“কৃষি জমির অধিকার = সিঙ্গুর গণ আন্দোলন”। এই অধ্যায়টি অষ্টম শ্রেণীর অতীত ও ঐতিহ্য (ইতিহাস) পাঠ্য পুস্তকে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। প্রথম পর্বে লিখেছিলাম শিশু -কিশোরদের পড়ানো হচ্ছে মিথ্যাচারের কল্পকাহিনী। কল্পকাহিনী কেন তারই বিশ্লেষণ কিছু সত্য ও তথ্য এই প্রবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। পাঠ্যপুস্তকের  প্রকাশক সুব্রত ঘোষ ,সচিব ,পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ৭৭ /২  পার্ক স্ট্রিট ,কলকাতা ৭ ০০০১৬,প্রথম সংস্করণ ২০১৩। পাঠ্যপুস্তকের ভূমিকা লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের তৎকালীন সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়। ভূমিকার প্রথম লাইন,” পরিবেশ ও ইতিহাস পর্যায়ভুক্ত অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক “অতীত ও ঐতিহ্য “প্রকাশিত হলো। পরিমার্জিত নবম সংস্করণ ডিসেম্বর ২০২১।

এই সংস্করণে ভূমিকা লিখেছেন অভীক মজুমদার, চেয়ারম্যান, বিশেষজ্ঞ কমিটি,বিদ্যালয় শিক্ষা দপ্তর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার। প্রথম ভূমিকাতে লেখা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।২০২১ এর নুতন সংস্করণের ভূমিকার প্রথম লাইনে লেখা হয়েছে,”পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেন”। দুটি ভূমিকা লেখার মধ্যে স্ববিরোধিতা আছে বলে আমার মনে হয়েছে।আমার প্রশ্ন,ব্যক্তির নির্দেশে বিশেষজ্ঞ কমিটি, নাকি সরকারের নির্দেশে বিশেষজ্ঞ কমিটি?পাঠকরা তা বিচার করবেন।
বিতর্ক এইখান থেকেই শুরু করা যাক।কারন, একদিকে যেমন ইতিহাসের মধ্যে নানান যুক্তি–তর্ক, বিতর্কের বিষয়বস্তু থাকে, তেমনি নানান খতিয়ান, তথ্য ও ছবিও থাকে। ইতিহাস পড়ে নিজের পক্ষে, বিপক্ষে নানান ন্যায়সঙ্গত  যুক্তি- তর্ক করা যায় ।তার জন্যই প্রয়োজন ইতিহাস পড়া,জানা, বোঝা,  ,অনুশীলন ও আত্মস্থ করা। আমার বিতর্কের বিষয়বস্তু ,”কৃষিজমির  অধিকার = সিঙ্গুর গণ আন্দোলন প্রসঙ্গে “।

প্রথমেই বলা যাক, অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক “অতীত ও ঐতিহ্যতে” সিঙ্গুরের বিষয়বস্তুটি ঐতিহ্যের পরিপন্থী। পাঠ্যপুস্তকের  বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমার পক্ষের যুক্তি ও তার বিপক্ষে আমার কথা লেখার মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা।  অতীতের যা কিছু ঘটনা, তার সত্যতা ,আন্দোলনের ধরন ও প্রকৃতি, ভাষা- সংস্কৃতি- শিক্ষা -শিল্প এবং সেই এলাকার প্রাকৃতিক ও সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি  ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত থাকে। এই ঐতিহ্য প্রবাহমান  হয় প্রজন্মের পর প্রজন্ম । পাঠ্যপুস্তকের আলোচ্য অধ্যায় সম্পর্কে কিছু তথ্য ও বিবরণ সংশ্লিষ্ট এলাকার পারিপার্শ্বিক তথ্য সংগ্রহ করে প্রকৃত ঘটনা ও সত্য আমার লেখার মধ্যে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।  অষ্টম শ্রেণির ইতিহাসে লেখা এবং আমার লেখা পড়ে ছাত্র-ছাত্রী সহ অভিভাবকগণ ও সাধারণ মানুষ যাহাতে বিচার বিশ্লেষণ করে প্রকৃত সত্য অনুসন্ধান করতে পারেন তার জন্যই কিছু প্রসঙ্গ তুলে ধরছি।ইতিহাসের ১৬২ পাতায় তৃতীয় প্যারায় তিন লাইনে লেখা হয়েছে ,”তিন চার ফসলি জমি”। ১৬৩ পাতার তৃতীয় প্যারায় প্রথম লাইনে,” অত্যন্ত উর্বর বহুফসলী, নিবিড়ভাবে সেচসেবিত এই কৃষি এলাকায়…।” পাঁচটি মৌজায় মোট অধিগৃহীত জমির পরিমান ৯৯৭. ১১ একর। পাঠ্যপুস্তকে জমির চরিত্র সম্পর্কে  যা বর্ণনা আছে, তা সর্বৈব মিথ্যা। আসল সত্য হলো এই প্রজেক্ট এলাকার পাশ দিয়ে প্রবহমান ঘিয়া নদী ও জুলকিয়া খাল।নিকাশীর সমস্যার কারণে ঐ এলাকায় প্রায়শই জল জমে থাকতো। ওই এলাকাকে কেউ কেউ বলে থাকেন “জলা” বলে। প্রায় সারা বছরই স্যাঁতস্যাঁতে কাদা ,জল ভ’রে থাকতো। এরই মধ্যে একটি ফসল কোনরকমে হত। 


