শিকড় বিনা গাছ বাঁচেনা

                         অরিন্দম  মুখোপাধ্যায়

মাতৃভাষাকে না জানার অর্থ শিকড়কে অস্বীকার করা। শিকড় ছাড়া কি গাছ বাঁচতে পারে? মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন, জীবনদান, রক্তদান এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। এই তাৎপর্যপূর্ণ প্রবাহ ইতিহাস রচনা করেছে সারা বিশ্বের ছোটো-বড়ো বিভিন্ন ভাষার স্বাধিকার রক্ষার আন্দোলনে। এখানে ছোটো বলতে স্বল্প জনসংখ্যার বা ছোটো জনগোষ্ঠীর ভাষার কথা বোঝানো হচ্ছে। সেই অর্থে ভাষার কোনো ছোটো-বড়ো হয় না।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বাংলা ভাষার অধিকারের দাবিতে দৃঢ়পণ আন্দোলন উজ্জ্বল স্থানে আসীন হয়ে আছে। বাংলা ভাষা আন্দোলনের শুরু ব্রিটিশ ভারতের মানভূমে ১৯১২ সালে। এই আন্দোলন উচ্চগ্রামে পৌঁছয় ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে। দুনিয়ায় এটাই দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের ফলাফল হিসেবেই বিহারের মানভূম জেলা ভেঙ্গে পুরুলিয়া জেলার সৃষ্টি ও পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্তি।

বাংলা ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় প্রবাহ যা পরিণত  হয়েছিল  সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ঝড়ে, তা হল পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববঙ্গে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন। আমরা সবাই জানি পূর্ব পাকিস্তানের শাসকদের পক্ষ থেকে জোরপূর্বক উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেবার কুপ্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সেখানকার বাংলাভাষী জনতা আন্দোলন গড়ে তোলে। মনে রাখতে হবে ৫৬ শতাংশের মাতৃভাষা বাংলার ওপর শাসকশ্রেণি ৩.০৭ শতাংশের ভাষা উর্দু চাপিয়ে দিয়ে আধিপত্য কায়েম রাখার ষড়যন্ত্র করেছিল। এর প্রতিবাদে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতিবাদ মিছিলে বর্বর আক্রমণ ও গুলিচালনার ঘটনা ঘটে। এতে শহীদের মৃত্যুবরণ করেন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার ও শফিউল। আহত ও নিখোঁজ হন অনেকে। দীর্ঘ আন্দোলনের ফল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। কেবল তাই নয়, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন জয়যুক্ত হবার মধ্য দিয়ে কালক্রমে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রের দাবি উঠে আসে ও স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

বাংলা ভাষা আন্দোলনের তৃতীয় উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি হল আসামের বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আসাম মূলত দুই নদের অববাহিকা অঞ্চলে বিভক্ত।  ব্রহ্মপুত্র ও বরাক। এই দুই অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি, এমনকি ভৌগোলিক অবস্থানে ছিল বিস্তর ফারাক। কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি এই তিন জেলা নিয়ে বরাক উপত্যকা। শিলচর প্রধান শহর। এই উপত্যকার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল বাংলাভাষী। অথচ তৎকালীন আসাম সরকার সিদ্ধান্ত নিল একমাত্র প্রশাসনিক ভাষা হবে অসমীয়া ভাষা। প্রতিবাদে শুরু হল বিক্ষোভ আন্দোলন। এই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পেল ১৯৬১ সালের ১৯ মে। দ্বিতীয় ভাষা বাংলা চাই এই দাবিতে ভাষা সত্যাগ্রহীদের শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর নির্মম গুলিচালনায় ১১ জন নারী-পুরুষ শহীদ হলেন। বাংলা ভাষার স্বীকৃতি প্রদানে বাধ্য হল আসাম সরকার।

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। কেন এই দিনটি আমাদের কাছে সর্বাধিক স্মরণীয়? তার কারণ ২১শে’র ভাষা আন্দোলন ও তার থেকে উদ্ভূত দীর্ঘ সংগ্রামে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ দ্বিজাতিতত্ত্বের মুখে সপাট চপেটাঘাত। দ্বিজাতিতত্ত্ব বলতে বোঝায় হিন্দু-মুসলমান দুটি আলাদা জাতি। এই চিন্তাধারায় ভর করেই ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে দেশভাগের মধ্য দিয়ে। তৈরি হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান দু’টি আলাদা রাষ্ট্র। দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলির অনমনীয় মনোভাব ও ব্রিটিশের হীন কূটকৌশল অনিবার্য করে তুলেছিল ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে জাতি নির্ধারণ যে কতটা ভ্রান্ত ভাবনা তা প্রমাণ হয়ে গেল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিপুল জনজাগরণে।  ইসলামের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তানকে এক রাখা গেল না। ভাষার আগ্রাসন, বাঙালি জাতিসত্তার প্রশ্ন সেখানে বড়ো হয়ে উঠল। ফলে প্রথমে উত্তুঙ্গ ভাষা আন্দোলনে ও পরে বাংলা ভাষার রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রামে তারা মৃত্যুঞ্জয়ী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে প্রথমে বাংলাভাষার স্বাধিকার ও পরে মুক্তিযুদ্ধের  মধ্য দিয়ে বাংলা রাষ্ট্র তথা বাংলাদেশ গঠন করে ছাড়ল। প্রমাণ হল ধর্মভিত্তিক জাতি গঠনের ভাবনা ভুল। ধর্মের ভিত্তিতে ভিন্নভাষী, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে এক রাখা যায় না। আজ আবার ভারতের বুকে ধর্মীয় বিভাজনের হীন রাজনীতি আমদানি করে হিংস্র পরিবেশ সৃষ্টি করে জীবন-জীবিকার সমস্যা থেকে মানুষের নজর ঘুরিয়ে দিতে চাইছে আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। এই অপচেষ্টাকে প্রতিহত করার লক্ষ্যেই একুশের ইতিহাস স্মরণ ও চর্চা করা দরকার আমাদের।

