দাঁতে দাঁত চেপে এক ইঞ্চি জমি না ছাড়ার লড়াই লড়ছেন উত্তরবঙ্গের বামকর্মীরা – এটা কোন নতুন কথা নয়। নতুন কথা হল, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস কে নিজের অস্থায়ী রুটি রুজির সংস্থান বাঁচানোর অজুহাতে ভোট দেওয়া তরুণও বলছেন “লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের জেতা দরকার, পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের ফেরা দরকার”। কেন বলছেন? কারণ ধর্মে মুসলমান সেই যুবকের রক্তজল করে কেনা জমিতে স্থানীয় বিজেপি নেতা গা জোয়ারি করে কালিমন্দির স্থাপন করেছেন তাঁর অনুগামীদের হিন্দু পাড়ায় মুসলমানকে থাকতে দেবো না বায়নাক্কা শুনে। “অথচ জানেন কাকু জমিটা আমার পাড়ার লাগোয়া এলাকায়। ওখানকার সবাই আমাকে ছোটো থেকে বড়ো হতে দেখেছেন। বিজেপির বাড়বাড়ন্ত হওয়ার ফলেই এমনটা ঘটছে। তৃণমূল নেতারা বলছেন, ওরা তো অমনই। ন‍্যায‍্য বিচার পেলাম না।” “তোমার ওখানে বামপন্থীরা কেমন শক্তিশালী? ” অস্থায়ী চুক্তি ভিত্তিক কর্মী হয়েও নো ওয়ার্ক নো পে র নিয়মের ফাঁদে মাসের পর মাস মাইনে না পেয়ে ড্রাইভিংএর কাজ করা তরুণটি বললেন, “ওখানেই তো গণ্ডগোল কাকু! আমার বাবা আজন্ম সিপিআই(এম) সমর্থক। সরকারি কর্মচারী বলে ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না। অথচ গ্রামে তৃণমূলের হুমকি জুলুমের ভয়ে কেউ সিপিআই(এম) এর চিহ্নে ভোটে দাঁড়াতে চাইছিলেন না। শেষে বাবার পরামর্শেই পাড়ার এক মাস্টারমশাই তিনিও কট্টর সিপিআই(এম) সমর্থক – দাঁড়িয়ে পড়লেন। গা জোয়ারির ভোট হলেও মাস্টারকাকুর  এই সাহসটা দেখানো খুব দরকার ছিল। ” বলেই যোগ করলেন,” দশ বছর আগেও এখানে এমন পরিস্থিতি ছিল না।”

ঘটনাটি আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রের। আপাতদৃষ্টিতে দেওয়াল দখলের লড়াইয়ে বাম কংগ্রেস প্রার্থী মিলি ওঁরাও কিছুটা পিছিয়ে কিন্তু বস্তি এলাকা ঘুরলে বোঝা যায় বিভাজনের রাজনীতি বঞ্চনা ও দারিদ্র্য মুছে দিতে পারেনি। হিন্দিভাষী ও বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দুদের মধ‍্যে “হিন্দুরাষ্ট্রের শ্লোগান” ঢুকিয়ে দেওয়ার পরেও জয়গাঁও তে গোর্খাল‍্যাণ্ড আন্দোলনের সময় বিজেপির ভূমিকা সাধারণ মানুষই মনে করিয়ে দিচ্ছেন। তৃণমূল সেসময় মজা দেখেছে। মানুষের এককাট্টা লড়াই ভ্রাতৃঘাতী বিরোধ থামিয়েছে। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সের মানুষজন মনে করতে পারেন, আশির দশকে লাল পার্টি দার্জিলিংকে ভারতের মানচিত্রে রেখে দেওয়ার জন‍্য নিজেদের জীবন দিতেও দ্বিধা করেনি। দিন  আনা, দিন খাওয়া মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, বিজেপি আবার দিল্লির ক্ষমতায় ফিরে এলে উত্তরবঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।

