রাশিয়ার নতুন ক্যালেন্ডার পুরোনো ক্যালেন্ডারের চাইতে ১৩ দিন এগিয়ে। পুরোনো ক্যালেন্ডার  অনুযায়ী রুশ বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল ২৫শে অক্টোবর। নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তারিখটি ছিল ৭ই নভেম্বর। ১৭ই নভেম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল এই বিপ্লবের কর্মকাণ্ড। বিশিষ্ট মার্কিন সাংবাদিক জন রিডের প্রত্যক্ষ দর্শন ও বর্ণনার লিপিবদ্ধ রূপস্বরূপ প্রখ্যাত গ্রন্থ ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’-এর শীর্ষনাম অনুসরণে সাধারণভাবে অনেকেই উপরি উক্ত দিনগুলিকে আখ্যায়িত করে থাকেন। ১৮৪৮ সালে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট ইস্তেহারের  বৈষম্যমূলক-শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধন করে শ্রমিক শ্রেণি তথা শ্রমজীবী মানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলার আহ্বান বাস্তবায়িত হয়েছিল এই বিপ্লবের মাধ্যমে। নেতৃত্বে লেনিন এবং রুশ কমিউনিষ্ট তথা বলশেভিক পার্টি।

পিছনে ফেলে আসা দিনগুলিতে রুশ দেশ ও দুনিয়া জোড়া নানা সংগ্রাম ও মতাদর্শগত বিতর্ক, শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রথম ও দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের নেতৃত্বে দেশে দেশে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা, মে দিবসের লড়াই, রক্তস্নাত প্যারি কমিউনের ব্যর্থতা ও ১৯০৫-এ রাশিয়ায় প্রথম বিপ্লব প্রচেষ্টার ব্যর্থতার বন্ধুর পথ পেরিয়ে এল নভেম্বর বিপ্লব। গড়ে উঠল দুনিয়ার বুকে প্রথম শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সর্বহারা রাষ্ট্র।

প্রদীপ জ্বালানোর জন্য যেমন সলতে পাকানো জরুরি, তেমনি রুশ বিপ্লবের আগে ছিল দীর্ঘ প্রস্তুতি। জার শাসিত রাশিয়া ছিল শিল্পে অনুন্নত কৃষি নির্ভর অর্থনীতির দেশ। উনবিংশ শতকের শেষ দিকে সেখানে শিল্প গড়ে ওঠে। আত্মপ্রকাশ ঘটে শ্রমিক শ্রেণির। সেদেশে বেশি সংখ্যায় ছিল কৃষক ও ভূমিদাস। তাদের ওপর শোষণ ও অত্যাচার চালাত জমিদাররা আর কুলাকরা অর্থাৎ অতি ধনী কৃষকরা। ১৮৬৯ সালে ভূমিদাস প্রথা সরকারিভাবে উঠে গেলেও তীব্র শ্রেণি শোষণ বজায় ছিল। একই সাথে ছিল জাতিগত শোষণ।রাশিয়ায় ছিল ১৮৫টি জাতি ও ১৪৭টি ভাষা। সবল জাতিগুলি দুর্বল জাতিগুলিকে শোষণ করত। তাই রাশিয়াকে বলা হত জাতিসমূহের কারাগার। শ্রেণিগত শোষণ ও আধিপত্যকারী জাতির শোষণের বিরুদ্ধে কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠিত করে সংগ্রাম গড়ে তোলার ধারাবাহিক কাজে যুক্ত ছিল রুশ সোস্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি (RSDLP)। এটিই পরবর্তী কালের রাশিয়ার কমিউনিষ্ট পার্টি। এই পার্টির মধ্যে ছিল বিপ্লবের পথ ও পন্থা নিয়ে বিতর্ক। ফলে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে পার্টি। প্লেখানভ, যিনি ছিলেন বিশাল মাপের তাত্ত্বিক, লেনিনের গুরু ও লেনিনের সঙ্গে RSDLP-র যৌথ প্রতিষ্ঠাতা এবং পরে বিচ্যুত হয়ে যান—তাঁর ও মার্তভের নেতৃত্বে মেনশেভিক গোষ্ঠী এবং লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক গোষ্ঠী।

