নাগপুরের নাগপাশ ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে! বিশ্বাস না হয় উত্তর প্রদেশের বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ চত্বরে শৃঙ্গার গৌরীর পূজার্চনা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং কলকাতা হাইকোর্টে দুর্গাপূজা কমিটিগুলোর জন‍্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ষাট হাজার টাকা করে বরাদ্দের বিরোধিতা করে করা মামলার রায়ের দিকে তাকান। দুটি মামলাতেই আদালতের রায়ে হিন্দুত্ববাদী শক্তি প্রাথমিকভবে জয়লাভ করেছে। মসজিদ চত্বরে ওজুখানার কাছে শৃঙ্গার গৌরীর পূজা করার জন‍্য সার্ভে করার জন‍্য বারাণসী কোর্টের রায় বহাল রাখা হল সুপ্রিম কোর্টে অন‍্যদিকে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে  পশ্চিমবঙ্গের প্রবল আর্থিক সংকট সত্ত্বেও সার্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটিগুলোর জন‍্য সরকারের ঘোষিত অনুদান বিতরণে কোন বাধা রইল না। রাজনৈতিক হিন্দুত্বের আধিপত্যের বিস্তার  বিজেপি ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির দুটি কেন্দ্র থেকে জয়ী হওয়া এবং বিপুল সংখ‍্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপির  ক্ষমতায় ফিরে আসবার পরেই সুনিশ্চিত হয়ে যায়। জাতীয় স্তরে অর্থনৈতিক  জীবন জীবিকার সংকট তীব্র হওয়ার কারণে এই মূহুর্তে বিজেপির পক্ষে ধর্মীয় কর্মসূচি নিয়ে এগোতে গেলে আগের মত জনসমর্থন যোগাড় করা মুশকিল তাই আর এস এসের অনুগামী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোকে ব‍্যবহার করে মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করার জন‍্য ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা করছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে জ্ঞানবাপী মসজিদ চত্বরে পূজার্চনা করার অনুমতি চেয়ে লক্ষ্মী দেবী,সীতা সাউ মঞ্জু ব‍্যাস এবং রেখা পাঠক নামে চারজন মহিলাকে দিয়ে  বারাণসীর আদালতে আবেদন করানো হয়। যুক্তি দেখানো হয় যে মসজিদের ভিতরে নাকি শিবলিঙ্গ রয়েছে এবং পিছনের দেওয়ালে দেব দেবীর মূর্তি খোদাই করা আছে। এই আবেদনের ভিত্তিতেই বারাণসী আদালত মসজিদের ভিতরে আবেদনকারী ও জ্ঞানবাপী মসজিদ কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে ভিডিও সার্ভে করার অনুমতি দেন। আদালতে পেশ করার আগেই  জলাধারে ” শিবলিঙ্গ”এর খবর  চলে আসে। আবেদনকারীর তরফে দুই আইনজীবী পিতা পুত্রের বিবৃতিতে শিবলিঙ্গের দৈর্ঘ‍্য আলাদা আলাদা হলেও তা নিয়ে বিতর্ক স্থায়ী হয়না। মসজিদ কমিটির পক্ষে বলা হয় যাকে শিবলিঙ্গ বলে প্রচার করা হচ্ছে তা আসলে ফোয়ারার একটি ভগ্নাংশ। শুধু তাই নয়,   আঞ্জুমান ইন্তেজামিয়া মসজিদ কমিটি ১৯৯১ সালের ধর্মস্থান আইনের উল্লেখ করে এই পূজার আবেদন খারিজ করার জন‍্য পাল্টা দাবি করলেও তা গ্রাহ‍্য করেনি আদালত। অথচ ১৯৯১ সালের আইন অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগষ্ট যে ধর্মীয়স্থানে যে উপাসনা হত তার কোন পরিবর্তন করা যায় না। বারাণসী আদালত মসজিদ কমিটির আবেদন খারিজ করার সময় যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে ঐ মসজিদে  মুসলিমদের নমাজ পড়ার অধিকার অক্ষুন্ন থাকছে। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপেও বারাণসীর জেলা আদালতে পূজার্চনার শুনানী চলার সবুজ সংকেত দেওয়া হয়। ফলে এই মামলার পিছনে সর্বশক্তি দিয়ে সাংগঠনিকভাবে  হিন্দুত্ববাদীরা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট অবধি মরিয়া আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়াতেই তা স্পষ্ট।


 গত ১২ ই সেপ্টেম্বরে বারাণসী আদালতের রায়ে বলা হয়েছে পূজার্চনার আবেদনের ভিত্তিতে  সার্ভে চলবে যদিও মসজিদের বয়স জানবার জন‍্য কার্বন টেস্ট করার আবেদন গ্রাহ‍্য করা হয়নি। মোটামুটি ১৬৬৯ সালে আওরঙ্গজেবের আমলে ধ্বংস হওয়া  বিশ্বেশ্বরের মন্দির পুনরুদ্ধারের হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচিতে আপাতত আইনি সীলমোহর যেভাবে পড়ল তা বাবরি মসজিদ চত্বরে রামমন্দিরের ভিতপূজো করার অনুমতির চেয়ে কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। হিন্দু মুসলিম দু পক্ষের মৌলবাদীরাই এই আইনি পদক্ষেপের ব‍্যখ‍্যা নিজেদের মত করে দেওয়া শুরু করেছে। উভয় পক্ষের ভাষ‍্যেই সাম্প্রদায়িক সংঘাতের প্ররোচনা বিন্দুমাত্র গোপন নেই।  তবে নিঃসন্দেহে আজকের ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে হিন্দুত্ববাদীদের মসজিদ দখল করে মন্দির বানানোর শ্লোগান মুসলিম ধর্মগুরুদের মসজিদ হাতছাড়া হওয়ার জিগিরের থেকে বেশি বিপজ্জনক। কারণ হিন্দু মৌলবাদীরা এখন ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের পুরোপুরি সমর্থন পায়। বিচার ব‍্যবস্থার প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখেও বলা যায়  সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, ব‍্যক্তিগত ভাবনাচিন্তার স্তরে বেশ কয়েকজন  বিচারপতি সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের প্রতি কার্যক্ষেত্রে আনুগত্য বজায় রাখতে পারেন না। আইনি প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকেও  অজান্তেই সংঘ পরিবারের আদর্শে ভারতের রাষ্ট্র কাঠামোকে পরিবর্তন করার কর্মসূচিতে তাঁরা পরোক্ষভাবে সমর্থন করছেন এমন কথা বললে অত‍্যুক্তি হবে না। আপাতত ঠাণ্ডা মাথায় তাঁদেরই কাজে লাগাচ্ছে ভারতীয় জনতা পার্টি। 

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিশেষ ধর্মের উৎসবে আয়োজক‍দের সরকারি অর্থে সহায়তা করার সিদ্ধান্তে আইনি অনুমোদন আদায়ের পিছনেও একই রাজনীতি কাজ করছে। দুর্গাপূজার মত বাঙালির জাতীয় উৎসবকে রাজনীতির প্রভাব বিস্তারের কাজে তৃণমূল কংগ্রেস আর এস এস নির্দেশিত পথেই ব‍্যবহার করছে। নইলে পূজোকমিটিগুলি কে মুখ‍্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সরকারি পয়সায়  কার্নিভালে অংশগ্রহণ করিয়ে ভোটে সেই সব ক্লাবের কর্মকর্তাদের কাজে লাগানোর উদ‍্যোগ নেওয়া হবেই বা কেন! শাসক দলের নেতাদের  গণেশ পূজা থেকে  দুর্গা পূজা,হয়ে জগদ্ধাত্রী পূজায় উৎসাহ বাড়ার অন‍্য কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।