শেখ নাসিমুদ্দিনের ব্যাগ পাওয়া গেছে। ওগো কলকাতা শোনো, শুনে যাও একবার। ট্রাফিক জুড়ে রবীন্দ্র গান, একটু থামবেন প্লিজ। বলছি যে, শেখ নাসিমুদ্দিনের ব্যাগ পাওয়া গেছে। এসএসকেএম-এর মর্গের সামনের বারান্দায় বসে আছে ২৬ বছরের ব্যাগ। নতজানু নিশ্চুপ। তার পাশেই রাখা আছে আরেকটি ব্যাগ। শেখ আব্দুল্লার। এই ব্যাগের বয়স ১৮। নিতান্ত সাদামাটা পরিচিত স্কুল ব্যাগ। ধর্ম তলায়, গড়িয়াহাটে, শিয়ালদায় ফুটপাতে সারিসারি ঝুলতে থাকা যে কোন ব্যাগের রঙে এদের আপনি মিশিয়ে নিতে পারেন। আঠারো  বছরের ব্যাগ তুলনায় বেশি চঞ্চল। মর্গের অমোঘ নিস্তব্ধতার সামনে বসেও ব‍্যাগটা ইতিউতি দেখছে। হা! কলকাতা বড় শহর বটে! এখানকার পাশ দেওয়া লোকেদের জানা বুঝা অনেক! 

২৬ বছরের ব্যাগ এসেছে মুর্শিদাবাদ  থেকে। হাজারদুয়ারীর বাকি নয়শো নিরানব্বইটা দরজা বন্ধ হওয়ার পর এই একটি রাস্তাই বোধ করি খোলা ছিল। রাজমিস্ত্রির কাজ। তাই  লোকাল কিংবা এক্সপ্রেস ট্রেনের ঝোলানো শিকে ব্যাগ জায়গা করে নিল। তারপর- ‘দে দোল দে দোল’। চল কলকাতা। কলকাতা চল। ওখানে আছে কাজ। অগত্যা সন্তান পরিবার, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে  রেখে ব্যাগ চলে এসেছে কলকাতায়। ঈদে বাড়ি ফেরার কথা ছিল। কে জানে সঙ্গে উপহারও নেওয়ার কথা ছিল হয়তো। ওই যে এসএসকেএম হাসপাতালের মর্গের সামনে শান্ত একটি ২৬ বছরের ব্যাগ পরিবারের জন্য কী কী উপহার কেনা যায় ভাবছে। বউয়ের শাড়িটা কী রংয়ের হলে ভালো হয় বলেন দেখি!

১৮ বছরের ব্যাগটার চঞ্চলতা আপনি অনুমান করতে পারবেন। খানাকুল থেকে কলকাতায় আসার আগে এই বয়সেই সে ঘুরে এসেছে ভিন রাজ‍্যে। ভালো করে নজর করলে এই ব্যাগে আপনি পেয়ে যেতেই পারেন রাজস্থানের বালি কিংবা জব্বলপুরের পুরনো বাসের টিকিট কিংবা চেন্নাইয়ের ধোসার দাগ। ঈদ উপলক্ষে ব্যাগ ফিরেছিল বাড়িতে। কিন্তু কয়েক মাসের বিয়ে হওয়া সংসার, বসে থাকলে তো চলে না।  কাজ চাই টাকা চাই। তার ওপর জীবন বীমা থেকে নেওয়া ঋণের টাকা শোধ করতে হবে তাড়াতাড়ি। তাই বউয়ের বারণ করা সত্ত্বেও ১৮ বছরের ব্যাগ রাজমিস্ত্রির কাজে কলকাতায়। হায় কলকাতা! ১৮ বছরের জীবনের ঋণ তুমি শোধ করবে কীভাবে?

কোন্‌ বাস, কোন্‌ ট্যাক্সি এই দুটো ব‍্যাগকে আজাহার মোল্লাবাগান এলাকায় পৌঁছে দিয়েছিল আমরা জানি না। পৌঁছানোর পর থেকে সারাদিন হাড়ভাঙা  খাটনি, রোজ হিসাবে কাজ। কেন বাপু ২৬ বছর, কেন ভাই ১৮ বছর, ভগবানগোলা থেকে খানাকুল থেকে কেন এরকম চলে আসো তোমরা? ভাত চাই, ফ্যান চাই, কাজ চাই বললেই হল? ঘরের ব্যাগ ঘরে থাকবে, জুটলে খাবে না জুটলে খাবে না! ফি বছর ভোটার লিস্টে অ্যামিবার মত থেকে যাবে, ওইটুকুতে তোমরা সন্তুষ্ট নও? বড়ো লোভ তোমাদের, জানো তো বড়ো লোভ! সন্তানের মুখের হাসির লোভ, বউয়ের ছাপা শাড়ির লোভ, আত্মসম্মানের লোভ, বাঁচার লোভ। লোভী না হলে কোথায় কোন্‌ বিল্ডিং বানানো হচ্ছে তার জোগাড়ের কাজ করতে, মিস্ত্রির কাজ করতে এরকম বেমালুম চলে এলেই হল??