প্রথম দিকে  মেনশেভিকদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা থাকলেও কালক্রমে বলশেভিকরাই বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তিতে পরিণত হয় এবং বিপ্লব সংগঠিত  করে। মেনশভিকরা সুবিধাবাদের গর্ভে তলিয়ে যায় এবং কার্যত বিপ্লব বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। যদিও মেনশেভিকদের সঙ্গে ঐক্য প্রচেষ্টায় লেনিন পার্টির ঐক্য কংগ্রেস সংগঠিত করে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা চালান। কিন্তু সে প্রয়াস ব্যর্থ হয়।

   সলতে পাকানোর পর্বে উনবিংশ শতকের শেষ দুটি দশকে ও বিংশ শতকের প্রথম দুই দশকে রাশিয়ার বুকে সংঘটিত হয়েছে একের পর এক শ্রমিক ধর্মঘট। বিপ্লবের আগের বছর অর্থাৎ ১৯১৬ সালে ধর্মঘটে অংশ নেয় ১৫ লক্ষাধিক শ্রমিক। ১৯০৫ সালে বিপ্লব প্রচেষ্টার কথা আগেই উল্লেখিত হয়েছে। তার আগে লেনিন লিখেছিলেন ‘কী করিতে হইবে’ , ‘এক পা আগে দুই পা পিছে’ এইসব বই। ১৯০৫-এর ২২শে জানুয়ারি নিরস্ত্র মানুষের ওপর শোষকশ্রেণির জঘন্য আক্রমণে অন্ততপক্ষে ৩০০ মানুষের হত্যার ঘটনা ‘রক্তাক্ত রোববার’ নামে কুখ্যাত হয়ে আছে ইতিহাসে। ১৯০৫-এর বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ায় নেমে এল স্বৈরাচারী জারের ব্যাপক আক্রমণ। চলল দমন-পীড়ন। এই অত্যচার চলে জারের লোক কুখ্যাত স্তলিপিনের নেতৃত্বে। এই সময়কালটি ‘স্তলিপিন প্রতিক্রিয়া’ নামে ইতিহাসে বর্ণিত। লেনিন দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন। তবে দেশের বাইরে থেকেই দেশের অভ্যন্তরে থাকা সহযোদ্ধাদের তিনি চিঠি, ইস্তেহার মারফৎ নির্দেশিকা পাঠাতেন ও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। 

এর সাথে চলল দেশের অভ্যন্তরে সংগ্রাম-আন্দোলন-সাংগঠনিক প্রস্তুতি। শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। বাজার দখলের স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে যুদ্ধ। রাশিয়াও ছিল একটি পক্ষে। লেনিন লিখলেন ‘সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’। মুমূর্ষু পুঁজিবাদের লেনিনীয় ব্যাখ্যা। এসে পড়ল ১৯১৭ সাল।

 মার্চ মাসে সংঘটিত হল গণতান্ত্রিক বিপ্লব। উৎখাত হল জার, গঠিত হল অস্থায়ী সরকার। পরে যার প্রধান হলেন মেনশেভিক কেরেনেস্কি। দেশে ফিরে এলেন লেনিন। লিখলেন ‘এপ্রিল থিসিস’। যার মোদ্দা কথা হল অস্থায়ী সরকারের স্থলে গড়ে তুলতে হবে শ্রমিক-কৃষকের বিপ্লবী সরকার এবং ১৯০৫-এর ব্যর্থ বিপ্লবের পরে গ্রাম-নগরে গঠন হওয়া গণস্বায়ত্তশাসিত সংস্থা সোভিয়েতগুলির অধিক ক্ষমতায়ন। লেনিন আরো আহ্বান জানালেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে বিপ্লবী গৃহযুদ্ধে পরিণত করো। কেরেনেস্কি সরকার সুবিধাবাদী। শ্রমিক শ্রেণির সাথে বিশ্বাসঘাতকতার চিহ্ন ফুটে উঠছে এই সরকারের কার্যকলাপে। তাই বিলম্ব নয়, এখনই আঘাত করার সময়। চূড়ান্ত বৈপ্লবিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল ভিতরে ভিতরে সর্বত্র।

