বামপন্থী ছাত্রসংগঠন থেকে গণসংগঠনসমূহ, সবাই সোচ্ছার জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ বিরুদ্ধে।

কেন ক্ষতিকারক ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি ?

              সৌম্যশান্ত রিজওয়ান রক্ষিত

মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার বিগত দশ বছর যাবৎ সময়কালে দেশের নানা সম্পদ রেল, ব্যাঙ্ক, বিমানবন্দর, খনিজ সম্পদ প্রভৃতিকে যেভাবে কর্পোরেটের হাতে তুলে দিয়েছে, ২০২০ সালে ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসির প্রণয়ন একই ভাবে দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে বেসরকারিকরণের দিকে অনেকখানি ঠেলে দিয়েছে। সূক্ষ্ণ ভাবে এই শিক্ষা নীতির প্রতিটা বিষয়কে যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে বোঝা যাবে আদতে শিক্ষাব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি করে, শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে, কর্পোরেট সংস্থাসমূহের হাতে শিক্ষাকে তুলে দিয়ে পড়াশোনার খরচ বাড়িয়ে, শিক্ষা কে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ভাবে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার এক অনবদ্য প্রয়াস হল এই ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি।

যেভাবে এই নীতিকে কেন্দ্রীয়করণের মধ্যে দিয়ে UGC -র শক্তি খর্ব করে রাষ্টীয় নীতি আয়োগের মধ্যে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার, প্রধানমন্ত্রীকেই শিক্ষাব্যবস্থার শিখরে রাখা হয়েছে তাতে, তাতে সুস্পষ্ট শিক্ষার মত একটি সংবেদনশীল, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করার ন্যূনতম সদিচ্ছা বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের নেই।

নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী নতুন সিলেবাসে যেভাবে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ কে ইতিহাস বলে চালানোর প্রচেষ্টা চলছে তা অনৈতিক।  এই সিলেবাস প্রাচীন ভারতের জাতিভেদ প্রথার সূচনা সম্পর্কে অদ্ভুত ভাবে নীরব। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে সংস্কৃত ভাষার উপর অনাবশ্যক গুরুত্ব দিয়ে নানা আঞ্চলিক ভাষার ঐতিহ্যকে খর্ব করেছে তা থেকে স্পষ্ট এই শিক্ষানীতি অসাংবিধানিক ও শিক্ষার সাম্প্রদায়ীকরণের এক উল্লেখযোগ্য ধাপ।

মিষ্টি আকর্ষণীয় শব্দ দিয়ে খোলনলচে বানিয়ে এই নীতি সমতার কথা বললেও আদতে এই শিক্ষানীতি চূড়ান্ত সমতা বিরোধী।

চৌত্রিশ বছর পর ভারতীয় শিক্ষানীতির যেখানে পরিবর্তন আসছিলো, সেই পরিবর্তন কীভাবে হবে তা সাংসদে আলোচনাসাপেক্ষ ছিল। কোনোরকম আলোচনা না করে তৎকালীন অতিমারী পরিস্তিতির সুযোগ নিয়ে যেভাবে এই শিক্ষানীতিকে আরোপ করা হয়েছে তাতে কেন্দ্রীয় সরকাতরের ফ্যাসিবাদী মানসিকতারও বহিঃপ্রকাশ হয়।

জাতীয় শিক্ষানীতি যেভাবে অনলাইনে পড়াশোনার করার পদ্ধতি কে সমর্থন করছে তা ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে বিভাজনের মানসিকতাকে তৃণমূল স্তর থেকে বহন করতে শেখায়। শ্রেণীকক্ষে বসে একসাথে পড়াশোনা যেভাবে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যূথবদ্ধতার পাঠ শেখায়, নতুন শিক্ষানীতি সেই পাঠ থেকে ছাত্রছাত্রীদের সম্পূর্ণ ভাবে বঞ্চিত করবে।