৯৯৭.১১একরের মধ্যে ৩৯.০৮ একর জমি বহুফসলি ছিল। এই জমিতেও  চাষবাস খুব একটা হত না। কারণ জমি ছিল ডাঙ্গা প্রকৃতির। বামফ্রন্ট সরকার ওই এলাকায় গভীর নলকূপ বসিয়ে জমি চাষযোগ্য করে তুলেছিল। সুতরাং,” তিন চার ফসলি জমি, উর্বর জমি, বছরভ’র  সেখানে চাষের কাজ হত “– এই লাইনটি আপত্তিকর ও বিতর্কিত। অধিগৃহীত ৯৯৭.১১ একর জমি সিঙ্গুরের মোট জমির মধ্যে  মাত্র ২.৫৫ শতাংশ। টাটা প্রকল্প এলাকার পাঁচটি মৌজার মোট জমির ২৭ শতাংশ। ১৬৪ পাতার প্রথম প্যারায় যে কাহিনী বিবৃত করা হয়েছে, তা একেবারেই গল্পকথা। সরকার জোরপূর্বক জমি অধিগ্রহণ করেনি। প্রকল্প এলাকায় জমির মালিক ছিলেন ১৩,১৩৩ জন। ১০,৮৫২জন সম্মতি দিয়েছিলেন। ২২৫১ জনের মধ্যে ১৬৮৩ জনের কোন মালিকানা ছিল না। ৫৬৮ জন কৃষক অনিচ্ছুক ছিলেন।১০৮৫২ জন কৃষক জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ চেক নিয়েছিলেন। ১৫৬ একর জমি পড়ে ছিল। তার মধ্যে বাঁধ ছিল ৩৫ একর। টাটা প্রকল্পের (শিল্পের) বিরোধিতা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তাঁর সঙ্গীসাথীরা আন্দোলন শুরু করেছিলেন।সেই সময়ে অনিচ্ছুক কৃষকদের নিয়ে উনি মামলা করলেন না কেন? থানায় ডায়েরী নথিভুক্ত করালেন না কেন? আসলে সেটা করার মতো বাস্তবতা ছিল না। আর সে সতসাহস ওনার ছিল না। কারণ সংখ্যালঘিষ্ঠ কৃষক অনিচ্ছুক ছিলেন। চরম সত্যের অপলাপ ঘটিয়ে কেবলমাত্র বিরোধিতা করার জন্য গায়ের জোরে বাইরে থেকে লোক ঢুকিয়ে (প্রকল্পের এলাকায়) বিশৃঙ্খলা তৈরি করে শিল্পের ভবিষ্যৎ, কর্মসংস্থানের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়াই ছিল ওনার উদ্দেশ্য। ১৬৪ পাতার প্রথম প্যারায় লেখা হয়েছে,”যাদের রুজি রোজগার বিপন্ন হয়ে পড়েছিল, তাদের ক্ষতিপূরণ ও উপযুক্ত পুনর্বাসনের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। “এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও আজগুবি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিভাবে সরলমতি ছাত্র -ছাত্রীদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই মিথ্যার অবতারণা।  সত্য যা তা হল –তৎকালীন সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল তা হল ;–

১) এক ফসলি জমির জন্য;– একর প্রতি ছয় লক্ষ টাকা এবং ১৪৩ শতাংশ সোলাসিয়াম + দশ শতাংশ ইনসেনটিভ ।অর্থাৎ একর প্রতি আট লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা।

২) বহুফসলি জমির জন্য;–একর প্রতি আট লক্ষ টাকা এবং ১৪৩ শতাংশ সোলাসিয়াম +দশ শতাংশ ইনসেনটিভ অর্থাৎ একর প্রতি বারো লক্ষ টাকা । মোট ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ১৩০ কোটি টাকা।

 ৩) বর্গাদারদের  ক্ষতিপূরণের পরিমাণ;–জমির মালিককে দেওয়া অঙ্কের পঁচিশ শতাংশ। বর্গাদারের নথিভুক্ত সংখ্যা ৩০০ জন এবং অনথিভুক্ত ১৭০ জন।

