কৃষিকাজে যুক্ত পুরুষদের ঋণের দায়ে আত্মহত্যার ঘটনা গত তিন দশক ধরেই ভারতবর্ষে পরিচিত কাহিনিতে পরিণত হয়েছে। ২০১১ সালের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গেও একই ছবি দেখা যাচ্ছে, যদিও তার পরিসংখ্যান ফাঁকিবাজির সাহায্যে লুকিয়ে রাখা হয়।কিন্তু ঋণের দায়ে গ্রামের মেয়েরা কীটনাশক খাচ্ছেন বা গলায় দড়ি দিচ্ছেন? হ্যাঁ, আমাদের এই ‘মুক্ত’ অর্থনীতিতে এমন ঘটনাও এখন ঘটছে। সে ঋণের পাওনাদার মানুষের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে-যাওয়া ক্ষুদ্র ঋণসংস্থাগুলি। স্বনামধন্য ‘বন্ধন ব্যাংক’ ব্যাংক-নামে ভূষিত হবার আগে পর্যন্ত তাদের অগ্রগণ্য ছিল। বিগত দশক জুড়ে এমন অজস্র ‘বন্ধন’ রক্ত চোষার বিপুল মওকা পেয়ে গ্রাম শহরে নানা অবতারে গরিব মানুষকে ঋণ দেবার ব্যাবসায় নেমে পড়েছে।


কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার এবং খোদ রিজার্ভ ব্যাংক আজ প্রত্যক্ষে পরোক্ষে ঋণদানের নীতিবদলের মাধ্যমে এই শোষণের সুযোগ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। HDFCর মতো বেসরকারি অর্থপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত corporate social responsibilityর ছল করে ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে নেমে পড়েছে, নিঃস্ব মানুষের থেকে সংগৃহীত সঞ্চয়কে লাগাচ্ছে গাড়ি বা বাড়িকেনার ঋণদানের কাজে। কৃষিঋণে ভাগ বসাচ্ছে কৃষক নয়, কর্পোরেট। কোথাও আবার এমনও দেখা যাচ্ছে যে স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে সংঘবদ্ধ মেয়েরা এসব রক্তচোষাদের এলাকা থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে। মেয়েরা কেন এই ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে? কীধরনের শোষণ চলছে তাদের ওপর? এর প্রতিকার কি কিছুই নেই? এসব নিয়ে একটি আলোচনা গত ১৭ জুলাই কলকাতায় অনুষ্ঠিত হল। উপস্থিত ছিলেন হাওড়া এবং হুগলি জেলা থেকে আরতি কুণ্ডু, রুষা মজুমদার, জ্যোস্না সাঁতরা, আসমা বেগম, মাসুদা বেগম, রেখা মণ্ডল, পদ্মাবতী সাঁতরা, সাজদা বেগম এবং আরো কিছু মেয়ে, ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার খাতক হবার জ্বালা যাঁরা নিজেরা অনুভব করেছেন। উপস্থিত ছিলেন NABARDএর সারা ভারত কর্মচারী সংগঠনের সাধারণ সচিব রাণা মিত্র, হুগলির রাজনৈতিক কর্মী মৃণ্ময় সেনগুপ্ত, খেতমজুর সংগঠনের নেতা তুষার ঘোষ, আইনি অধিকারের বহু লড়াইয়ের যোদ্ধা শামিম আহমেদ। ছোট্ট একটি সামাজিক সংগঠন পুনর্নবা কলকাতার উদ্যোগে আলোচনাটি পরিচালিত হয়।


