ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন নভেম্বর বিপ্লবের নেতৃত্বে থাকলেও লিও ট্রটস্কি এবং জোসেফ স্তালিনের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। অথচ লেনিনের পরেই যিনি বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয়  কমিটির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ  সদস্য গ্রেগরি জিনোভিয়ভ এবং বলশেভিক নেতা লেভ কামেনেভ কিন্তু বিপ্লবের মাধ‍্যমে অস্থায়ী সরকারকে উৎখাত করার বিরোধী ছিলেন। অথচ অস্থায়ী সরকার কেবল আদর্শগত কারণে নয় শ্রমিক শ্রেণীকে ক্ষমতার থেকে দূরে রাখার জন‍্যই প্রতিনিয়ত বলশেভিকদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছিলেন। অস্থায়ী সরকার জনগণের সমস‍্যার সমাধান করতে ব‍্যর্থ এই প্রচার করার জন‍্য লেনিনকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল ,ট্রটস্কি ও আলেকজান্দ্রিয়া কোলনতাইকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও বলশেভিকদের দমিয়ে রাখা যায়নি। জেনারেল কর্ণিলভ সামরিক অভ‍্যুত্থান ঘটালে তার মোকাবিলা করার জন‍্য রেড গার্ডদের সশস্ত্র প্রতিরোধকে কেরেনিস্কি সরকার পরিস্থিতিগত কারণে নিজেদের পক্ষে ব‍্যবহার করেছিলেন। কিন্তু জারদের আমলে উদ্ভুত অভাব অভিযোগ অস্থায়ী সরকারের সময়েও দূর না হওয়ায় বলশেভিকদের প্রভাব সোভিয়েতগুলিতে বাড়ছিল। স্তালিন প্রাভদা পত্রিকার সম্পাদনা এবং রেডগার্ডদের পরিচালনার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন।

১৯১৭ সালের মার্চের বিপ্লবের যে পর্যায়ে জারতন্ত্রের উচ্ছেদ করা হয়েছিল এবং অস্থায়ী সরকার স্থাপিত হয়েছিল সেই সরকারে মধ‍্যবিত্ত ও ধনী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব ছিল। বলশেভিক পার্টিকে জনমত নিজেদের দিকে টেনে নিয়ে আসার সুযোগ না দিয়েই ডুমার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সার্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ‍্যমে সংসদ গঠন করার লক্ষ্যে অস্থায়ী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। প্রথমে অভিজাত সম্প্রদায়ের জর্জিও লুভভ প্রধানমন্ত্রীর পদে বসলেন তিনি পদত‍্যাগ করার পরে সোশ‍্যাল ডেমোক্র‍্যাট আলেকজান্ডার কেরেনিস্কি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে সাম্রাজ‍্যবাদী যুদ্ধ হিসাবে চিহ্নিত করা বলশেভিকরা ধনতান্ত্রিক ব‍্যবস্থার পক্ষে থাকা রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে থাকার কারণে এই সরকার কে অস্থায়ী সরকারকে গণতন্ত্র ও জনগণের স্বাচ্ছন্দ‍্য বিকাশের শর্তে বাইরে থেকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু এই সহযোগিতার মনোভাব কেরেনিস্কি সরকারের ছিল না। কারণ তাঁরা বলশেভিকদের সাম্রাজ‍্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে থাকার অবস্থানের বিরোধী ছিলেন এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিসরে শ্রমিক ও সমাজের গরীব অংশের মানুষদের নিয়ে আসার বিরোধী ছিলেন। লেনিন বিপ্লবের এই পর্যায়ে রাশিয়ার বাইরে ছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের আদর্শ প্রচারের তাঁর সক্রিয় নেতৃত্ব সম্পর্কে কেরিনিস্কি সরকার সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন বলে লেনিনের যে কোনও সময় বলশেভিক পার্টির মাধ‍্যমে সরকারকে বিপদে ফেলে দিতে পারেন এই আশঙ্কা তাঁদের ছিল। লেনিনের ” শান্তি জমি ও রুটি “র শ্লোগান তাঁদের কাছে ভীতিপ্রদ ছিল। মে মাসে দেশে ফিরে আসার পর লেনিন কেরেনেস্কি সরকারকে সাম্রাজ‍্যবাদের দালাল এবং জন বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত করেন। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ‍্যমে এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে এই প্রচারও বলশেভিকদের পক্ষ থেকে খেটেখাওয়া রুশ নাগরিকদের মধ‍্যে নেমে আসে।