৪) প্রশিক্ষণ কর্মসূচি:–ওয়েল্ডিং , অটোমোবাইল,বৈদ্যুতিক কারিগরি যন্ত্রাংশ মেরামতি,ফিটার — এই চারটি বিষয়ে বেলুড়ে প্রশিক্ষণ চলছিল সেই সময়ে ১৮০ জনের।

৫) সেলাই প্রশিক্ষণ:–সেই সময়ে বেড়াবেড়ি  সূর্যনারায়ন উচ্চবিদ্যালয়ে ৪০ জন মহিলা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেনিলেন।

৬) ক্যাটারিং :–ক্যাটারিং শিখছিলেন ৪০ জন মহিলা কলকাতার তারাতলায়। 

৭) রাজমিস্ত্রি:–জমিদাতাদের বাড়ির ছেলেরা রাজমিস্ত্রির প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন সল্টলেকে।

ওই প্যারাতেই লেখা হয়েছে,” মহিলাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও অন্যান্য প্রকল্প কার্যকর করার কথা পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হলেও তা কার্যকর হয়নি। যে বিশেষজ্ঞ কমিটি পাঠ্যপুস্তকে এই অধ্যায়টি লিখেছেন, তাঁরা সত্যকে গোপন করে গেছেন। পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগমের উদ্যোগে এবং সিঙ্গার ইন্ডিয়া লিমিটেড –এর পরিচালনায় কারখানার শ্রমিকদের জন্য ইউনিফর্ম ও দস্তানা তৈরীর কাজ করানোর জন্যই ঐ উল্লিখিত বিদ্যালয়ে সেলাই প্রশিক্ষণের কাজ চলছিল। দুটি শিফটে মোট ৪০ জন মহিলা প্রশিক্ষণ নিতেন ,দশটি সেলাই মেশিন ছিল। দস্তানা ও ইউনিফর্ম তৈরি হচ্ছিল।প্রশিক্ষিকা মালা মিত্র সেই সময়ে জানিয়েছিলেন,সেলাই ইউনিটের সমস্ত খরচ বহন করছে শিল্পোন্নয়ন নিগম। ১৬৫ পাতার প্রথম প্যারায় লেখা হয়েছে ,”বহুজনকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। “ছাত্র-ছাত্রীরা ইতিহাস পড়বে উবাচ ভাবে?? বহুজন মানে কতজন? তখন তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতাশালী হয়ে গেছেন। তার জন্যই তো দলবল নিয়ে গিয়ে বিধানসভা ভাঙচুর করলেন।এই বহুজনকে থানায় নিয়ে গিয়ে উনি ডায়েরি করাতে পারলেন না কেন? কে বা কারা প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছিল? সেই দুষ্কৃতিদের নাম, তারা কোন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকে, তাদের পরিচয় ইতিহাসে লেখার সৎ সাহস পেলেন না? ওই প্যারায় আছে তাপসী মালিক ও রাজকুমার ভুল সহ ১০ জন শহীদ হন। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী বর্তমানে রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বিশেষজ্ঞ  কমিটিকে দিয়ে সিঙ্গুরের এই ঐতিহ্য লেখালেন ,তাদেরকেই ১০ জন শহীদের নাম, ঠিকানা কিম্বা ছবি দিতে ভুলে গেলেন। যে ১০ জন শহীদ হলেন ইতিহাসে তো তাদেরও ছবি থাকার কথা। যা স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাসে পাতায় জ্বলজ্বল করতো। সেটা না হয়ে প্রতিটি পাতায় মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ছবি কেন? যদি বর্তমান সরকারের সৎ সাহস থাকে তাহলে ওই দশজন শহীদের ছবিসহ নাম, ঠিকানা সম্বলিত সরকারিভাবে শ্বেতপত্র প্রকাশ করুন এবং ওই পরিতক্ত প্রকল্প এলাকায় টাঙিয়ে দিন।


১৬৫ পাতায় তৃতীয় প্যারায় লেখা হয়েছে,” বস্তুত সিঙ্গুর আন্দোলন ছিল খেটে খাওয়া মানুষের জীবন জীবিকার রক্ষার লড়াই” প্রথম পর্বে এই আন্দোলন সম্পর্কে আনন্দবাজার পত্রিকা ও দ্য হিন্দু পত্রিকা কি লিখেছিল তা বর্ণনা করা আছে। আসলে এটা জীবন- জীবিকার রক্ষার লড়াই ছিল না, ছিল শিল্পায়নের বুকে পেরেক মেরে শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের আশা ,আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন এবং তার ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দেবার লড়াই। এক কথায় বলা যায় ,বামফ্রন্ট সরকারের ঘোষিত নীতি ,”কৃষি আমাদের ভিত্তি শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ “–এই স্লোগানকে বাস্তবায়িত করতে না দেওয়ার ,কৃষি এবং শিল্প দুটোকেই ধ্বংস করে দেওয়ার সুগভীর চক্রান্ত।
{তথ্য সংগৃহীত}              চলবে…