মেয়েরা ঋণ নেন কেন? এর সোজাসাপটা উত্তর এসেছে ‘সংসার চালানোর জন্য’, ‘কাজ নেই বলে’, ‘কাজ করেও যথেষ্ট উপার্জন করা যাচ্ছে না বলে’। বিশেষ করে আকস্মিক লকডাউনের পর্ব থেকে মানুষের কাজ মিলছে না, অনেকের বাড়িতে পুরুষদের কাজ চলে গেছে, যে মেয়েরা দর্জির কাজ করেন তাঁরা মাল পাচ্ছেন না, জিনিষ তৈরি করলেও বিক্রি করা যাচ্ছে না, যাঁরা দোকানে অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজ করেন, তাঁদের সংগৃহীত জিনিষ বাড়িতে বা দোকানে পড়ে থাকছে। উৎপাদন করেও লোকসানের ভাগী হচ্ছেন মেয়েরা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কাউকে স্থায়ী চাকরি না দেবার, খালি পদগুলিকেও ভর্তি না করার সরকারি নীতি, অস্থায়ী অনিশ্চিত কাজ ছাড়া মানুষের গতি নেই, দুদিন অসুস্থ হলে ঘরে খাবার সংস্থান নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিষের বেলাগাম মূল্যবৃদ্ধিও তো সরকারি নীতিরই অংশ।
আবার এই অর্থনীতির রাজনৈতিক দিকটি হল ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ জাতীয় প্রকল্প, সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি থেকে টাকা সরিয়ে যেসবের জন্য সম্পদসংস্থান করা হয়েছে, ৫০০/ ১০০০ নগদ টাকার প্রাপক কিছু উপভোক্তা তৈরি করতে; অন্য আয় না থাকায় সেটুকু পেলেই তারা বর্তে যাবে, তৈরি হবে শাসকদলের বাহিনীও যারা দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে সেই কৃতজ্ঞতাবোধের ফায়দা তুলবে। এভাবে মানুষের অধিকার সম্বন্ধে ধারণাও নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে।পুরো ব্যবস্থাই গরিব-মারার কাজে নিয়োজিত।
ঋণদানকারী সংস্থার সমাগমঃ আগে যে সরকারি ব্যাংক, সমবায় ব্যাংক, গ্রামীণ ব্যাংক ইত্যাদি টাকার অভাবে টাকা জোগাতে কিছুটা হলেও এগিয়ে আসত তাদের কাছে যাওয়াও যখন দুষ্কর হয়ে উঠছে, তখন স্বভাবতই টাকার থলি নিয়ে যে ক্ষুদ্রঋণসংস্থাগুলি গরিব মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে এবং সহজ ঋণের গল্প শোনাচ্ছে তাদেরই আপনজন বলে মনে করা হচ্ছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কোন্‌টা প্রয়োজনীয়, কোন্‌টা ছাড়াও চলা যায় তারও নতুন বয়ান তৈরি করছে এই ব্যবস্থা। এন্ড্রয়েড মোবাইল না থাকলে বাচ্চার স্কুলের পড়া তৈরি হচ্ছে না। মেয়ের বিয়েতে পাত্রের খাঁই মেটাতে, ছেলের কাজে যাবার সুবিধার জন্য মোটরবাইক কিনতে বা একটি ভালো টিভি সেট কিনতে ঋণ পাওয়া যদি এত সহজ হয়ে যায় তাহলে গরিব মানুষের জীবনেও এসব আর অপ্রয়োজনীয় থাকে না, বরং দৈনন্দিনের অসহনীয় চাপ এসব কিনে ফেলতে পারলে কিছুটা কমবে এই স্বপ্ন সে দেখে, সেটা তার পক্ষে অন্যায্য নয়। এই স্বপ্নপূরণের আশা দিয়ে তাকে ঋণ নিতে প্ররোচিত করা হচ্ছে, কিন্তু তারপরেও তার জীবনধারার কোনো উন্নতি ঘটছে না।


