গান্ধীজীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের অহিংস আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করেছে ,এই প্রচার ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের ৭৫বছর পরেও হয়ে আসছে।আসলে অত্যন্ত সুকৌশলে আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র ধারার যে আন্দোলন সেই বিপ্লবী আন্দোলন কে নস্যাৎ করতেই ভারতের শাসক শ্রেণীর পক্ষ থেকে এই প্রচার চালানো হচ্ছে।ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রামে এক বড় ভূমিকা ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি আস্থাশীল বিভিন্ন গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন গুলির। আর এই সশস্ত্র ধারার বিপ্লবী আন্দোলনে সারা দেশের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল অখণ্ড বাংলা।
১৯০২সাল থেকেই বাংলায় গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি গড়ে উঠতে থাকে।এই সমিতি গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল অনুশীলন সমিতি এবং যুগান্তর। বাংলার বীর যুবকেরা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। পরবর্তি সময়ে এই সশস্ত্র ধারায় আস্থাশীল বাংলার বিপ্লবীদের এক বড় অংশ যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে।এই বিপ্লবীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কমরেড নিরঞ্জন সেনগুপ্ত।
১৯২৯সালের ১৯শে ডিসেম্বর কমরেড সেনগুপ্ত কলকাতার মেছুয়াবাজার থেকে গ্রেফতার হন,তাঁর অন্যান্য বিপ্লবী সহযোগিদের সঙ্গে।তাঁদের আসামী করে শুরু হয় কুখ্যাত মেছুয়াবাজার বোমার মামলা।বিচারে কমরেড সেনগুপ্ত র দশ বছর সাজা হয় পরবর্তি সময় হাইকোর্টে আপিল মারফত সাজা কমে দাঁড়ায় সাত বছর। ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন বন্দিশালা ঘুরিয়ে অবশেষে তাঁকে নিয়ে আসে কুখ্যাত আন্দামান সেলুলার জেলে।আর এই আন্দামান জেল থেকেই শুরু হয় কমরেড সেনগুপ্তের জীবনের এক নতুন অধ্যায়।জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী থেকে তিনি হয়ে ওঠেন কমিউনিস্ট বিপ্লবী।অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গে একযোগে গড়ে তোলেন” কমিউনিস্ট কনসলিডেশন”।কমরেড নারায়ণ রায় এবং কমরেড নিরঞ্জন সেনগুপ্ত হন এই “কমিউনিস্ট কনসলিডেশন “গ্রুপের নেতা এবং শিক্ষক।
ছোট বেলা থেকেই কমরেড সেনগুপ্তের নেতৃত্ব প্রদানের এক সহজাত ক্ষমতা ছিল। স্কুল জীবনেই তিনি যোগ দিয়েছিলেন বিপ্লবী সংগঠনে।পরবর্তি সময় অগ্নিযুগের আরেক প্রখ্যাত বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশির সান্নিধ্যে এসে তিনি বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির অন্যতম সংগঠক হয়ে ওঠেন। সমিতির নির্দেশে ছাত্রদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলবার জন্য বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে ভর্তি হন ।এই সময় তিনি অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জেলায় ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন।
এই ধরনের একজন জনপ্রিয় বিপ্লবীকে ইংরেজ সরকার খুব বেশিদিন জেলের বাইরে রাখার সাহস দেখায়নি।১৯২৫ সালের ৭ই ডিসেম্বর তাকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ পুলিশ।
বন্দি অবস্থায় রত্নাগিরি জেলে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের নায়ক মাস্টার দা সূর্য সেনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।এই সাক্ষাৎকার ভবিষ্যতে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে এক নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করে।জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর মাস্টার দার সঙ্গে পূর্বপরিকল্পিত কর্মপন্থা অনুযায়ী বিভিন্ন বিপ্লবী দলের তরুণদের একযোগ করে গড়ে তোলেন ‘রিভল্ট গ্রুপ’ ।আসলে এই সময়টায় বাংলার বিপ্লবী দলগুলির মধ্যে একটা ভাঁটার টান চলছিল।এই সময় বিপ্লবী দলের তরুণেরা চাইছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই সেখানে বয়স্ক নেতারা চাইছিলেন অপেক্ষা করতে।নিরঞ্জন সেনের নেতৃত্বে এই রিভল্ট গ্রুপ বাংলার তরুণ বিপ্লবীদের মধ্যে এক নতুন বেগের সঞ্চার করে।ব্রিটিশ কারাগারে দীর্ঘ দিন অনশনের কারনে যতীন দাসের মৃত্যু হলে শহীদ যতীন দাসের মৃত্যুর বদলা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে”রক্তে আমার লেগেছে আজ সর্বনাশের নেশা”এই শিরোনামে যে ইস্তাহার ছাপা হয় তার প্রধান রচিয়তা এবং উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি।যুগান্তর দলের মুখপত্র স্বাধীনতায় ‘বিপ্লবী যতীন ‘এবং ‘বাংলার তরুণদের প্রতি’লেখা দুটি ব্রিটিশ শাসকের মনে গভীর আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আরও বড় আঘাত হানবার পরিকল্পনা করছিলেন তিনি।কিন্ত তাঁর এই পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায় ১৯২৯-র ১৯শে ডিসেম্বর তিনি মেছুয়াবাজারের কলাবাগান বস্তি থেকে গ্রেফতার হলে।এই গ্রেফতারির সূত্র ধরেই ব্রিটিশ গোয়ান্দারা পাঁচু ধোবানী লেনে আবিষ্কার করে বিপ্লবীদের বোমা তৈরির কারখানা,শুরু হয় কুখ্যাত মেছুয়াবাজার ষড়যন্ত্র মামলা।
এর পরবর্তি পর্যায়ে কমরেড সেনের জেল যাত্রা এবং একজন জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী থেকে কমিউনিস্ট বিপ্লবীতে উত্তরণের ঘটনা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।
জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর তিনি হয়ে ওঠেন অবিভক্ত বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম সংগঠক। ১৯৩৯সালে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন এবার তাঁকে বন্দি করে রাখা হয় হিজলি বন্দি শিবিরে।
স্বাধীন ভারত সরকার ১৯৪৮সালে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে।এই অবস্থায় দুবছর আত্মগোপন করে পার্টির কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।দুবছর আত্মগোপন করে থাকবার পর ১৯৫০সালে ভারত সরকারের পুলিশ তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করে।কমরেড সেন পার্টির অভ্যন্তরে সংশোধনবাদ এবং সঙ্কীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক সেনানী। ১৯৬৪সালে সংশোধনবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি(মার্কসবাদী)তৈরি হলে উনি কমরেড সেন যোগ দেন সিপিআই(এম)এ।
এই সময় পার্টির নেতৃত্বে যে উদবাস্ত আন্দোলন শুরু হয় তিনি ছিলেন এই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। ১৯৬৭সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন হলে(কমরেড সেন জয়ী হয়েছিলেন টালিগঞ্জ কেন্দ্র থেকে)উদবাস্ত ,পুর্নবাসন এবং কারা দপ্তরের দায়িত্ব পান।তাঁর নির্দেশ ই উদবাস্তদের প্রতি চরম অপমানের নিদর্শন ‘অর্পন পত্র ‘দেওয়ার রিতী বাতিল করেন। কলোনিগুলির উন্নয়নের বরাদ্দ হয় সরকারি টাকা।
কমরেড নিরঞ্জন সেনগুপ্তের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৬৯র ৪টা সেপ্টেম্বর। উদবাস্ত মানুষের প্রকৃত বন্ধু একজন স্বাধীনতা সংগ্ৰামী টালিগঞ্জের প্রাক্তন বিধায়ক নিরঞ্জন সেনগুপ্তের সমস্ত স্মৃতি টালিগঞ্জের মানুষের মন থেকে মুছে দেওয়ার অশুভ প্রয়াস চালাচ্ছে শাসক তৃণমূল। এই সরকার ক্ষমতায় নাকতলায় (১০০নং ওয়ার্ড)নিরঞ্জন সেনের নামে নামাঙ্কিত পার্কের বোর্ড খুলে ফেলে।যেই পার্কটির উদ্বোধন করেছিলেন জ্যোতিবসু স্বয়ং।
দীর্ঘ দিন ধরে রানিকুঠি থেকে (যেখানে কমরেড সেনের আবক্ষ মূর্তিটি রয়েছে) বাঘাতীন পর্যন্ত রাস্তাটির নামকরন নিরঞ্জন সেন সরনি করবার এবং সমস্ত প্রশাসনিক কাজে এই নাম ব্যবহার করবার দাবী জানিয়ে আসছে সিপিআই (এম)কিন্ত সরকার তাতে কর্নপাত করছে না।
এখন শুরু হয়েছে কমরেড সেনের নামে নামাঙ্কিত বিজয়গড় অঞ্চলে অবস্থিত নিরঞ্জন সদন দখল করবার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র শুরু করেছে তৃণমূল। যেনতেন প্রকারনে নিরঞ্জন সদন দখল করতে চায় ওরা।আসলে গোটা রাজ্যে জুড়ে সবকিছু দখল করে মুনাফা লুঠবার যে নীতি তৃণমূল দল এবং সরকার নিয়েছে তারই অঙ্গ হিসেবে ওরা নিরঞ্জন সদন দখল নিতে চায়।বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তৈরি সমস্ত কিছুর শুধুমাত্র রঙ্গ করে আর নাম নপরিবর্তন করে তা নিজেদের নামে চালাচ্ছে তৃণমূল সরকার। যেমন বাম আমলে তৈরি রাজারহাট উপনগরীর নামকরণ করা হয়েছিল জ্যোতিবসুর নামে তৃণমূল ক্ষমতায় এসে সেই নাম পাল্টে দেয়।ধাপায় তৈরি হওয়া জ্যোতিবসুর নামাঙ্কিত জলাধার প্রকল্পের নাম ও বদলে যায়।তেমনই হয়তো বদলে যাবে নিরঞ্জন সদনের নাম।
বাংলার শ্রেষ্ঠ বিপ্লবীদের একজন উদবাস্ত মানুষদের প্রকৃত বন্ধু কমরেড নিরঞ্জন সেনগুপ্তের নামে নামাঙ্কিত নিরঞ্জন সদন দখল করবার তৃণমূল কংগ্রেসের এই অশুভ প্রয়াসের বিরুদ্ধে টালিগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ রুখে দাঁড়ান। প্রতিবাদ করুন তৃণমূল সরকারের এই সর্বগ্রাসী মনোভাবের।