মিজোরামে দুর্ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু আবার গ্রামের খেটে খাওয়া গরীব মানুষের প্রতি রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের কঠিন উদাসীনতার বাস্তব চিত্র সামনে এনে দিল। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার,বার্ধক্যভাতা,বিধবা ভাতা,কন্যাশ্রী যুবশ্রী ইত্যাদি সরকারি ভাতা যে কোনোভাবেই স্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগের বিকল্প নয় তা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ঠিকাদারের অধীনে দৈনিক মজুরিতে বিভিন্ন কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে এই রাজ্যের বাসিন্দাদের বৃহৎ সংখ্যার উপস্থিতি বুঝিয়ে দেয়, নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে কাজ না পেয়ে অসংখ্য গরীব মানুষ খাবার যোগাড় করতে ভিনরাজ্যে চলে গিয়েছেন এবং দিন যত এগোচ্ছে,কাজের সুযোগ তত কমছে, বড়ো সংখ্যার মানুষ ভিন রাজ্যে কাজ খুঁজতে যাচ্ছেন। বাইরে গিয়ে রোজগারের চেষ্টা করতে যাওয়ার মধ্যে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার চেয়ে দারিদ্র্যের কারণে পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতার টান বেশি। মালদা,মুর্শিদাবাদ,বীরভূম,দুই চব্বিশ পরগনার অনেক নাবালক অভাবের তাড়নায় পড়াশুনা মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে ভিনরাজ্যে দৈনিক মজুরিতে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে চলে যায়।
২৩ শে আগষ্ট বুধবার সকালে মিজোরাম রাজ্যে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। নির্মীয়মান রেল সেতু ভেঙে মালদার ২৪জন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যুর খবর মেলে। এরমধ্যে ১৬জনই রয়েছে রতুয়া-২নং ব্লকের। রতুয়া-২নং ব্লকের ১৬জন মৃত পরিযায়ী শ্রমিকের মধ্যে শুধুমাত্র পুখুরিয়ার চৌদুয়ার গ্রামেই রয়েছেন ১৪জন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এই মৃত ব্যক্তিদের নিয়ে শোকজ্ঞাপন ও ক্ষতিপূরণের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন স্বয়ং রাজ্যপাল সহ কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই শাসকদল। রেল দপ্তরের পক্ষ থেকে তদন্তের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করেই পাহাড়ী এলাকায় শ্রমিকদের রেলসেতুর বানানোর কাজ করানো হচ্ছিল – সে বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য না করে সংবাদমাধ্যমে রেলওয়ের ক্ষতিপূরণের দশ লক্ষ টাকার অঙ্ক বারংবার তুলে আনা হয়েছে বিশেষত গত ২৫শে আগষ্ট শুক্রবার শ্রমিকদের অসহায় পরিবারবর্গের সঙ্গে দেখা করতে মালদায় আসেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। তিনি মালদায় এসে মৃত পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি যান। তাদেঁর পরিবারবর্গের হাতে রেলের তরফে দশ লক্ষ টাকার আর্থিক অনুদানের চেক তুলে দেন। এরপর রাতের দিকে তিনি মালদা ছেড়ে কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সেদিনই সন্ধ্যা নাগাদ মৃত ২৩জন শ্রমিকের মধ্যে ১৮জনের নিথর দেহ মালদায় এসে পৌঁছায়। এবং বাকি ৫জনের মধ্যে ৪জনের নিথর দেহ আসে শনিবার দুপুরে। আর এই সমস্ত মৃতদেহ পরিবারবর্গের হাতে তুলে দেওয়ার প্রাক্কালে রাজ্যের সেচ প্রতিমন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন রাজ্যপালের কড়া সমালোচনা করেন। তাঁর বক্তব্য,রাজ্যপালের এই আচরণ পদ্মপাল অর্থাৎ বিজেপির প্রতিনিধির মতো। সেচ প্রতিমন্ত্রীর অভিযোগ মৃত শ্রমিকদের দেহ পাঠানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট হেলাফেলা করেছে এন এফ রেলওয়ে। মৃতদেহ গুলির সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। রাজ্যসরকারই উদ্যোগ নিয়ে শববাহী গাড়িতে মৃত শ্রমিকদের বাড়িতে মৃতদেহগুলি পৌঁছনোর ব্যবস্থা করেন। প্রতিক্রিয়া দিতে দেরি করেন নি বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও তিনি কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করতে রাজ্যসরকারের ব্যর্থতা এবং এনরেগার কাজে জবকার্ডের দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলে অভিযোগ করেন তৃণমূল তথা জেলা প্রশাসন নাকি পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃতদেহ দখলের রাজনীতি করেছে। কিন্তু দু বছর কোভিডের সময় যখন পরিযায়ী শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও জীবন বিপন্ন তখন কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম দপ্তরে পরিযায়ী শ্রমিকদের তথ্য না থাকার যে অভিযোগ উঠেছিল সেই অভিযোগ আজও উঠছে। শুধু তাই নয় পরিযায়ী শ্রমিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন নীতি এখনো কেন্দ্রের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি। গরীব কল্যাণ যোজনা, প্রধানমন্ত্রী স্বনিধি প্রকল্প এবং আত্মনির্ভর ভারত প্রকল্পের গালভরা নাম বেশিরভাগ পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজে আসেনি। অসংগঠিত শ্রমিকদের মধ্য থেকে নিজের রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে ঠিকা শ্রমিকের কাজ করতে যাওয়া ব্যক্তিদের পৃথকভাবে চিহ্নিত করে জীবন জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মত কোন ভাবনাচিন্তার প্রতিফলন কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি আয়োগের প্রস্তাবে দেখা যায় নি।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিককল্যাণ পর্ষদের ভূমিকাও হতাশাজনক । এমনিতেই একশো দিনের কাজ বন্ধ হলে রাজ্যে
কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের তথ্য রাখার ব্যবস্থা নেই পর্ষদে। বেশিরভাগ শ্রমিক ঠিকাদারের অধীনে কাজ করেন। ঠিকাদারি সংস্থার কর্তৃপক্ষ তাঁদের অধীনে কাজ করা ভিনরাজ্যের শ্রমিকদের বিষয়ে তথ্য প্রশাসনের কাছে দেন না। ফলত কোন দুর্ঘটনা ঘটলে শ্রমিকদের বাসস্থান ,পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।নিহত শ্রমিকদের দেহ পাঠানোর ব্যবস্থা করতে বেশি সময় লেগে যায়। মিজোরামে দুর্ঘটনায় নিহত মালদার শ্রমিকদের বাড়িতে গিয়ে গত ২৬শে আগষ্ট শনিবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম নিহতদের পরিবারের হাতে ক্ষতিপূরণের চেক তুলে দেওয়ার সময় রাজ্যপাল এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনার বাইরে বিশেষ কিছুই বলেন নি। লকডাউনের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের সহায়তা করে সংবাদ শিরোনামে উঠে আসা সমাজকর্মী সামিরুল ইসলাম এখন রাজ্যসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ এবং পরিযায়ী শ্রমিককল্যাণ পর্ষদের চেয়ারম্যান। তিনি বলেছেন,আগেও এই ধরণের মৃত্যুর ঘটনা ঘটত কিন্তু এখন মৃতদেহ ফেরানোর জটিলতা কিছুটা কমেছে । গ্রামের গরিব মানুষদের পরিযায়ী শ্রমিক হওয়া আটকানোর জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগের প্রসঙ্গে কেবল ব্যবসার জন্য কম সুদে ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বেশি কিছুই সামিরুল ইসলাম বলতে পারেন নি। এইমুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে “লাভজনক” শিল্প বেআইনি বাজি কারখানা। যেখানে প্রতি মুহূর্তেই দৈনিক সামান্য মজুরিতে কাজ করা গরিব মানুষের প্রাণহানির ঝুঁকি থাকে । এভাবেই শাঁখের করাতে রক্তাক্ত হচ্ছেন পরিযায়ী শ্রমিক হতে বাধ্য হওয়া গ্রামবাংলার গরিব মানুষ।