
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভক্তরা গর্ব করে বলেন, ভারতের দিকে এখন বিশ্বের কোন দেশ চোখ তুলে তাকাতে সাহস করে না। নিন্দুকেরা শুনে হেসে উড়িয়ে দেন, টাকার দাম যে জায়গায় নামিয়ে এনেছেন তাতে বেকারত্ব ও ক্ষুধার জ্বালায় দুর্বল দেশের দিকে কোন শক্তিশালী দেশ তাকানোর প্রয়োজন বোধ করবে না। প্রবল আর্থিক সংকট থেকে জনগণের চোখ সরিয়ে দেওয়ার জন্যই সঙ্ঘ পরিবার ও আই টি সেল কে দিয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি করাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি।
২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জয় পেয়ে দ্বিতীয় বারের জন্য কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাষ্ট্র যন্ত্র দখল করার জন্য মরীয়া হয়ে উঠেছেন নরেন্দ্র মোদি। বস্তুত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির মত সংগঠন নির্ভর পার্টিকে ব্যক্তিগত ক্যারিশমা নির্ভর পার্টি এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক সরকারে রূপান্তরিত করার পুরো কৃতিত্বই নরেন্দ্র মোদির প্রাপ্য। তিনি পার্টি ও সঙ্ঘ পরিবারের কাছে রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি রূপায়ণ করার অবিসংবাদী নেতা হিসাবে এতটাই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছেন যে, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সহ বিজেপির সর্বস্তরের নেতা নেত্রীরাও মোদিজীর স্তুতি গেয়ে বিবৃতি বা বক্তব্য শুরু করেন। বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন বা উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছাড়া ন্যাশানাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স বা এন ডি এ জোটের প্রসঙ্গ তেমনভাবে উচ্চারিত হয় না। সম্ভবত সঙ্ঘ পরিবারের ইতিহাসে এমন ব্যক্তিপ্রাধান্যের পূর্ব ইতিহাস নেই।
স্বাভাবিকভাবেই অতি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী নরেন্দ্র মোদি বা বিজেপির সমালোচনাকে “দেশদ্রোহ “হিসাবে বিবেচনা করা হয়। শুধু তাই নয়, মোদির যাবতীয় ভুল পদক্ষেপ কে নির্দ্বিধায় সমর্থন করার জন্য এখন বিশিষ্টজনদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। যখন সারা দেশজুড়ে অশোক স্তম্ভের সিংহের নরেন্দ্র মোদি সংস্করণের সমালোচনার ঝড় উঠেছে তখন অনুপম খের মন্তব্য করেছেন,”স্বাধীন ভারতের সিংহ সে তো শক্তি প্রদর্শন করবেই!”এমনকি অতি সম্প্রতি সংসদে বক্তব্য রাখার সময় সরকার পক্ষ থেকে যে সব শব্দ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল তার বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তীব্র সমালোচনা করলেও মোদি ভক্তরা বিদ্রূপ করে বলছেন এবার “দেশদ্রোহীরা ডিকশনারি খুঁজে শব্দ বার করুক!” অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার বা তার নেতৃত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রীর কাজ, বিভাজনের রাজনীতি,বিদ্বেষমূলক প্রচার এবং জীবন জীবিকা নিয়ে সরকারের প্রতারণার বিরুদ্ধে কঠোরভাষায় কোন সমালোচনা সংসদে করা যাবে না। ধর্মনিরপেক্ষতার মত গণতন্ত্রকেও বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার বাহুল্য মনে করে বার বার এভাবেই প্রমাণিত হচ্ছে। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করার একতরফা সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক ছাড়া কিই বা বলা যায়? এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় সঙ্ঘ পরিবারের পক্ষ থেকে কাশ্মীরের সব মুসলিম বাসিন্দাদেরই কার্যত উগ্রপন্থী হিসাবে দাগিয়ে দেওয়ার নিরলস প্রয়াস চলেছিল। বশংবদ গণমাধ্যম যাদের কুখ্যাতি “গোদি মিডিয়া” নামে তারা তখন “হ্যাঁহ্যাঁ বলা সঙ”- হলেও এখন কাশ্মীরে ক্রমবর্ধমান জঙ্গি কার্যকলাপের জন্য মোদি অমিত শাহের ব্যর্থতার দিকে আঙ্গুল তুলতে ভুলেই গেছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সন্ন্যাসীর পোশাক পরা মুখ্যমন্ত্রী যেমন বিজেপি জমানায় সহজলভ্য হয়েছে তেমনি সুশাসন প্রতিষ্ঠার নামে “এনকাউন্টার” এবং “বুলডোজার “- বিজেপি জমানায় এই চমকও দুর্লভ নয়।
২০১৯ সালের পর বিচারব্যবস্থার মধ্যেও রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রভাব যে লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়ে গেছে তা সর্বভারতীয় স্তরের অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের লেখা থেকেই বোঝা যায়। দশ বছর আগেও ভাবা যায় নি সর্বোচ্চ আদালত থেকে শুধুমাত্র ভক্তদের বিশ্বাসকে মর্যাদা দেওয়ার যুক্তিতে রামমন্দিরের ভিতপূজোর রায় পাওয়া যাবে। এহসান জাফরি সহ ৬৮ জন নিরীহ মানুষের হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে গুজরাটের প্রশাসনের তৎকালীন সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের যোগাযোগ নিয়ে সুবিচার চাওয়া জাকিয়া জাফরি ও সমাজকর্মী তিস্তা শীতলাবাদ সর্বোচ্চ আদালতে ভর্ৎসিত হবেন এমন পরিস্থিতিও অভাবনীয় ছিল। তার চেয়েও অভাবনীয় ছিল রায় বেরোনোর পরে পরেই গুজরাট পুলিশ মুম্বাইয়ে পৌঁছে তড়িঘড়ি তিস্তা শীতলাবাদকে গ্রেফতার করার ঘটনা। এখনো তেমন কোন বড়ো প্রমাণ সাক্ষী সাবুদ ছাড়াই তিস্তা শীতলাবাদ কারান্তরালে। এর আগে বিজেপি তথা প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করার জন্য গুজরাটের বিজেপি বিরোধী প্রতিবাদী তরুণ নির্দল বিধায়ক জিগনেশ মেওয়ানিকে গ্রেফতার করতে গুজরাট পুলিশের মত অসমের পুলিশকেও তৎপর হতে দেখা গেছে। বামপন্থীরা ছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীকে এই ভয়ংকর গণতন্ত্র বিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে লাগাতার সোচ্চার হতে সেভাবে দেখা যায় না বলেই আগামী ভারতবর্ষের কথা ভেবে ভয় হয়।
মানুষের অধিকার ও প্রকৃতির সম্পদ রক্ষায় নিবেদিত প্রাণ স্ট্যান স্বামী বা জি ডি আগরওয়াল – কারুর মৃত্যু সংবাদে প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর পারিষদদের যেমন এতটুকু বিচলিত হতে দেখা যায় না গণমাধ্যম এবং দেশকে কি সেই হৃদয়হীনতার দিকেই ঠেলে দিচ্ছে সঙ্ঘ পরিবার?