২৬ বছরের ব্যাগের অবশ্য এসব প্রসঙ্গে মাথা ব্যথা নেই। ১৮ বছরের ব্যাগ ও বেখবর। ওই যে ৫১৩/৫ ব্যানার্জি পাড়া লেন। রাজধানী কলকাতার ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ড। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। গা-হাত-পা ধুয়ে নির্মীয়মান বহুতলের দোতলা বা তেতলার খোলা মেঝের উপর গা এলিয়ে  দিয়েছে ২৬ বছরের ব্যাগ। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রাতের খাবারের ব্যবস্থা দেখছে ১৮ বছরের ব্যাগ। হয়তো ডিমের ঝোল কিংবা কপালে জুটলে গিলে মেটে। সদ‍্য প্লাস্টার হওয়া দুটো থামে বাঁধা দড়িতে ঝুলছে জামা কাপড়। নবাব ওয়াজেদ আলীর  দেড়শো বছরের পুরনো নিঃশ্বাসমাখা হাওয়া থামগুলো ছুঁয়ে এগিয়ে যাচ্ছে গার্ডেনরিচ মেটিয়াবুরুজ পার হয়ে  দূর নদী সমুদ্রের দিকে। লাল নাইলনের দড়িতে পতপত উড়ছে জীবনের নিশান, পরিযায়ী লুঙ্গি। 

সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হল। আটটা বাজল,তারপর দশটা, তারপর এগারোটা,তারপর… না তারপরের খবর আমরা জানিনা। জানেনা এই ব্যাগেরাও। অনেক সময় পেরিয়ে দুই ব্যাগের আবার দেখা হয়েছে এসএসকেএম এর মর্গের সামনের বারান্দায়। তখন থেকে ওরা এখানেই বসে।

একটা লম্বা স্ট্রেচারের পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে আছে ২৬ বছরের ব্যাগ। চোখের কোণে বুঝি মায়া লেগে আছে এইটুকু। এক মাসের প্রার্থনার শেষে আকাশে উঠবে খুশির চাঁদ আর সন্তানের হাত ধরে স্কুল মাঠের ডান দিক দিয়ে হেঁটে সে এসে দাঁড়াবে মসজিদের চাতালের সামনে। প্রার্থনা করবে। চাইবে শান্তি, সুখ,আনন্দ। এসব স্বপ্নই বুঝি  দেখছে সে। আর ১৮ বছরের ব্যাগ? ওই যে ছটফটে, ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে একটা সাদা গাড়ির দিকে। বানান করে পড়ার চেষ্টা করছে ‘স্বর্গ রথ’। ওই দিন সন্ধ্যায় বউকে ভিডিও কল করতে চেয়েছিল ১৮ বছরের ব‍্যাগ। বউ বলেছিল শরীলটা ভালো না, ভিডিও কল করা লাগবে না।  ভিডিও কলে বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কী আলাপ করে এসব ব্যাগেরা? ভালবাসার? আহ ভালবাসা! বিরক্ত করো না। আর কয়েকটা… আর কয়েকটা টাকা জমাতে পারলেই আমি বাড়ি চলে যাব গো।

 জলের নিচে মেট্রোর গতিতে ছুটে চলা কলকাতা, মিছিল মিটিং প্রতিবাদের কলকাতা, দলে থেকে কাজ করতে পারছি না -র কলকাতা, সামাজিক ব্যাধির কলকাতা, আমার ভালবাসার কলকাতা, শোনো। এত নিশ্চিন্ত থেকো না। আমার মাথার উপরে তো ছাদ অটুট ভেবে আজ ঘুমিয়ে পড়তে পারো, হেলে যাওয়া বাড়ি নিয়ে চমৎকার মিম বানাতে পারো কিন্তু শোনো, নাসিমুদ্দিনের ব্যাগ কিন্তু পাওয়া গেছে। ব্যাগ পাওয়া গেছে আব্দুল্লারও। আজ না হোক কাল, কাল বাদে পরশু,তারপরের দিন কিংবা তারপরের দিন ওই ব্যাগগুলোর সমস্ত বন্ধ চেন খুলে যাবে। ব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে আরো ব্যাগ,তার ভেতর থেকে আরও ব্যাগ, তার ভেতর থেকে আরও ব্যাগ, তার ভেতর থেকে আরো, তার ভেতর থেকে…… তারপর যেমন তোমার নাকের ডগা দিয়ে নিশ্চুপে হাওড়া বা শেয়ালদা হয়ে এই দুটো ব্যাগ ঢুকে পড়েছিল গার্ডেনরিচে তেমনি একেকটা ব্যাগ ঢুকে পড়বে কোন না কোন ঘুষখোর মন্ত্রীর ড্রয়িং রুমে! বসে পড়বে কোন লোভী প্রোমোটারের বউয়ের দামি ব্যাগের পাশে! মেরুদণ্ড বন্ধক দেওয়া অসাধু পুলিশ কিংবা কর্পোরেশনের অফিসারের মোটা মানিব্যাগের উপর লাফিয়ে পড়বে হালুম করে! তারপর.. সমস্ত ব্যাগ এক হয়ে… তারপর.. তারপর…

আঃ চুপ যা! ২৬ বছরের ব্যাগ মৃদু ধমক দেয় ১৮ বছরের ব‍্যাগকে। মর্গের সামনে এত কথা বলতে নেই। এত কথা আগে থেকে বলতে নেই। শোনো, শোনো, কলকাতা, দু মিনিট শোনো। এত নিশ্চিন্ত থেকো না তুমি। নাসিমুদ্দিনের ব্যাগ কিন্তু পাওয়া গেছে। ব্যাগ পাওয়া গেছে আব্দুল্লার। ব্যাগসকল ‘প্রতিশোধ নেবে’!  হে আমার শহর কল্লোলিনী, ২৬ বছর কিংবা ১৮ বছরের ব্যাগেদের বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার, কান্না, বিলাপ কিংবা ক্রোধে ফেটে পড়ার শব্দ কি তুমি শুনতে পাচ্ছো?