লোকসভা নির্বাচনের আগে নতুন বছরের ফেব্রুয়ারির পয়লা তারিখ ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন যে ভোট অন অ্যাকাউন্ট প্রস্তাব পেশ করেছেন,তাতে প্রবল আত্মবিশ্বাসের ছাপ দেখে মিডিয়ার বিশেষজ্ঞদের একাংশের আনন্দের সীমা নেই। মধ্যবিত্তের আয়কর কাঠামোতে ছাড় না রেখে কৃষকদের ফসলের ন্যায্য বিক্রয়মূল্য ঘোষণা না করে, যুবসমাজের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না করে নির্বাচনের আগে সাময়িক ব্যয়বরাদ্দ পেশ করার সাহস করা মানেই নাকি অর্থমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন কেন্দ্রে আবার নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ফিরছে। কেন? বাইশে জানুয়ারি রাম মন্দিরের উদ্বোধন হয়েছে যে! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তো বার বার বলছেন যে, মন্দির নির্মাণ করলেই কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি গুয়াহাটিতে তিনি সরকারি প্রকল্প উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় বলেছিলেন, যে, সংকটকালে ধর্মের আশ্রয় নিয়েই উদ্ধার পেতে হয়। স্বাধীনতার পর থেকে এর আগে যেসব সরকার কাজ করেছে, প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, তারা নাকি “এদেশের ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে অস্বীকার করেছে!” কিন্তু প্রশ্ন থাকছে, দু কোটি বেকারের চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৪ সালে প্রথমবার লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবেই বিপুল ভোটে জয়লাভ করে নরেন্দ্র মোদি।
দশ বছরের মাথায় দ্বিতীয়বার সরকার পরিচালনার নেতৃত্ব দেওয়ার পরে দেখা যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বে প্রায় পঁয়তাল্লিশ শতাংশ বেশি বেকার সমস্যা বেড়েছে। শুধু তাই নয়, বেতনভুক কর্মচারী ও অসংগঠিত শ্রমিক – দু তরফের আয় কমেছে। শিল্পে নতুন বড়ো অঙ্কের টাকার বিনিয়োগ না হলেও কুড়িটি কোম্পানির কবজায় দেশের নব্বই শতাংশ মুনাফা এবং এর মধ্যে অবশ্যই থাকছেন গৌতম আদানির গোষ্ঠী,যারা স্বাধীনতার পর ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত যোগাযোগের সৌজন্যে নিজেদের শিল্প সংস্থাকে মুনাফার পাহাড়ে তুলে এনে দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। যে উন্নয়নের ঢাক পিটিয়ে ভারতকে পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করে গর্ব বোধ করেন প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর বশংবদ মিডিয়ার সাংবাদিকরা,সেই উন্নয়নের বৃত্তে উচ্চবিত্তরা থাকলেও গরীব মানুষরা নেই। এবং কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকট যেভাবে আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত সমাজের ওপর ফাঁস হয়ে চেপে বসছে,তার ফলস্বরূপ গত চার বছরের মধ্যে অনেক পরিবারের আয়ের উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কর্মচ্যুতির কারণে এবং স্বচ্ছল ক্রেতা হিসাবে যোগ্যতা থাকা মধ্যবিত্তদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট এবং ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত সমাজের দায় পাছে নিতে হয় সেজন্য কোন সাংবাদিক সম্মেলন করেন নি প্রধানমন্ত্রী।
তাতে অবশ্যই গা বাঁচাতে পারেন নি প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দল। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কিছু সংবাদের চ্যানেলের সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে সাধারণ মানুষ বিশেষত বেকার সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থতার কথা তুলে ধরছেন,মন্দির মসজিদ নিয়ে ধর্মীয় বিভাজনকে অর্থহীন বলে ক্ষোভে ফেটে পড়ছেেন। তাঁরা বলছেন, মণিপুরে জাতিদাঙ্গা মেটাবার বদলে মেইতেইদের কুকিদের বিরুদ্ধে উসকানি দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদিরা। সে রাজ্যে নারীনির্যাতনকে রাজনৈতিক প্রতিশোধের সংস্কৃতিতে পরিণত করেছে বিজেপি। সংসদে প্রধানমন্ত্রী নীরবতা নিয়ে ক্ষোভ ছড়িয়েছে দেশজুড়ে। অন্যদিকে একাধিক দুর্নীতি ফাঁস হয়েছে আদানিগোষ্ঠীকে ঘিরে। সংসদের নিম্নকক্ষে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সে বিষয়ে আলোচনা এগোতে দেওয়া হয়নি। গত সাড়ে চার বছরে আমরা দেখেছি প্রত্যক্ষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াই সমর্থক হিসাবে গোয়া মেঘালয় মহারাষ্ট্রের মত রাজ্যে নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরেও সরকারের শরিক হয়েছে বিজেপি। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশকুমারকে ইচ্ছামতো রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে তারা তদন্তকারী সংস্থাকে দিয়ে মহারাষ্ট্রে দরকষাকষি করে একনাথ শিণ্ডেকে শিবসেনা থেকে ভাঙিয়ে এনে সরকার গঠনের ঘটনা খুব বেশি পুরোন নয়। পশ্চিমবঙ্গে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের গোপন বোঝাপড়া ক্রমশ প্রকাশ্যে আসছে। নিয়োগ দুর্নীতি ও রেশন দুর্নীতির পাহাড় প্রমাণ অভিযোগের মাথা যারা তাদের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও গ্রেফতার করা হয়নি শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ভোটে বামপন্থীদের ঠেকিয়ে রাখার জন্য। নির্বাচনী রাজনীতিতে যাবতীয় জালিয়াতি ও গুণ্ডামির ফায়দা তৃণমূল কংগ্রেস যতটা পায় বিজেপিও ঠিক ততটাই পায়। ফলে লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি বিরোধী INDIA মঞ্চ গড়ে তোলার সময় মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল কংগ্রেস,নীতিশকুমারের জেডিইউয়ের মতোই বন্ধুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নীতিশকুমারের মতো সরাসরি এন ডি এ তে ফিরে না গেলেও প্রকাশ্য সভায় মমতা ব্যানার্জী যেভাবে কংগ্রেসের চল্লিশটির কম আসন পাওয়ার ভবিষ্যদ্বানী করেছেন তাতে বুঝতে অসুবিধা হয়না তিনি কাদের হয়ে কাজ করছেন।
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে তাই বিজেপির কাছে বৃহৎ ধনীদের স্বার্থে সরকার পরিচালনার জন্য জনগণকে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি দিয়ে বিভ্রান্ত করার রাজনীতি ছাড়া আর কোন কৌশল অবশিষ্ট নেই। কর্মসংস্থানের দাবি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার কমানোর দাবি, সমকাজে সমবেতনের দাবি সামনে আনতে পারলে হিন্দু মুসলমানের বাইনারি নিয়ে মিডিয়ার প্রচারের টা ভেঙে যাবে। বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তি সেই প্রচারের কাজটায় ঝড় তুললে বাজারি মিডিয়া ও বিজেপির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকফুটে চলে যাবে।