কেরেনিস্কি সরকার জারতন্ত্রের সময়কার উদ্ভৃত সমস‍্যার সমাধান করার চেয়ে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে প্রচার করার কাজে বেশি ব‍্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ, কৃষক বিক্ষোভ দমনে কসাক সৈন‍্যদের পাঠানোর মত দমনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসলে জনগণের ক্ষোভ প্রশমন করার বদলে ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছিল। সোভিয়েতগুলিতে বলশেভিকদের প্রাধান্য বিস্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শ্লোগান উঠেছিল সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতা দাও। লেনিন রুশ জনগণের বিক্ষোভ কে কাজে লাগিয়ে অত‍্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে পেট্রোগ্রাদ সোভিয়েতের বলশেভিকদের সমর্থন ও প্রাধান্য বিস্তৃত করছিলেন। অস্থায়ী সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বলশেভিক বিদ্রোহ ব‍্যর্থ হওয়ার পর লেনিনকে নিয়ে স্তালিন গোপন স্থানে চলে গিয়েছিলেন। ট্রটস্কি চল্লিশ দিনের জন‍্য কারাবাস করার পর বেরিয়ে এসে বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিত‍ে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে লেনিনের সশস্ত্র বিপ্লবের তত্ত্ব পূর্ণ সমর্থন করেছিলেন। ১৯১৭ সালের ২৫ শে অক্টোবর সশস্ত্র বিপ্লবের নীতি বিপুল সংখ‍্যাধিক‍্যে গৃহীত হয়। গঠিত সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রাম কমিটির প্রধান হিসাবে ট্রটস্কিকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

লিও ট্রটস্কি 

 
অস্থায়ী সরকার চাপের মুখে যখন কৃষকদের হাতে ভূমিস্বত্ব দিলেন তখনই বোঝা গিয়েছিল যে নিজেদের প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর প্রধানমন্ত্রী কেরেনেস্কি আস্থা রাখতে পারছেন না। সন্তুষ্ট না হওয়া কৃষকরা সংসদের অধিবেশনে নিজেদের ভূমিস্বত্ব কেড়ে নেওয়ার হুমকি দিলেন। ৭ ই নভেম্বরেই রাশিয়ার সোভিয়েতের অধিবেশন বসার কথা ছিল। পরিস্থিতির পরিহাসে ৩০শে অক্টোবর পেট্রোগ্রাদ সোভিয়েতের সৈনিকরা অস্থায়ী সরকারের অস্তিত্বই অমান্য করল এবং ৩ রা নভেম্বর বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় দপ্তরে আরো বেশি সংখ্যক সৈন‍্যদের উপস্থিতিতেই এই প্রস্তাব গৃহীত হল এবং স্থির হল যে সৈন‍্যবাহিনী বিপ্লবী সংগ্রাম কমিটির নির্দেশই কেবল পালন করবে। ফলে ৬ ই নভেম্বর প্রশাসনিক অফিসগুলি দখলের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। সৈন‍্যদলের অধিকাংশই বলশেভিকদের আনুগত্য স্বীকার করে নেওয়ায় কার্যত বিনা প্রতিরোধেই গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে বলশেভিক দখলে চলে এসেছিল। ৭ ই নভেম্বর সকালে কেরেনিস্কি পলায়ন করেন।