নব্বইয়ের দশকে IMFএর নির্দেশে বড়ো ব্যাংকগুলির আওতার বাইরে ‘বিকল্প ব্যাংকিং চ্যানেল তৈরি’র বিষয়টি আমাদের অর্থনীতিতে আসে। কিন্তু সেসময়ে গরিব মানুষকে কিছুটা সুরক্ষা দেবার জন্য, তারা ঋণ নিলেও যাতে জীবনধারণের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি তার কিছুটা সঞ্চয় করে উৎপাদনমূলক কাজ বা সম্পদসৃষ্টির কাজে লাগাতে পারে তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। NABARD (National Bank for Agricultural and Rural Development) এক বিরাট ভূমিকা নেয় বিকল্প ব্যাংকিং-এর সঙ্গে সরকারি ব্যাংক, সমবায় ব্যাংক ও গ্রামীণ ব্যাংকগুলির উদ্যোগকে যুক্ত করে ঋণের কিছু নিয়ম বেঁধে দিতে। স্বর্ণজয়ন্তী স্বরোজগার যোজনাতে মেয়েদের নিয়ে অনেক স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি হয়, তাঁদের আয় এবং সঞ্চয় বাড়ানোর লক্ষ্যে।
পশ্চিমবঙ্গে সমবায় ব্যাংককে ব্যবহার করে যে গোষ্ঠীগুলি তৈরি হয় ‘সমবায়ের মধ্যে সমবায়’ এই স্লোগান নিয়ে, তা সারাদেশের কাছে মডেল হয়ে দাঁড়ায়। কেরালাতে প্রভূত সাফল্য পায় ‘কুডুম্বশ্রী’ প্রকল্প। নিজেদের যৌথ আমানত থেকে নিজেরা ঋণ নেওয়া এবং নিয়ম অনুযায়ী ফেরত দেওয়ার রীতি রক্তচোষা ক্ষুদ্রঋণদাতা সংস্থাগুলিকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। গরিবের ক্ষেত্রে ঋণশোধের প্রবণতা ধনীদের চাইতে বেশি এইসব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে এই কথাটি স্পষ্ট হয়েছে।বর্তমানে সারা দেশে ১ কোটি স্বনির্ভর গোষ্ঠী আছে, ২০২০র হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকে যাদের সঞ্চিত সম্পদের পরিমাণ ২৬ হাজার ১৫২ কোটি টাকা।


কিন্তু সাধারণ মানুষের এই আমানত করার ক্ষমতা রক্তচোষাদের লোভকে আরো চাগিয়ে তোলে। ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলি একুশ শতকের গোড়া থেকে ‘বিকল্প ঋণ’ নিয়ে গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে ঢোকা শুরু করে। তার ফলে ২০১১ সালের মধ্যে এই ধরনের সংস্থাগুলির চাপে অন্ধ্রপ্রদেশে এবং অন্যত্র স্বনির্ভর গোষ্ঠীর বহু মহিলা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। মেয়েদের আন্দোলনের ফলে রিজার্ভ ব্যাংক এদের দাপট কমানোর জন্য তখন কিছু নির্দেশিকা জারি করে। নির্দিষ্টহারে তাদের সুদের সীমানা বেঁধে দেওয়া হয়। গোষ্ঠীগুলিকে উৎপাদনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত করার শর্ত ঋণদানের সঙ্গে আবশ্যিক করা হয়। তার জন্য প্রশিক্ষণ ও বিক্রয়ব্যবস্থার নানা উদ্যোগও নেওয়া হয়।
বর্তমানে কিন্তু রিজার্ভ ব্যাংকই পুনরায় তার নিয়মগুলিকে শিথিল করতে শুরু করেছে। সুদের সীমানা কী হবে তা ঋণদাতা সংস্থাগুলির ওপরেই ছেড়ে দিতে চাইছে; এছাড়া ঋণ পাবার জন্য সম্পদসৃষ্টির কাজে যুক্ত হবার যে শর্ত ছিল তার গুরুত্বকেও কমিয়ে দিচ্ছে। এমনকী নাবার্ড যে লক্ষ্য নিয়ে তৈরি হয়েছিল তাতেও জল মিশিয়ে তার গরিবের কাছে পৌঁছে যাবার ক্ষমতা কমিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে। যেসব সংস্থা যেনতেনপ্রকারেণ ঋণ দিয়ে এবং সুদ আদায় করেই ফুলে ফেঁপে ওঠে তাদের দাপট সেকারণে ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। কোভিডকালে রিজার্ভ ব্যাংক ঋণশোধ মুলতুবি রাখার যে নির্দেশ দিয়েছিল ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে-ওঠা এই সংস্থাগুলি তাও মানছে না। হুগলি থেকে যে মেয়েরা এসেছিলেন তাঁদের একজনের স্বামী কৃষিঋণ নিয়ে শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। হাওড়াতেও একটি ব্লক থেকেই তিন মহিলার ক্ষুদ্রঋণসংস্থার চাপে আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেল। মৃত্যুমিছিল আবার শুরু হয়েছে।