নতুন শিক্ষানীতি প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষার্থীদের খেলার ছলে পাঠ দেওয়ার অভিমত দিয়েছে, তা ভারতবর্ষের মত দেশে সাফল্যের সাথে বাস্তবায়ন করা একরকম কাল্পনিক। শুধুমাত্র তাই নয়, প্রবল ভাবে আশঙ্কা করা যায় এইভাবে শিক্ষাদান প্রাথমিক স্তর থেকে গভীরে গিয়ে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অনুধাবন করার যে মানসিকতা তা শিশুমন থেকেই নষ্ট করে দেবে। স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি কার্যধারা ও সিলেবাসের যে বিন্যাস তা প্রচন্ড রকমের গোলমেলে। কীভাবে গোটা দেশে এই শিক্ষানীতি কে বাস্তবায়িত করা যাবে তার কোনো সঠিক রূপরেখা এই নতুন শিক্ষানীতি তে নেই। 

কেরালা, তামিলনাড়ুর মত প্রথম থেকে এই শিক্ষানীতির বিরোধীতা পশ্চিমবঙ্গ সরকার করলেও, সাম্প্রতিক কালে প্রায় একশো আশি ডিগ্রি নিজেদের অবস্থান বদল করে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই নিতুন শিক্ষানীতি পশ্চিমবঙ্গে আরোপ করার কথা ঘোষণা করেছে।

পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার যে করুন দশা বিগত দশ বছরে হয়েছে, গোটা শিক্ষাপরিকাঠমোর সেই কঙ্কালসার চেহারা আমাদের সামনে উঠে এসেছে। দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষক নিয়োগ নেই। দ্রুত হরে সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষকদের সংখ্যার সাথে সাথে কমেছে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা। ২০২৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে এক ধাক্কায় প্রায় চার লক্ষ। এর মধ্যে একটি ক্ষুদ্র সংখ্যা ইংরাজি মাধ্যম অর্থাৎ অন্য বোর্ডের অধীনে গেলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে প্রায় ওই চার লক্ষের প্রায় ৯০% ছাত্র ছাত্রী আদতে স্কুলছুট।

সরকারি দপ্তরের বেহাল দশা, খামখেয়ালিপনা, ও আপাদমস্তভাবে গোটা দপ্তর দুর্নীতিতে ডুবে যাওয়ার দরুন পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সাড়ে আট হাজার সরকারি বিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার খবর শুনিয়েছে  

পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এমতাবস্থায় আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন শিক্ষানীতি এরাজ্যে আরোপ করা হলে গোটা রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা কোন দিকে এগোবে তা প্রশ্নচিহ্নের মুখে।

এই জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের সাথে সাথেই প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষ।

প্রত্যেকটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন প্রথম থেকেই সারা দেশে এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাত্রদের বক্তব্য খুব সুস্পষ্ট – ” পাঠশালা কে গোশালা বানানো যাবে না।  “

আর বর্তমানে শুধুমাত্র ছাত্র সংগঠন গুলিই নয়, স্রেফ সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার খাতিরে এই জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে পথে নেমেছে অন্যান্য বামপন্থী গণসংগঠনসমূহও। আগামী ৫ এপ্রিল দিল্লিতে কিষান মজদুর সংঘর্ষ যাত্রাতেও সিটু, কৃষক সভা প্রবৃত্তি সংগঠন একত্রিত হয়ে যে পদযাত্রা করবে সেখানেও জাতীয় শিক্ষানীতি কে বর্জন করাও একটি অন্যতম ইস্যু। 

যদিও সংসদীয় রাজনীতিতে কিছুটা এগিয়ে থাকার দরুন কেন্দ্রীয় সরকার এখনও বিশেষ হেলদোল দেখায়নি এই শিক্ষানীতিকে নিয়ে। তবে ভারতবর্ষ এর আগে কৃষক আন্দোলনের সময় দেখেছে – “What Parliament can do, The street can Undo.”

এখানেও সময় বলবে কে জেতে শেষ অবধি – সামাজিক ন্যায় না স্বৈরাচারী শক্তি।