভাবিক জীবন হিসেবে ধরে নিয়ে তিনিও তদানীন্তন কোটি কোটি রুশ রমণীর মতো নিজের জীবনকে কাটিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে অন্য রকম হয়ে উঠতে হলো ছেলে পাভেলের কারণে, আসন্ন রুশ বিপ্লবের অগ্নিগর্ভ সময়ের কারণে। সাধারণ একজন মা থেকে বিশ্ববিপ্লবের মা হয়ে ওঠার যে বিবর্তন-চিহ্ন, সেই বিবর্তনই আসলে এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু।

মা চরিত্রের পাশাপাশি উপন্যাসের অন্য উজ্জ্বল চরিত্রের মধ্যে রয়েছে পাভেল। উপন্যাসে তার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি তুলনায় কম,কিন্তু ব্যাপ্তি অনেক বেশি। কিন্তু পুরো উপন্যাস আবর্তিত হয় তাকে ঘিরেই। তাই যখন আবির্ভূত হয়, তখন সেই পূর্ণ জ্যোতি-বিচ্ছুরিত চরিত্র নিয়েই আবির্ভূত হয়। দরিদ্র-কারখানা মজুরের ছেলে পাভেল, যার জীবন হওয়ার কথা ছিল কারখানা-বস্তির অন্য তরুণদের মতোই। তাদের বস্তিতে ‘রোববারগুলোয় ছোকরারা অনেক রাত্তিরে বাড়ি ফেরে ছেঁড়া কাপড়ে, সর্বাঙ্গে ধুলো-কাদা মাখা, কালশিটে-পড়া চোখ, জখমি নাক; কখনো আবার বন্ধুদের ঠেঙিয়ে এসে বিদ্বেষের সঙ্গে আস্ফালন করে, আর নয়তো গুঁতোনি খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে আসে’। কিন্তু যেকোনোভাবেই হোক, বিপ্লবী গোপন রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগের ফলে আমূল বদলে যায় পাভেলের জীবনযাপন। কাজের পরে বাইরে না বেরিয়ে ঘরে বসে বসে বই পড়ে। মা সব পরিবর্তনই খেয়াল করে। খেয়াল করে যে ‘ছেলের মুখখানা দিনে দিনে ধারালো হয়ে উঠছে, চোখ দুটির গাম্ভীর্য বাড়ছে, আর ঠোঁট দুটি যেন একটি কঠিন রেখায় আশ্চর্য সংবদ্ধ।’ ছেলের কাজ দেখতে দেখতে একসময় মা নিজের অজান্তেই ছেলের কাজের সহযোগী হয়ে দাঁড়ায়। চারদিকে এত অঢেল খাবার, তবু কোটি কোটি মানুষ খেতে পায় না কেন? চারদিকে এত বুদ্ধির দীপ্তি, তবে কেন ওরা এত মূর্খ! মা অনুভব করতে পারেন যে এই প্রশ্নই মানুষকে এনে দেবে তার কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। এইভাবে আমূল বদলে যায় পাভেল, কারণ সে শুনতে পেয়েছে বিপ্লবের ডাক। সে দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলতে পারে—‘শুধু একপেট খেতে পাওয়াটাই আমাদের সব নয়। আমাদের ঘাড়ের ওপর চেপে বসেছে যারা, যারা আমাদের চোখে ঠুলি এঁটে রেখেছে, তাদের দেখাতে হবে আমরা সব দেখতে পাচ্ছি।’ তাই পাভেলের কাছে সবচাইতে বড় হয়ে ওঠে পার্টি এবং বিপ্লব। সেই বিপ্লবী কাজে ব্যাঘাত ঘটবে বলে সে এমনকি সাশার প্রেমকেও গ্রহণ করতে রাজি নয়। জেলে যেতে হয় তাকে। সহযোদ্ধারা তার জেল-পালানোর সম্পূর্ণ বন্দোবস্ত করলেও সে তাতে রাজি হয় না। কারণ তার কাছে মনে হয়েছে যে জেল পালানোর চাইতে বিচারের আদালতে হাজির হয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরলে তা মানুষের কাছে পৌঁছবে বেশি করে, তাতে বরং বিপ্লবের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে বেশি। ফলে সে বিচার নামের প্রহসনের সম্মুখীন হয়, এবং অনিবার্যভাবেই তাকে সাইবেরিয়ায় যেতে হয় নির্বাসনের দণ্ড মাথায় নিয়ে। আদর্শের উজ্জ্বলতায় ঝলমলে চরিত্র পাভেলের। পাভেলের চরিত্রটি বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি তরুণের বুকে।

এই পটভূমিতেই লেখা হয় উপন্যাস—‘মা’।

When work is a pleasure, life is a joy! When work is a duty, life is slavery.

————Maxim Gorky 

তথ্য সংগৃহীত