পশ্চিমবঙ্গ বর্তমানে সারাদেশের মধ্যে বেকারির হারে সবচেয়ে এগিয়ে-থাকা রাজ্যগুলির অন্যতম। সমবায় ব্যাংকগুলি মেয়েদের স্বনির্ভরতায় যে সহায়তা করছিল তার পরিকাঠামো বর্তমান সরকারের নির্লজ্জ ঔদাসীন্য বা বেনিয়মি হস্তক্ষেপে ভেঙে পড়ছে। গ্রামে ঢুকে নানা নামের ঋণদান সংস্থাগুলি একজন মেয়েকে ধরে তাকে বলছে সাত-আটজনকে নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরি করতে এবং এইভাবে একত্রে অনেক মেয়েকে তাদের ফাঁদের মধ্যে টেনে নিচ্ছে। গোষ্ঠীর নামে নাবার্ডের টাকা আসছে পঞ্চায়েতের কাছে। মেয়েরা ঋণ নিতে না চাইলেও তাদের বাধ্য করা হচ্ছে ঋণ নিতে। নিয়ম ভেঙে চুক্তি বা ফ্যাক্‌টশীট লেখাপড়া হচ্ছে ইংরেজিতে, অনেক সময়ে মেয়েরা জানতেই পারছেন না কী শর্তে তাঁরা ঋণ নিচ্ছেন। দুটির বেশি সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়া যাবে না এই শর্তটিও গ্রাহ্য করা হচ্ছে না। ফলে এক জায়গার ঋণশোধ করতে আরো দুতিন জায়গায় ঋণ করায় বাধা নেই। এমনকী দেখা যাচ্ছে ঋণদাতা সংস্থাটিই বলছে, আগের টাকা শোধ হয়নি তাতে কী হয়েছে? আমি তোমাকে আরো ঋণ দিচ্ছি। ফলে খাতক এক ঋণের বোঝা ঘাড় থেকে নামার আগেই আরেক ঋণের ফাঁদে ফেঁসে যাচ্ছে এবং সুদ দিতে দিতে আসলের হিসাব হারিয়ে ফেলছে।


প্রতিকারের প্রসঙ্গঃ দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্র ঋণসংস্থাগুলির দাপটের পিছনে রয়েছে আরো অনেক বড়ো শক্তি, এমন এক সরকার, এমন এক অর্থব্যবস্থা যা গরিবের রক্ত শুষে বেসরকারি পুঁজির ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যই তৈরি। জাতীয় ব্যাংক এবং নাবার্ডের মতো অর্থপ্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করাতে তাই তাদের এত আগ্রহ। অমিত শাহের সমবায়মন্ত্রীর পদ দখল করাতে এই ইঙ্গিতও রয়েছে যে সমবায়গুলিকে পর্যন্ত তারা নিজস্ব স্বার্থে পুনর্গঠন করার লক্ষ্যে এগোচ্ছে।


এই পরিস্থিতিতে প্রতিকার কোন্‌ পথে? কেউ বলছেন, ঋণের চাহিদা মানুষের মধ্যে রয়েছে, তাই তেমন প্রতিবাদ হচ্ছে না। যে মেয়েরা এসেছিলেন তাঁরা কিন্তু সকলেই মনে করছেন এর থেকে রেহাইয়ের পথ চাই। রাণা মিত্র বললেন, প্রতিবাদই যথেষ্ট নয়, চাই প্রতিরোধ। প্রতিরোধ বলতে কী বোঝায়? শামিম আহমেদ বললেন, এখনো আইনে যেটুকু সুরক্ষার কথা আছে সে অনুযায়ী মেয়েদের বলতে হবে, আমরা টাকা দেব না।
সাধারণ মানুষ ঋণশোধ করাটাকেই তো স্বাভাবিক মনে করে; তাছাড়া এই ভয়টাও থাকে যে এদের তাড়িয়ে দিলে প্রয়োজনে কোথায় টাকা পাব? ‘টাকা দেব না’ কথাটা রুখে দাঁড়িয়ে বলতে পারার যুক্তিটা এইখানে যে তুমি যা নিচ্ছ তা ন্যায্য নয়, তুমি আমাদের ঠকিয়ে টাকা নিচ্ছ। এই যুক্তিতে রুখে দাঁড়ালে এরাও তখন নিজেদের ব্যাবসার খাতিরেই রক্ত চোষার মাত্রা কমাতে বাধ্য হবে। এটাই প্রতিরোধ। কিন্তু এটা একা একটি মেয়ের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এরা যেমন কিছু মেয়েকে একসঙ্গে ঋণ দিয়ে তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও অবিশ্বাস উশকে দিচ্ছে, তাকে কাটিয়ে মেয়েরা একজোট হতে পারলে তবেই এ প্রতিরোধ সম্ভব।


