নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ বিজেপির জনসমর্থনের হারানো জমি পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে কতকটা মরীয়া হয়েই বিজেপি বিরোধী “ইণ্ডিয়া-” যুক্ত মঞ্চের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাচ্ছেন এবিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া গিয়েছে ৮ই আগষ্ট থেকে ১০ই আগষ্ট সংসদের অভ‍্যন্তরে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে প্রবল বিতর্কের সময়েই। প্রধানমন্ত্রী সংসদে মণিপুরের জাতিদাঙ্গা ও ভয়াবহ নারীনিগ্রহ নিয়ে কেন নীরব ছিলেন সেই সঙ্গত প্রশ্ন তুলে বার বার বামপন্থী এবং কংগ্রেস সহ বিরোধীরা জনসভা থেকে মিডিয়া সর্বত্র সোচ্চার হয়েছিলেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী উদার মুক্তচিন্তার প্রবক্তা সমাজকর্মী সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ গোরক্ষকদের তাণ্ডব থেকে উন্নাও হাথরসের বীভৎস নারী নির্যাতন এবং হত‍্যার ঘটনাতেও যেমন কোন প্রতিক্রিয়া জানান নি মণিপুর এবং হরিয়ানার ক্ষেত্রেও তার ব‍্যাতিক্রম ঘটেনি। বস্তুত অনাস্থা প্রস্তাবের জবাবী ভাষণে সংসদে যখন নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার মণিপুরের ঘটনার উল্লেখ করেন তখন বিরোধী পক্ষের সাংসদরা ওয়াক আউট করে কক্ষে র বাইরে।কিন্তু মোদি নিজেই জানেন,সংসদে তাঁর দু ঘন্টা বারো মিনিটের বক্তব্যে মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে রাজনীতি না করার উপদেশ থাকলেও তিনি নিজে নিছক সংকীর্ণ রাজনীতি ছাড়া যে কাজটা করেছেন,তা হলো তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বক্তৃতার রেশ টেনে নিজের কাজের প্রশস্তি। এবং মণিপুরের ঘটনা আড়াল করার জন‍্য আত্মপ্রচারের কৌশলে নরেন্দ্র মোদি প্রমাণ করেছেন এই কাজটা তাঁর থেকে বেশি ভালো অন‍্য কোন রাজনৈতিক নেতা পারেন না। গত ১০ ই আগষ্ট তাঁর জবাবি ভাষণ চলাকালীন বিরোধীদের সংসদ কক্ষ থেকে ওয়াক আউট করার সময় নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ” গণতন্ত্রে যাদের আস্থা নেই,তারা শুধু শোনাতে পারে শোনার ধৈর্য নেই।” অনেকেই বলছেন, আসলে কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতা অধীর চৌধুরী নরেন্দ্র মোদি ১০ই আগষ্ট সংসদকক্ষে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে বক্তৃতা থামিয়ে যেভাবে বলেছিলেন, “এই জন‍্যই বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব এনেছেন,যাতে প্রধানমন্ত্রী সংসদে আসতে বাধ‍্য হন! এটাই গণতন্ত্রের শক্তি!” তা নরেন্দ্র মোদির অহংকারে প্রবলভাবে আঘাত করেছিল। সেই কারণেই ২০ শে জুলাইয়ের অধিবেশন শুরু হওয়া থেকে অনুপস্থিত থাকা প্রধানমন্ত্রী অনাস্থা প্রস্তাবের বিতর্কের দিনগুলোতেও উপস্থিত না থেকে শুধুমাত্র জবাবী ভাষণ দিতে হাজির হয়ে বিরোধীদের বিদ্রূপ করা ছাড়া বিশেষ কিছুই করতে পারলেন না। তাঁর সহকর্মী নারী ও শিশু কল‍্যাণ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানী উড়ন্ত চুমু র গল্প শুনিয়ে যতটুকু হাওয়া গরম করতে পেরেছিলেন মোদি সেটুকু রেশ ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন মণিপুরের অশান্তির জন‍্য কংগ্রেসকেই দায়ী করে। তিনি নিজে অশান্ত মণিপুরে পা রাখেন নি কেন সে বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য শোনা যায় নি প্রধানমন্ত্রীর মুখে।

২০০২ সালে গুজরাটে গণহত‍্যার পরে নরেন্দ্র মোদি বারো বছর সেই রাজ‍্যের মুখ‍্যমন্ত্রী ছিলেন। সেই রাজ‍্যের ৯.৬৭ শতাংশ মুসলিম এখন ভয়ে কাঁটা হয়ে টিকে থাকতে শিখেছেন। গুজরাটের শহরাঞ্চলে গরীব মুসলিম এলাকাকে বিচ্ছিন্ন রাখার সরকারি পৌর উদ‍্যোগ দেখে সন্দেহ হবে ঘেটো সংস্কৃতি বকলমে চালু হয়েছে কিনা। নিজের রাজ‍্যে এ হেন শাসন চালু করা মুখ‍্যমন্ত্রীকে তাঁর দল ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে ভোটে দাঁড় করানোর পিছনে যে ভারতের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় ব‍্যবস্থার পরিবর্তন প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তা সেই নির্বাচনে বামপন্থীদের প্রচারেই বার বার উঠে এসেছে। কিন্তু প্রসূন যোশী ও পীযূষ পাণ্ডের পেশাদারি পরিকল্পনায় এবং সোহো স্কোয়ার, ওগিলভি অ‍্যাণ্ড মাথের ও মিডিয়ার প্রচার সংগঠন ম‍্যাডিসন ওয়ার্ল্ড ততদিনে আব কি বার মোদি সরকার, আচ্ছে দিন আনেওয়ালে হ‍্যায় এবং বিদায়ী কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউ পি এ সরকারকে লক্ষ্য করে প্রচারিত জনতা মাফ নেহি করেগি – শ্লোগান প্রবল বেগে ছড়িয়ে পড়েছে পত্রপত্রিকা ও টিভি রেডিওর মাধ‍্যমে। ফলে ২০১৪ সালের মে মাসে সংসদকক্ষে প্রবেশ করার সময় সিঁড়ির ধাপে কপাল ঠেকানো নরেন্দ্র মোদির ছবিটা এককভাবে বিজেপির জেতা ২৮২ টি লোকসভা আসনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল এমনভাবে যে, রাজনৈতিক হিন্দুত্বের আগ্রাসী চেহারা কিছুদিনের জন‍্য চাপা পড়েছিল। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির আচ্ছে দিনের মর্ম ২০১৫ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর হিংস্র উন্মত্ত গোরক্ষকদের হাতে নিজের জীবনের বিনিময়ে বুঝলেন উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে বাহান্ন বছরের প্রৌঢ় মহম্মদ আকলাখ।তার আগেই অবশ‍্য মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে বামপন্থী নেতা ও কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক গোবিন্দ পানেসরকে হত‍্যা করা হয় ১৬ ই জুন। ৩০শে আগষ্ট কর্ণাটকের ধাড়বারে নিহত হন যুক্তিবাদী উদার চিন্তাধারার প্রচারক লেখক অধ‍্যাপক এম এম কালবূর্গী তারপর থেকে শুধুমাত্র গোরক্ষকদের হাতে ২০১৭ সালে কুড়িজন মুসলিম খুন হয়েছিলেন। প্রথম তিনবছরেই সংখ‍্যাটি পৌঁছে যায় ২৮ এ। ২০১৭ সালের ৫ ই সেপ্টেম্বর সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে নিরন্তর লিখে যাওয়া সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে হত‍্যা করা হয়েছিল। ২০২১ অবধি কেবল গোরক্ষা সংক্রান্ত হিংসায় আক্রান্ত মুসলিমের সংখ‍্যা দাঁড়ায় ১২৪ জন । এর মধ‍্যে ৫২ শতাংশ ছড়িয়েছিল সাম্প্রদায়িক গুজবের মাধ‍্যমে। গোরক্ষার জন‍্যই নয় ২০১৯ সালের ২২শে জুন ঝাড়খণ্ডে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয় তবরেজ আলমকে। এই ঘটনার মাত্র একুশ দিন আগে দ্বিতীয়বারের জন‍্য প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। তাঁর রাজনৈতিক হিন্দুত্বের আদর্শের জয়ধ্বজা উড়িয়ে দিতে তিনি বেশি সময় নেন নি সংসদের সংখ‍্যাগরিষ্ঠতার জোরে কাশ্মীরের ৩৭০ ধারার বিলোপ ঘটালেন ২০১৯ সালের ৫ ই আগষ্ট এবং অযোধ‍্যায় রামমন্দিরের শিলান‍্যাস করলেন ২০২০ সালের ২২শে জুলাই। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত অনুগামী হরিয়ানর মুখ‍্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টরের সরকার যখন সাম্প্রদায়িক অশান্তি দমনের নামে মুসলিমদের বাড়ি দোকান বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে ব‍্যস্ত তখন পাঞ্জাব হরিয়ানা হাইকোর্ট সেই সিদ্ধান্তের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে মন্তব‍্য করেছেন,”সরকার কি একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছে?” ভুল কিছু বলেন নি। এই লেখা যখন লিখছি তখন হরিয়ানার নূহ্ তে বিভিন্ন গ্রামে মুসলিমদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এই ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতিকে যারা মান‍্যতা দেয় তাদের মুখে গণতন্ত্রের কথা মানায় কি?

যাঁরা ২০১৯ থেকেই আশঙ্কা করছিলেন পুলওয়ামার ঘটনায় নিহত সৈনিকদের মৃতদেহ নিয়ে রাজনৈতিক প্রচার সংগঠিত করে যেভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৯ সালে ভোটে জিতলেন তাতে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসবার পরে তিনি দ্রুত রাষ্ট্রব‍্যবস্থায় নিজেদের আধিপত্য কায়েম করবেন তাঁদের কপালে চিন্তার ভাঁজ গভীরতর হয়েছে সংসদের বাদল অধিবেশনে পাশ হয়ে যাওয়া দুটি বিলের চরিত্র দেখে। প্রথম বিলটি পাশ হয়েছিল গত ৮ ই আগষ্ট।সেদিন ব‍্যক্তিগত তথ‍্যের অধিকার সুরক্ষা বিলটি পাশ করিয়ে প্রকৃতপক্ষে বেসরকারি সংস্থাকে টাকার বিনিময়ে যেকোনো নাগরিকের তথ‍্য সংগ্রহ করার অধিকার দেওয়া হলো। যে পথে নাগরিকদের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি শুরু হওয়ার সম্ভাবনাও থাকছে। দ্বিতীয় বিলটি পেশ হয়েছে গত১০ই আগষ্ট রাজ‍্যসভায় যেখানে মুখ‍্য নির্বাচন কমিশনারের বাছাই করার কমিটি থেকে প্রধান বিচারপতিকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ক‍্যাবিনেটের মন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতার কমিটি মুখ‍্য নির্বাচন কমিশনার ও অন‍্য দুজন কমিশনারকে মনোনীত করবেন। অথচ বিচারপতি কে এম জোসেফের নেতৃত্বে পাঁচ সদস‍্যের কমিটির রিপোর্টে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার স্বার্থে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে এই কমিটিতে রাখার প্রস্তাব রেখেছিলেন। নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের দাবী অগ্রাহ‍্য করে তারা গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষায় যত্নবান হবে,এমন আশা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।