কেরেনিস্কি

রাশিয়ার সোভিয়েতের সম্মিলিত অধিবেশন বসে বলশেভিক পার্টির সদর দপ্তর স্মলনি ইনস্টিটিউটে। সেখানেই সোশ‍্যাল ডেমোক্র্যাট বা মেনশেভিকদের সঙ্গে কোনও আপোস সমঝোতা ছাড়া বলশেভিক পার্টির সরকার গঠন করার সিদ্ধান্ত হয় এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব‍্যবস্থা স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হল। সোভিয়েত কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রথম ঐতিহাসিক ভাষণে লেনিন বলেছিলেন,” ৬ ও ৭ ই নভেম্বরের বিপ্লব সামাজিক নবযুগ সূচনা  করেছে। শ্রমিক আন্দোলন এবার তার আদর্শ সম্পূর্ণ রূপে সফল করবে। ” সোশ‍্যাল ডেমোক্র‍্যাটদের প্রতিনিধি আভিলভ এবং চরমপন্থী সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতিনিধি ক‍্যারোলিন কোয়ালিশন সরকারের প্রস্তাব রাখলে ট্রটস্কি উত্তর দেন,” কোয়ালিশন চলতে পারে কেবল কৃষক সৈনিক ও শ্রমিকদের মধ‍্যে। যারা বিপ্লব বিরোধী ভূমিকা নিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তাদের সঙ্গে নয়।”

স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাচ‍্যুত কেরেনেস্কি ১০ ই নভেম্বর ক্ষমতায় ফেরার শেষ চেষ্টা করলেন, ধনিক ও বূর্জোয়ারা কোনোভাবেই শ্রমিকশ্রেণীর শাসন মেনে নিতে না পারায় বিদ্রোহ ঘোষণার সুযোগ নিয়ে। ক্ষমতাহীন ডুমা সৈন‍্যদলকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করল। কিন্তু কসাক সৈন‍্য এবং পূর্বাঞ্চলীয় সৈন‍্যদের পক্ষে বলশেভিক অনুগত মিলিশিয়ার সঙ্গে এঁটে ওঠা সম্ভব হয়নি। প্রথম মহাযুদ্ধে যুক্ত করার জন‍্য সৈন‍্যদের সীমান্ত এলাকায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানার পর কেরেনিস্কি সরকারের ওপর তাঁরা ক্ষুব্ধ হলেন। কারণ তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন এই যুদ্ধ তাঁদের বা রাশিয়ার স্বার্থ পূরণ করবে না।

কেরেনেস্কি,কর্ণিলভ,ডুমা ও অস্থায়ী সেনাপতিদের মিলিত প্রতিবিপ্লবী আক্রমণ মোকাবিলা রক্তক্ষয় ছাড়া সম্ভব ছিল না।

এই প্রতিবিপ্লবী প্রচেষ্টা ব‍্যর্থ হওয়ার ফলে বিপ্লবী বলশেভিক সরকারের প্রতি কৃষক ও রেলওয়ে শ্রমিকদের মধ‍্যে যাঁরা কোনভাবেই নীতিগতভাবে বলশেভিকদের সমর্থন করছিলেন না  তাঁরা বুঝেছিলেন শ্রমিক ও কৃষকদের স্বার্থে বলশেভিকরা জানকবুল লড়াইয়ে প্রস্তুত। ২৭ শে নভেম্বর কসাক জমিদারদের জমি রুশ কৃষকদের মধ‍্যে বন্টন করার ঘোষণা করলেন স্বয়ং লেনিন।

সুতরাং ১৯১৭ সালের ৭ ই নভেম্বর পেট্রোগ্রাদ রক্তপাতহীন থাকলেও বিপ্লব যেমন ফুলের বিছানায় ঘুমানোর মত মনোরম অভিজ্ঞতা নয় রুশ বিপ্লবের ক্ষেত্রেও তার ব‍্যতিক্রম ঘটেনি। রক্তাক্ত প্রতিরোধ ছাড়া ধনিক ও বূর্জোয়াদের প্রতিবিপ্লবের প্রচেষ্টা ব‍্যর্থ হত না। বস্তুত ফরাসী বিপ্লব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা লাভ, দাসব‍্যবসার লোপ-কোনও যুগান্তকারী ঘটনাই রক্তপাত বা বলপ্রয়োগ ছাড়া হয়নি।