এর জন্য আইনটাও ভালোভাবে জানা দরকার। এপ্রসঙ্গে কিছু অত্যন্ত জরুরি হদিশ দিলেন মৃণ্ময় সেনগুপ্তও। কোনো জিনিষ বন্ধক রেখে ঋণ দিতে পারে না এই সংস্থাগুলি। ঋণের দায়ে বাড়ি বা অন্য সম্পত্তি ক্রোক করে নিতে পারে না তারা। তাহলে সুদ আদায় করতে বাড়িতে আসবে কেন? লেনদেনের বিষয় এজেন্সির অফিস থেকে হোক। টাকা আদায়ের নামে বাড়িতে যখনতখন ঢুকে পড়া চলবে না। তাছাড়া চুক্তি বা ফ্যাকটশীট তৈরি হবে বাংলা, হিন্দি, উর্দু বা নেপালি যেভাষা খাতক বোঝেন তাতে। সমস্ত শর্ত না বুঝে সই করব না, এও আইনসঙ্গত দাবি। চুক্তিতে বীমার কথা থাকলে ক্ষয়ক্ষতি বা মৃত্যুর ক্ষেত্রে চাই ন্যায্য ক্ষতিপূরণ। সুদের টাকা চাইতে বাড়িতে আসছ, বীমার টাকা দেওয়ার বেলায় পালাচ্ছ, তা চলবে না, এও প্রতিরোধ। হুগলি ও শিলিগুড়িতে, যেখানে অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়েছে মেয়েরা রক্তচোষাদের গ্রাম থেকে তাড়াতে তো পেরেছেন। নদিয়াতে গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির উদ্যোগে মহিলা ঋণদান সমিতি নিজেদের সঞ্চয় থেকে স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলিকে ঋণদান করছে, সেখানে ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থাগুলি ঢুকতেই পারছে না এখনও।


জোট বাঁধার আরেকটি আবশ্যিক পথ সমবায়গুলিকে রক্ষা করা, সেখানে নিয়মমাফিক নির্বাচন যাতে হয় তা সুনিশ্চিত করা এবং যেখানে সম্ভব রেজিস্টার্ড গ্রুপহিসাবে নাবার্ডের ঋণের সাহায্য নিয়ে সমবায় তৈরি করা। সমস্ত শক্তি যেখানে প্রতিকূল এটা নিশ্চয়ই সহজ কাজ নয়। আইনি জ্ঞান থাকলেই চলবে না, আইনি সহায়তাও চাই। উৎপাদনভিত্তিক সমবায় গড়তে হলে চাই কাঁচামালের জোগান, প্রশিক্ষণ এবং বিক্রি করার জায়গা। এগুলো কুড়িপঁচিশ বছর আগেও সহজ ছিল না, তখন সরকারি আনুকূল্য অনেক বেশি থাকাসত্ত্বেও। তাছাড়া সমবায়ের মানসিকতা ছাড়া সমবায় হয় না, তাকে বিকশিত করে তুলতে হয়। আজকের সামাজিক প্রবণতা সমবায়ের উল্টোমুখেই বলা চলে। কিন্তু এর বিকল্প আর কিছু নেই। আদৌ এদিকে এগোবার চেষ্টা না করলে প্রতিপদেই জীবনযুদ্ধে লড়তে গিয়ে ডুবতে হবে আরো অসহায়তার গহ্বরে। অন্যদিকে সমবায়ের অভিজ্ঞতা গড়ে তুলতে পারলে সেই প্রচেষ্টা যদি ব্যর্থও হয়, তবু ব্যর্থতার যারা কারণস্বরূপ তাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত ক্রোধও অত্যাচারিতের মনে জাগানো সম্ভব হতে পারে।