এবার বাংলা ব্যতীত অন্য ভাষার ওপর আগ্রাসনের কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ইতিহাসে আছে বিসমার্ক ও মেটারনিক জার্মান ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দিয়েছিল পোলিশদের ওপর। এর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে আন্দোলন। ফলাফল শাসকশ্রেণির পক্ষে ভালো হয় নি। জার নিকোলাস রাশিয়ার অন্যান্য জাতির ওপর আধিপত্য চালাতে জোরপূর্বক রুশ ভাষা চাপিয়ে এক তীব্র জাতিদাঙ্গার পথে ঠেলে দিয়েছিল সমগ্র রাশিয়াকে। আফ্রিকায় হাঙ্গেরিওরা  তাদের ভাষাকে অন্য ভাষা ও অন্য জাতিকে দমনের উদ্দেশ্যে জবরদস্তি করে চাপিয়েছিল। ফল বিষময় হয়েছিল।

এবার আসা যাক ভাষা আগ্রাসনের পিছনে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণ বিশ্লেষণে। আমাদের দেশে ব্রিটিশ শাসকরা বুঝেছিল বাংলাকে একত্রে বেঁধে রেখেছে বাংলাভাষা। তাই সে বাঁধন ভাঙতে, বাংলা ও বাঙালিকে দুর্বল করতে এবং নিজেদের ক্ষমতার আধিপত্য কায়েম রাখতে তারা বাংলাকে ভাগের চক্রান্ত চালায়। একইসাথে  ভাষার ঐক্যশক্তি ধ্বংস করার লক্ষ্যে ‘মুসলমানী’ বাংলাভাষা প্রচলনে ইন্ধন দেয়। বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি মুনাফাশিকারি বিশ্ব লগ্নিপুঁজি জাতি-রাষ্ট্রের সীমা নিরপেক্ষ অখণ্ড বাজারের জন্য লালায়িত। আর এই বাজারে পণ্য বিকোবার জন্য চাই সমরুচির ক্রেতা। যাদের  ভাবনা, আকাঙ্ক্ষা, শখ, পছন্দ, চাহিদা সবই হবে এক ধরনের। সারা দুনিয়ার যে কোনও প্রান্তে অবস্থানকারী ওই ক্রেতাদের, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মানুষদের পুঁজিবাদী ভোগ্যপণ্যের ক্রেতা হিসেবে সমরুচি (Homogeneous Taste)-র ছাঁচে গড়তে হবে। যাতে তারা একধরনের খাবার খায়, একধরনের পোশাক পরে, একধরনের গান শোনে, একধরনের চিন্তা করে। তাই আয়োজন সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন ও পণ্যায়নের এবং ভাষা আগ্রাসনের।

বিশ্ব লগ্নিপুঁজির এককেন্দ্রিক অর্থনীতি চায় বহুত্ব ও বহুস্বরের সংহার। যাতে বহুজাতিক সমমানের পণ্য ছড়িয়ে পড়তে পারে দুনিয়ার প্রত্যন্ত দূরতম অঞ্চলেও। কোনও রকম স্থানীয় বিষয়, বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্র্য যাতে বাধা না হয়ে দাঁড়ায় জনরুচির একিকরণের পথে। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা আগ্রাসী লগ্নিপুঁজি যাতে এক লহমায় অতিক্রম করতে পারে সীমান্তের পর সীমান্ত। দ্রুত সঞ্চরণশীল বিপুল পুঁজির  এক এবং একমাত্র  লক্ষ্য দ্রুত মুনাফা। তাই শেয়ার বাজারের ফাটকা ও পরিষেবা ক্ষেত্রের পাশাপাশি এই পুঁজির ব্যাপকতর বিনিয়োগ ঘটছে তথ্য ও প্রমোদের দুনিয়াজোড়া উৎপাদন ও বন্টনে। তথ্য, যোগাযোগ ও প্রমোদ বা বিনোদন—এই তিন ক্ষেত্রের প্রযুক্তিগত  Convergence বা কেন্দ্রাভিমুখীতা ঘটাচ্ছে লগ্নিপুঁজির মালিকরা। যাকে এককথায় বলা হচ্ছে ICE (I-Information, C-Communication, E-Entertainment)। লক্ষ্য হল বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য।  কারণ একতরফা বিনিয়োগ ও মুনাফা শিকারের ক্ষেত্র বরাবরের  জন্য খোলা রাখতে বিশেষভাবে দরকার মতাদর্শগত আধিপত্য ও মনন জগতের দখল নেওয়া। তাই দরকার সংস্কৃতির বহুত্ববাদী ভাবনা, ভাষার বিভিন্নতা তথা শতফুল বিকশিত হবার ভাবনার সংহার। দরকার জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ শ্রমজীবী ও কর্মজীবী মানুষকে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলে এক ছাঁচে ঢালা, পুঁজির দাসত্ববন্ধনে আবদ্ধ জড়চেতন, জড়বুদ্ধি জৈবিক বস্তুতে পরিণত করা। এই উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যেই ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন চালানো ও আধিপত্য কায়েম করা ছাড়া পুঁজির পাহারাদার শাসকশ্রেণির কোনও বিকল্প নেই। তাই মাতৃভাষার স্বাধিকার রক্ষা, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও আবেগ তৈরির কাজ  একটি রাজনৈতিক কর্তব্য। এই কাজে নিরন্তর নিয়োজিত থাকতে হবে প্রত্যেক গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন দেশপ্রেমিক মানুষকে।