![](https://www.leftsquad.in/wp-content/uploads/2023/05/ak-1024x512.jpg)
“এমন সময় আসবে যখন কবরের অভ্যন্তরে শায়িত আমাদের নিশ্চুপতা জ্বালাময়ী বক্তৃতার চেয়ে বাগ্ময় হবে এবং তা শ্রমিকশ্রেণির বিজয়লাভের শেষ সংগ্রাম পর্যন্ত লড়াই-এ প্রেরণা যোগাবে এবং শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।”
—-আগস্ট স্পাইজ
১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর। ফাঁসির মঞ্চে দাড়িয়ে শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা কথাগুলো বলেছিলেন। তার সেদিনের সেই ভবিষ্যদ্বাণী আজ অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছে। ব্যর্থ হয়নি তাদের এই আত্মদান। শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে তা এক স্মরণীয় অধ্যায়। ‘মে দিবস’ পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক দিবসে। মে দিবস, আজ তাই হাজার হাজার শ্রমিকের পায়ে চলা মিছিলের কথা। ‘একটি মাত্র সৈন্যবাহিনী’ হিসেবে একই পতাকা তলে দাঁড়িয়ে আপোসহীন সংগ্রামের কথা। মে দিবস দুনিয়ার শ্রমিকের এক হওয়ার ব্রত। আন্তর্জাতিক সংগ্রাম আর সৌভ্রাতৃত্বের দিন। মে দিবসের অর্থ শ্রমজীবী মানুষের উৎসবের দিন, জাগরণের গান, সংগ্রামে ঐক্য ও গভীর প্রেরণা। মে দিবস শোষণ মুক্তির অঙ্গীকার, ধনকুবেরের ত্রাস, সমাজতন্ত্র গড়ার নতুন শপথ ।
অথচ এই মে দিবস ছিল একদিন মে-রানীর রূপকথার অন্দরমহলে ঘুমিয়ে। আজকের সংগ্রামী তাৎপর্য ছিল তার অজানা। ইউরোপে দুর্জয় শীতের প্রথম তুষার গলতে শুরু করেছে। গাছে গাছে নতুন পাতা। দিকে দিকে ফুলের বাহার। পাখির গান। মাঠে-ঘাটে কর্মের জোয়ার। শীতবৃদ্ধ বিদায় নিয়েছে। এসেছে তরুণ বসন্ত। তখনই মে-রানীর ঘুম ভাঙত। ১লা মে হতো তার উৎসব। রোপণ করা হতো ‘মে বৃক্ষ’। তাকে সাজানো হতো বিচিত্র পুষ্পহারে। তারপর সেই মে-রানীকে ঘিরে শুরু হতো নাচগান উৎসব। কবিরা মে-রানীকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা। দেশের রাজারানী প্রজারাও মেতে উঠতেন উৎসবে। দিন বদলায়। বদলায় সমাজ-ব্যবস্থা। পাল্টে যায় শব্দের অর্থ। মে-রানী একদিন কোথায় হারিয়ে গেল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে মে দিবসের অর্থ গেল বদলে। মে দিবস হলো কাজের সময় হ্রাস ও মজুরি বৃদ্ধির এক আন্দোলন। হলো দুনিয়ার শ্রমিক সংহতি দিবস, পুঁজিবাদী শোষণ মুক্তির সংগ্রামী শপথ। শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলন থেকেই উঠে এসেছে এই দিনটি।
আন্দোলনের পথ কখনই মসৃণ ছিল না। মসৃণ থাকেও না, সময়ের নিয়মেই। ছিল নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে, জুলুম অত্যাচারে, প্রতিরোধে, ধর্মঘটে, মিছিলে, সংগ্রামী ঐক্যে রক্তলাঞ্ছিত। মে দিবস একদিনে এই আন্তর্জাতিক চেহারা পায়নি। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। রয়েছে অনেক রক্তঝরার কাহিনী। জন্মলগ্ন থেকেই শ্রমিকশ্রেণীর ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস। শ্রমিকশ্রেণীকে উদয়াস্ত কাজ করতে হবে। আঠারো ঘণ্টা, কুড়ি ঘণ্টা পর্যন্ত ছিল কাজের সময়-সীমা। আলোজাণ্ডার ট্রাকটেনবুর্গ মে দিবসের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘মে দিবসের জন্মকাহিনী অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে কাজের ঘন্টা কমাবার আন্দোলনের সঙ্গে। ‘ ১৮০৬ সালে কারখানায় কুড়ি ঘন্টা পর্যন্ত ছিল কাজের ঘন্টা বাধ্যতামূলক। ১৮২০-১৮৪০ সাল পর্যন্ত দশ ঘন্টা কাজের দাবিতে অনেক আন্দোলন ও ধর্মঘট হয়। ১৮৬২-৬৩ সালে গড়ে ওঠে ইউনিয়নের রাজনৈতিক ভিত্তি। দাসপ্রথা উঠে গেল। গৃহযুদ্ধে অচ্ছুত নিগ্রোরা হল শ্বেতাঙ্গদের বন্ধু। এই সময়ে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মালিকরা কম মজুরিতে নারী শ্রমিক নিয়োগ করত। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের পর থেকেই সেখানকার শিল্পের বিকাশ ঘটে দ্রুততার সাথে। সেই সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনের প্রসারও ঘটে দ্রুত। ১৮৮১ সালের নভেম্বরে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার’। সেখানে ১৮৮৪ সালের ৭ই অক্টোবর-এর চতুর্থ সম্মেলনে গৃহীত হলো ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। বলা হলো, ১৮৮৬ সালের ১লা মে থেকে আট ঘন্টাকেই কাজের দিন বলে আইনত গণ্য করতে হবে।
তারপর চলল- প্রচার, প্রস্তুতি। অবশ্য ১৮৬৪ সাল থেকেই আটঘন্টার কাজের দাবিতে শ্রমিকশ্রেণী ছিল মুখর। দিকে দিকে “আটঘন্টার শ্রম-সমিতি” গড়ে উঠতে লাগল। ১৮৬৮ সালে আমেরিকার আইন সভা “আটঘন্টার কাজ” বলে একটা আইনও পাস করল। কিন্তু কার্যকরী হলো না সেই আইন। কার্ল মার্ক্স স্বাগত জানালেন এই আন্দোলনকে। ১৮৮৫ সালে ব্যাপকতর হলো এই আন্দোলন। শুরু হলো চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি। ধর্মঘটের পর ধর্মঘট। মিছিলের পর মিছিল। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল সংগ্রামের ডাক। শ্রমিক শ্রেণী সসংকল্পবদ্ধ হল। ১৮৮৬-র ১লা মে থেকে কেউ আটঘণ্টার বেশি কাজ করবে না। এলো সেই ঐতিহাসিক দিন। ১৮৮৬ সালের ১লা মে। পাঁচলক্ষ শ্রমিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে প্রত্যক্ষভাবে ধর্মঘটে যোগ দিলেন। শাসকদল এই ঐক্যবদ্ধ সুবিশাল শ্রমিক সমাবেশ ও ধর্মঘট দেখে পিছিয়ে গেল। ৩রা যে। ম্যাককর্মিক হার্ভেস্টার কারখানায় হলো নির্মম পুলিশী আক্রমণ। প্রাণ হারালেন ছজন নিরস্ত্র শ্রমিক। এর পরের দিন। ৪ঠা মে। “হে মার্কেট স্কোয়ার।” সুবিশাল প্রতিবাদ সভা। পুলিশ গুলি চালাল। শহীদের রক্তে রঞ্জিত হলো হাতের নিশান। গ্রেপ্তার করা হলো চারজন শ্রমিক নেতাকে। বিচারের নামে হলো বিচারের প্রহসন। জারী হলো ফাঁসির আদেশ। এঁরা হলেন আগস্ট স্পাইজ, পার্সনস, ফিসার ও এঞ্জেল। প্রতিবাদের ঝড় উঠল। সভা শোভাযাত্রায় ধিকারবাণী উচ্চারিত হলো। ধ্বনিত হলো শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের কণ্ঠ। প্রতিবাদ জানালেন জর্জ বার্নাডশ, মার্ক্সের কন্যা এলেনর মার্ক্স। দেশকালের গণ্ডী পেরিয়ে এই নৃশংস বর্বরতার খবর পৌঁছলো দুনিয়ার মেহনতী শ্রমজীবীর কানে। ১৮৮৯ সালের ১৪ই জুলাই। ফরাসী বিপ্লবের কেন্দ্রস্থল প্যারিস। বাস্তিল পতনের শতবার্ষিকী। এই দিনেই প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সম্মেলন। প্রথম দিনের অধিবেশনেই সর্বসম্মত প্রস্তাব ১৮৯০ সাল থেকে ১লা মে প্রতিবছর শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিক সংহতি, সৌভ্রাতৃত্ব ও সংগ্রামের দিন বলে ঘোষিত হলো। এভাবেই ১৮৮৬ সালের “ঐতিহাসিক মে দিবস” রূপান্তরিত হয় ১৮৯০ সালের আন্তর্জাতিক মে দিবসে।