কিন্তু বিজেপি উত্তরবঙ্গে ঠিক কতটা অনুকূল আবহাওয়ায় নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে। কান পাতলে শোনা যাচ্ছে অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা। মোদিজীর গ‍্যারান্টি, সীমান্ত সুরক্ষা ইত‍্যাদি আলোচনার কেন্দ্রে জায়গা পাচ্ছে না, বরং বার বার ঘুরে ফিরে আসছে আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রের সাতটা চা বাগানে প্রচারে যেতে পারছেন না বিজেপি প্রার্থী। জন বার্লা বনাম মনোজ টিগ্গার দরকষাকষি অথবা দড়ি টানাটানিতে কোন লাভ হয়নি চা শ্রমিকদের। মমতা ব‍্যানার্জীর চা  সুন্দরী প্রকল্প প্রত‍্যাখ‍্যাত হয়েছে চা শ্রমিকদের কাছ থেকেই। জয়গাঁও থেকে ভুটান যাওয়ার পথে চা বাগানের  খালি নীল সাদা বাড়িগুলো যেন বিদ্রুপ করছে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের অদূরদর্শিতাকে। বিকল্প হিসাবে রাজ‍্য সরকারের জমির  পাট্টা সহ এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা শ্রমিকদের হাতে তুলে দেওয়ার ঘোষণা কতটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে, তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী প্রকাশ চিক বরাইক মনে মনে সে বিষয়ে নিশ্চিত নন। বস্তুত চা বাগানের অস্থায়ী শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ এখনো স্পষ্ট নয়। যাঁদের প্রধান দায়িত্ব ছিল চা বাগান ও তার শ্রমিকদের নিয়ে সেই বিজেপিও তো রাজনৈতিক বিবৃতি যুদ্ধ ছাড়া বিশেষ কিছুই করেনি। ফলে চা বাগানের শ্রমিক আন্দোলনের পরিবেশে আশৈশব বেড়ে ওঠা বামফ্রন্ট প্রার্থী মিলি ওঁরাও এখানেই প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় এগিয়ে। চা বাগানের হাল হকিকত এবং দাবি দাওয়া তিনি নিজে জানেন। শ্রমিক এবং আদিবাসী এলাকা চষে ফেলছেন মিলি। হাসিমুখে উত্তর দিচ্ছেন সব প্রশ্নের। কাজ হারানো চা শ্রমিকদের জন‍্য বরাদ্দ “ফাউলাই” ভাতা বামফ্রন্ট আমলে চালু হয়েছিল। টাকার অঙ্ক আজও বাড়েনি। মিলি জানেন কেন্দ্রীয় সরকারের অধিগৃহীত চা বাগানগুলির শ্রমিকরা দীর্ঘদিন বেতন পাচ্ছেন না তা জেনেও সমাধান করার কোনও চেষ্টা মাদারিহাটের বিজেপির বিধায়ক মনোজ টিগ্গা বা তৃণমূলের রাজ্য সভার সাংসদ প্রকাশ চিক বরাইক করেন নি। দুজনেই জনপ্রতিনিধি হিসাবে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন নি। ফলে সংসদে মিলি প্রবেশাধিকার পেলে তাঁকে কোন কোন দাবি আদায় করতে হবে মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করতে করতে তিনি অনুভব করছেন।

চা শ্রমিকদের বঞ্চনার প্রতিবাদে গত ৮ই এপ্রিল দুই সরকারের বিরুদ্ধে বানারহাটে শ্রমিকদের  সুবিশাল অবরোধ ভোটের আগে উদ্বেগে রেখেছে বলেই তৃণমূল লাগাতার তাদের “উন্নয়নে”র প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছে, বিজেপি তাদের পদ্মফুল আঁকা পতাকার পাশে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার স্মৃতি উসকে দেওয়া হনুমানের ছবি আঁকা পতাকা লাগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী দুজনেই ভোটের আগে জনসভা করেছেন আলিপুরদুয়ারে; কিন্তু গত পাঁচ বছরে চা বাগানের শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য কোন কোন পরিকল্পনা রূপায়ণ করেছেন কেউ তা নিয়ে কোনও শব্দ উচ্চারণ করেন নি কেবল পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করা ছাড়া।

এমতাবস্থায় খুব স্বাভাবিকভাবেই চোরা বিরোধিতার স্রোত বইছে শুধু আলিপুরদুয়ার নয় উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটি লোকসভা কেন্দ্রে যেখানে টোটো গাড়ির চালক অচেনা সওয়ারিদের কাছেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন, “গ্রামের ভেতর দিকে জঘন্য রাস্তা দিয়ে  গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময়, উন্নয়নের নামে চুরি করে ফাঁক করে দেয় ! চোর গুলো কেবল এ দল থেকে ও দলে গিয়ে টাকা কামায় আমাদের লাভের লাভ কিছুই হয় না। আমি টি এম সি করি কিন্তু এবার লাল পার্টিতে ছাপ দেবো। চুরি থামাতে থার্ড কারুর আসা দরকার।  ” একটু থেমে পিছন ফিরে  অবাক চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকা সওয়ারিদের  উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, আমি একা নই দাদা, আমার মতো অনেকেই আছে। ঠোঁট কামড়ে দম বন্ধ করে আছে শুধু, সময়মতো বুঝিয়ে দেবে।