সাম্প্রতিক বা সুদূর অতীতে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার জন‍্য বিরোধী বিধায়ককে পাঁচদিনের জেল হেফাজত! মনে পড়ছে না! কিন্তু গত ২১ শে জানুয়ারি সন্ধ্যায় কলকাতার ধর্মতলা থেকে অবস্থান বিক্ষোভ থেকে টেনে হিঁচড়ে পুলিশ যেভাবে ভাঙড়ের আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীকে টেনে ভ‍্যানে তুলল এবং প্রায় সতেরোজন সমর্থকদের সঙ্গে গ্রেফতার করল তা এককথায় নজিরবিহীন।

ঐদিন ভাঙড়ে প্রতিষ্ঠাদিবস পালন করার অনুষ্ঠানের আয়োজন করার সময় থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের বাধার মুখোমুখি হয়েছিলেন ইণ্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের কর্মীরা। আগের দিন অর্থাৎ ২০শে জানুয়ারি রাতে হাতিশালা এলাকায় পতাকা লাগানোর সময় তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীদের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। পরেরদিন ২১শে জানুয়ারি পূর্বনির্ধারিত কলকাতায় প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে আই এস এফের কর্মী সমর্থকরা যোগ দিতে আসার সময় তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকরা তাঁদের ওপর হামলা চালায়। ভাঙচুর করা হয় বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীর গাড়ি।

পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন আই এস এফ কর্মীরাও। পুড়িয়ে দেওয়া হয় তৃণমূল কংগ্রেসের তিনটি কার্যালয়। পুলিশ দু দলের এই সংঘাতকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভাঙড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের আধিপত্য ফিরিয়ে আনার জন‍্যই সম্ভবত প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলামের নির্দেশে এই রাজনৈতিক সংঘর্ষের দায় আইএসএফ এর ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার জন‍্যই পুলিশ কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল। কলকাতায় এসে আইএসএফ কর্মীরা আরাবুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করার দাবিতে নওশাদ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ধর্মতলা অবরোধ করেন। পুলিশ লাঠিচার্জ করে অবরোধ তুলে দিতে গেলে আই এস এফ সমর্থকরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন পাল্টা ইঁট ছোঁড়া শুরু হয় পুলিশকে লক্ষ্য করে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

 তারই পরিণতিতে এই গ্রেপ্তারি। বলাবাহুল‍্য আরাবুল ইসলাম সহ যে তৃণমূল কংগ্রেস নেতা কর্মীরা আই এস এফের প্রতিষ্ঠাদিবসের কর্মসূচি বানচাল করতে সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করলেন তাঁদের স্পর্শ করেনি পুলিশ।  আদালত ভাঙড়ের বিধায়ককে সমর্থকসহ  ১লা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে রাখার আদেশ দিয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে  পুলিশকে আক্রমণ করা, খুনের চেষ্টার অভিযোগের মতো মারাত্মক অভিযোগ আনা হয়েছে। আদালতে যেদিন নওশাদ সিদ্দিকীদের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হল সেদিনই ভাঙড়ে আরাবুলের বাড়ির সামনে উদ্ধার হয়েছে ১৬টি বোমা একটি পাইপগান ও এক রাউণ্ড গুলি। যথারীতি গ্রেফতার করা হয়েছে এক আইএসএফ কর্মীকে। পুলিশ কে রাজনৈতিকভাবে ব‍্যবহার করার উদাহরণ ভাঙড়ে ক্রমশ বাড়ছে। কারণ ভাঙড়ের সিণ্ডিকেট রাজের রাশ কার হাতে থাকবে এই বিবাদে তৃণমূল কংগ্রেস যখন আরাবুল ইসলাম, কাইজার আহমেদ, রেজাউল করিম প্রমুখ নেতাদের অনুগামীদের সংঘর্ষে সাধারণ মানুষ যখন  অতিষ্ঠ তখন শক্তিশালী বিকল্প হিসাবে উঠে এসেছে আইএসএফ। অনেক তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থক নিজেদের দলের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে যোগ দিয়েছেন আইএসএফ এ। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কারণে বাস্তবে এখন সমর্থনের শক্তিতে ভাঙড়ে আইএসএফ কিছুটা হলেও এগিয়ে। রক্তদান সহ নানা সামাজিক কাজের জন‍্য নওশাদ সিদ্দিকীর ব‍্যক্তিগত জনপ্রিয়তাও রয়েছে। ফলে প্রশাসনকে ব‍্যবহার করা ছাড়া ভাঙড়ের প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক আরাবুল ইসলামের সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা নেই।

অবশ‍্য মাঝখানে ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে যাদবপুর কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী মিমি চক্রবর্তীকে বিজেপির সহায়তায় বিপুল ভোটে এগিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে ব‍্যাতিক্রম ধরলে ভাঙড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের পায়ের নীচে মাটি আলগা হতে শুরু করেছে ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় থেকেই। পাওয়ার গ্রিড নিয়ে প্রবল বিরোধিতার আবহে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্যের চেষ্টায় হোয়াটস‍্যাপ মারফত মনোনয়নপত্র পেশ করতে হয়েছিল বামফ্রন্ট সমর্থিত নির্দল  প্রার্থীদের।  তখন আরাবুল ইসলাম জেলবন্দী। তা সত্ত্বেও বিরোধীদের জন‍্য শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের “উন্নয়ন “দাঁড়িয়েছিল রাস্তায়। সেই নির্বাচনে  দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড় ২ নম্বর ব্লকের পোলেরহাট ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের ৮টি আসনের মধ্যে ৫টিতে জয়ী হয়েছিলেন জমি জীবিকা বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটির প্রার্থীরা। তিনটিতে জিতেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরা।  জীবিকা বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটির এই জয়ী প্রার্থীরা হোয়াটসঅ্যাপে মনোনয়ন জমা দেন।নয়জন প্রার্থী হোয়াটস্যাপে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। আরাবুল ইসলাম তথা তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাস্ত করেছিল ভাঙড়ের জমি জীবিকা পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষা কমিটি।পঞ্চায়েত দখল করলেও এই ফল যে রাজ্যের শাসকদলের পক্ষে প্রতিকূল তা বলাই বাহুল্য। ভাঙড় গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট আসন সংখ্যা ১৬। যার মধ্যে আটটি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু নির্বাচন হওয়া বাকি আট আসনে নির্দল প্রার্থীদের কাছে হেরে গিয়েছিল আরাবুল বাহিনী।

 জয়ী সকল নির্দল প্রার্থীরাই ভাঙড়ের জমি জীবিকা পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষা কমিটির সঙ্গে যুক্ত। আরও ভালো করে বললে,সকলেই তৃণমূল কংগ্রেস তথা আরাবুল ইসলামের বিরোধী বলেই এলাকায় পরিচিত। অনেকেই বলছেন লোকসভা নির্বাচনে শেষমূহুর্তে তৃণমূল কংগ্রেস  সাম্প্রদায়িক তাস না খেললে ২০১৯ সালেও লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ভাঙড়ে পিছিয়ে থাকত। কিন্তু ২০২৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে ফৌজদারী মামলায় তৃণমূল বিজেপি র বৃত্তের বাইরে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় একমাত্র বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী -যাঁর প্রভাব ধর্মীয় রাজনীতির বাইরেও যথেষ্ট, তাঁকে আটকে রাখা শাসকদলের একটা কৌশল নয়তো?