সাভারকর যেভাবে চেকোস্লোভাকিয়ার জার্মান সংখ্যালঘুদের প্রসঙ্গ টেনেছিলেন, তাতে ভারতীয় পরিস্থিতির সাথে প্রচ্ছন্ন তুলনার ইঙ্গিত ছিল। ১৯৩৮ – ১১ অক্টোবর পুণেতে পারা চার হাজার সমর্থকের কাছে তিনি বলেন, যদি ভারতে একটা গণভোট নেওয়া হত, তবে মুসলিমরা মুসলিমদের আর হিন্দুরা হিন্দুদের সাথে মিলে যাওয়াটাই পছন্দ করত। এই ধারণার উৎস হলো সেই নীতি যার সার কথা হলো একসঙ্গে কয়েক শতক বসবাস করাটা জাতি (nation) গঠনের পক্ষে জরুরী নয় ( MSA, Home Special Department, 60D (g) Pill 1937 Extract from the weekly confidential report of the district Magistrate, date October 21, 1938]। সাভারকর হিন্দু মহাসভার সভাপতি থাকাকালীন মুসলিম বিরোধী জিগির ক্রমাগত উগ্র ও অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে থাকে। এই সূত্রে বারবার জার্মানরা ইহুদীদের সাথে যে ব্যবহার করছে সে প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়েছে। ভাষণের পর ভাষণে, সাভারকর হিটলারের ইহুদী নির্যাতনের নীতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। ১৯৩৮-র ১৪ অক্টোবর তিনি ভারতে মুসলিম সমস্যার সমাধান সম্বন্ধে বলেন :-

“একটি জাতি গঠিত হয় সে দেশে বসবাসকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর দ্বারা। জার্মানিতে ইহুদীদের থাকার কি দরকার? সংখ্যালঘু বলেই সেখান থেকে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে [MSA, Home Special Department. 60D (g) PT III. 1938.Translation of the verbatim speech made by VD Savarkar at Mitego o October 14, 1938]।

 ১৯৩৮-র শেষদিকে, ঠিক যখন কংগ্রেস জার্মানির বিরোধিতার কথা জানায়, তখনই থানেতে আর এ চরমপন্থী ও স্থানীয় সমর্থকদের সামনে সাভারকর ঘোষণা করেন:-

“জার্মানিতে জার্মানদের আন্দোলন জাতীয় আন্দোলন আর ইহুদীদের আন্দোলন হলো সাম্প্রদায়িক (MSA, Home Special Department. 60D (g) Pt III 1938. A report on the meeting held on December 11, 1938)।

আবার ১৯৩৯-র ২৯ জুলাই পুণেতে সাভারকর বলেন,”জাতিত্ব (nationality) সাধারণ ভৌগোলিক পরিসীমার ওপর ততটা নির্ভর করে না, যতখানি করে ভাব, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির ঐক্যের ওপর। এই কারণেই জার্মান এবং ইহুদীকে এক জাতি বলা যায় না। (MSA, ibid. Extract from the BP Weekly letter on 31. dated August 5, 1939)।

এই ধরনের ঐক্য ছাড়া, হিন্দু মুসলিমকেও একই জাতির অংশ বলে ধরা যাবে না। ভারতীয় মুসলিমদের নিজেদের সংখ্যালঘু হিসেবে মেনে নেওয়া ব্যতীত পথ নেই। অধিকারগুলো নির্ভর করবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মহানুভবতার ওপর। শেষ পর্যন্ত, ১৯০৯-এ হিন্দু মহাসভার একবিংশতি অধিবেশনে সাভারকার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ভারতের মুসলিম প্রশ্নের সাথে জার্মানির ইহুদী প্রশ্নের তুলনা টানেন:

“…জার্মানির ইহুদীদের মতো, ভারতীয় মুসলিমরাও সামগ্রিকভাবে তাদের নিকট প্রতিে হিন্দুদের চেয়ে ভারতের বাইরের সাথে নিজেদের ও আপন স্বার্থকে একাত্ম করে দেখে”।

সাভারকরের ‘হিন্দুত্বে’ ব্যক্ত জাতি (nation) এবং জাতিত্বের (nationhood) ধারণা হই ওপরে উল্লেখিত বক্তব্যের মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে। সাভারকর, তাঁর বইয়ে মুসলিমদের সম্পর্কে লিখছেন:

(আন্দামানে অন্তরীণ থাকাকালীন সাভারকর গোপনে ‘হিন্দুত্ব’ লেখেন। পরে ১৯১৭- তে তা ব্রিটিশের চোখ এড়িয়ে ভারতে পাঠান হয়। গোপন জায়গা থেকে এই বই ছাপা হয় ১৯২৩-এ। )

“ওদের পবিত্রভূমি সুদূর আরবদেশ অথবা প্যালেস্টাইনে। ওদের পুরাণ শাস্ত্র এবং সাধুসন্তরা, ভাব ও নায়কেরা আমাদের দেশের মাটিতে জন্ম নেয়নি। তাই ওদের নামগুলে এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে বিদেশী উৎসের ছাপ রয়েছে” [Hindutva: Who is Hindu ? 4th ed Bharat Mudranalaya, Pune, 1949, p.94]।

জার্মানির নাৎসিদের ইহুদী নিধন নীতি সম্পর্কে সপ্রশংস মনোভাব ১৯৩০-র দশকের শেষে হিন্দু জাতীয়তাবাদের পুরো চক্রটার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। গোলওয়ালকার’ তাঁর পুস্তিক ‘We or Our Nationhood Defined’-এ জানান:

আজকের দিনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় জার্মান জাত্যাভিমান। নিজেদের জাতি এবং তার কৃষ্টির অকৃত্রিমতা বজায় রাখার লক্ষ্যে তারা দেশ থেকে সেমিটিক জাতি (ract) ইহুদীদের উন্মলনের পথ নিয়েছে। জাতিগত অহং এখানে তার শীর্ষ বিন্দু স্পর্শ করেছে। জার্মানি এটা দেখিয়েছে যে, ভিন্ন ধাতের জাতি ও কৃষ্টির পক্ষে একটা ঐক্যবদ্ধ সমগ্র মধ্যে মিশে যাওয়া অসম্ভব। হিন্দুস্তানের এই শিক্ষা নিয়ে, সেইমত চলা উচিত (১৯৩৯, পূঃ ৩৭)।

মৌলিক ধারণাটা হলো এই রকম যে, হিন্দু হওয়াটা শুধুমাত্র সৃষ্টির বিষয় নয়, তি এবং রক্তের সম্পর্কের বিষয়। ইতালি ও জার্মানিতে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের কল্পকথার (myth) সাথে এর সাদৃশ্য সহজেই ধরা যায়। Jaffrelot দেখিয়েছেন। গোলওয়ালকার জাতি (Nation) ও জাতীয়তাবাদ (Nationalism) সম্পর্কে তাঁর ধারণা তুলেছিলেন জার্মান আইনজীবী Jahan Kasper Blunt bill – লেখা থেকে। মুসলিমদের সম্পর্কে গোলওয়ালকারের অবস্থান সাভারকরের চেয়েও বেশি উগ্র ছিল:

“এক কথায়, ওরা (মুসলিমরা) বিদেশী হয়ে থাকাটা ছাড়ক (১৯) অথবা ওরা হিন্দু জাতির পুরোপুরি অধীনস্থ হয়ে দেশে থাকুক। কোন কিছু দাবি করা চলবে না, কোন বিশেষ সুযোগ সুবিধাও ওদের প্রাপ্য নয়। পক্ষপাতমূলক ব্যবহার পাওয়া তো দূরস্থ।মুসলিমদের এমনকি নাগরিক অধিকারও দেওয়া উচিত নয়।”(We or Our Nationhood Defined, পৃ-52)

১৯৩৯-এ The Mahratta জার্মানি ও ইতালির আন্তর্জাতিক নীতিকে সমর্থন জানিয়ে এক গুচ্ছ নিবন্ধ প্রকাশ করে কেশরী, একই বছরে ৮ ও ১৫ই ডিসেম্বর দু-পর্বে ছাপে “Failure of Democracy and Rise of Fascism’ শীর্ষক একটি রচনা। দু’জায়গাতেই ঘুরে ফিরে এসেছে ১৯২০-র দশকে প্রচারিত ব্যাখ্যা – গণতন্ত্রের সঙ্কট থেকেই ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব। ফ্যাসিবাদ নিশ্চিতভাবেই গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা। মারাঠী পত্র পত্রিকা যখন একনায়ক যুগল ও তাদের নীতিগুলো নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত তার আগে থেকেই ১৯৩৯-র শরৎকালে সাভারকরের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা চূড়ান্তভাবে জার্মানিকে তাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে বেছে নিয়েছিল। এই বছরেই হিন্দু দলের বক্তব্য ছিল এই রকম :

আর্য-সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ, স্বস্তিকাকে গৌরবমণ্ডিত করা, বৈদিক বিদ্যাচর্চার পৃষ্ঠপোষকতা এবং ইন্দো-জার্মানি সভ্যতার পরম্পরাকে তুলে ধরা—জার্মানির এই সব পবিত্র ভাবনাকে ভারতের ধর্মপ্রাণ ও বিচক্ষণ হিন্দুরা আশা ও আনন্দের সাথে স্বাগত জানিয়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু সমাজতন্ত্রী পণ্ডিত নেহরুর নেতৃত্বে জার্মানির বর্তমান সরকারের বিরোধিতার বুদ্বুদ তুলেছে। কিন্তু তাদের কার্যকলাপের কোন গুরুত্বই ভারতে নেই। আভ্যন্তরীণ নীতির ক্ষেত্রে জার্মানির অপরিহার্য প্রাণশক্তির বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীর ব্যর্থ অভিশাপপূর্ণ বক্তব্য সামান্যই সাড়া জাগিয়েছে। কেননা, এ কথাগুলো বলছেন এমন একজন মানুষ, যে দেশকে ধোঁয়াটে অতীন্দ্রিবাদের দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতা ও বিভ্রান্ত করে এসেছে। আমি মনে করি, আর্য-সংস্কৃতির সমস্ত শত্রুর বিরুদ্ধে জার্মানির ধর্মযুদ্ধ বিশ্বের সমস্ত আর্যজাতিকে সচেতন করে তুলবে এবং ভারতীয়রাও তাদের হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে জেগে উঠবে [এই ঘোষণাপত্রে রয়েছে Answartiges amt Politischen Archiv (AA- PA, Bonn)/Pol. VII, statement by the spokesman of the Hindu Mahasabha, March 25, 1939, উদ্ধৃত হয়েছে M. Houner, We or Our Nationhood Defined, পৃ:৬]।

চলবে…

গ্রন্থসূত্র: মহাফেজখানার দলিল

We or Our Nationhood Defined: গোলওয়ালকর