প্যারিস সম্মেলনে ঘোষণার পর থেকেই দেশে দেশে মে দিবস পালিত হয়। ১৮৯০ সালে গ্রেট বৃটেনে ১লা মে’র পরিবর্তে ৪ঠা মে হাইড পার্কে লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে প্রথম আন্তর্জাতিক মে-দিবস উদযাপিত হয়। আমেরিকায় ১৮৯০ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক মে দিবস উদযাপিত হয়। আমেরিকায় ১৮৯০ সালে আন্তর্জাতিক মে দিবস পালিত হয় আটঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘটের মাধ্যমে। ফ্রান্সে মিছিল ও সমাবেশের মধ্যেদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে মে-ডে পালিত হয় ১৮৯০ সালে। জার শাসিত রাশিয়ায় ১৮৯৬ সালে মে দিবস উদযাপিত হয় ধর্মঘটের ভেতর দিয়ে। চীনে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৪ সালে। ডাঃ সান্ ইয়াৎ সেন ওই সমাবেশে ভাষণ দেন। হিটলালের উত্থানের শুরুতে ১৯৩৩ সালে জার্মানীতে কমিউনিস্টরা বেহাইনী মে দিবস উদযাপন করেছিলেন। ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ সিঙ্গারভেলু চেট্টিয়ারের উদ্যোগে মাদ্রাজে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৩ সালে। আজ এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ল্যাটিন আমেরিকা, ছোট বড় সমস্ত দেশ জুড়ে মে দিবস পালিত হচ্ছে।
মে দিবস হলো দুনিয়ার মেহনতী মানুষের সঙ্কল্প গ্রহণের দিন। এই সঙ্কল্প হলো সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শ্রেণী বৈষম্যের বিলোপসাধন। পুঁজিবাদী দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্তির দৃঢ় অঙ্গীকার। মে দিবস শ্রমিক শ্রেণীর চিন্তা-চেতনায় এনেছে এক বৈপ্লবিক তাৎপর্য। লেনিন মে দিবসকে ব্যবহার করেছিলেন শ্রমিক শ্রেণীর বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের বলিষ্ঠ হাতিয়ার হিসেবে। তারই সার্থক পরিণতি ১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লবে। মে দিবস দুনিয়া জুড়ে শ্রমিক আন্দোলন ও মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ চক্রান্তের তীব্র প্রতিবাদ, দুনিয়ার শ্রমিক এক হওয়ার উজ্জীবন মন্ত্র।
১৮৮৬ সালের ঐতিহাসিক মে দিবসের শতবর্ষ শেষ হয়েছে। ১৮৯০ সালের আন্তর্জাতিক মে দিবসের শতবার্ষিকীও এসেছে। মে দিবসের এই দীর্ঘ শতবর্ষের আলোয় অনেক অন্ধকারও দূর হয়েছে। সংগ্রামী শ্রেণীর সামনে উন্মোচিত হয়েছিল নতুন দিগন্ত। দৃঢ় হয়েছিল শ্রমিক সংহতি। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষকেও দেখতে পাওয়া গেছে বর্তমানেও রয়েছে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। কিন্তু এখনও জনসংখ্যার বৃহৎ অংশ পুঁজিবাদী দাসত্ব থেকে মুক্ত নয়। মুক্ত নয় সামন্ততান্ত্রিক শোষণ থেকে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আজও প্রবল, পরাক্রান্ত। এখনও তার নির্লজ্জ রণ-হুংকার কিন্তু থামেনি। তাই দুনিয়া জুড়ে মে দিবসের যে বিজয় অভিযান, সেখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে সমাজতন্ত্রের সপক্ষে ও পুঁজিবাদ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর বৈপ্লবিক সংগ্রাম। এই সংগ্রামী চেতনা ও চরিত্রই আজ শ্রমজীবীর ভূষণ। মে দিবস আজ আর শ্রমিকের কাজের ঘন্টা কমানোর দাবির আন্দোলন নয়।
মে দিবস আজ দুনিয়ার মেহনতী মানুষের সংগ্রামের দিন, সৌভ্রাতৃত্বের দিন। সমাজতন্ত্র কায়েম করার শপথ গ্রহণের দিন। মে দিবস এখন শ্রমিকশ্রেণীর সামনে নতুন উষার স্বর্ণ দুয়ার। অনেক রক্তের বিনিময়ে পাওয়া দুর্লভ এক সম্পদ আমাদের মে দিবস….
যাকে বাচিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ আমাদের প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষের দায়িত্ব।