   প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য হওয়া যুদ্ধক্লান্ত রুশ সৈনিকদের একাংশ, শোষিত-বঞ্চিত শ্রমিক ও জমি থেকে উৎখাত হওয়া কৃষকরা বিপ্লবী বাহিনীতে নাম লেখাল। দাবি উঠল ‘জমি, রুটি, শান্তি’। লেনিনের প্রস্তাবে বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। যদিও মানুষের ক্ষোভ দেখে সেরকম একটা কিছু হতে যাচ্ছে আঁচ করে কেরেনেস্কি সরকার নানাভাবে নানারকম প্রস্তাব দিয়ে ম্যানেজ করবার চেষ্টা চালাল। কিন্তু অনড় বলশেভিকরা বিপ্লবের সিদ্ধান্তে অটল রইল। কেন্দ্রীয় কমিটির দুই সদস্য জিনোনিয়েভ ও কামেনেভের বিপ্লবের সিদ্ধান্ত মেনশেভিকদের কাগজে আগেভাগেই ফাঁসের বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও ৬ই নভেম্বর রাতে পূর্ব সিদ্ধান্ত মতো পূর্বতন জারের শীতপ্রাসাদ তথা কেরেনেস্কি সরকারের সদর দপ্তরে পার্শ্ববর্তী নেভা নদীতে নোঙর করা অরোরা জাহাজ থেকে কামানের গোলা বর্ষিত হল। এই গোলার আওয়াজই ছিল সারা দেশে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান শুরুর সংকেত। যে অভ্যুত্থান পরবর্তী দশদিনের তুমুল লড়াইয়ে ধ্বংস করল রাশিয়ার আধা পুঁজিবাদী-আধা সামন্ততান্ত্রিক শোষণমূলক রাষ্ট্রকে। প্রতিস্থাপিত করল শ্রমিক কৃষকের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে।

         নভেম্বর বিপ্লব আমাদের  শিক্ষা দিয়েছে কীভাবে একটি আধা সামন্ততান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক দেশে বিপ্লব সফল করতে হয়। শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী গড়ে তোলার পথ নির্দেশিকাও দিয়েছে এই বিপ্লব। নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা— দুনিয়াজোড়া সাম্রাজ্যবাদী শৃংখলের দুর্বলতম গ্রন্থিতে আঘাত হেনেই বিপ্লব জয়যুক্ত হতে পারে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে বিপ্লবী গৃহযুদ্ধে পরিণত করে বিপ্লব সফল করা সম্ভবপর হয়েছিল যুদ্ধক্লিষ্ট রুশ জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ওই একই সময়ে জার্মানিতে বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও বিপ্লব সফল হল না জার্মান সোস্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ সংশোধনবাদী তথা ‘সোস্যাল ডেমোক্রাট’ নেতাদের ভুলে। তাঁরা ঘটমান বিশ্বযুদ্ধে নিজেদের পিতৃভূমি রক্ষার জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগে ভেসে গিয়ে বিপ্লবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। বুর্জোয়াদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ফিরিয়ে দিলেন। এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রোজা লুক্সেমবার্গ ও কার্ল লিবনেখ্টের নেতৃত্বে জার্মান পার্টির সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশ মতাদর্শগত সংগ্রাম সংগঠিত করলেও শেষ রক্ষা হয় নি। বরং সুবিধাবাদী ‘সোস্যাল ডেমোক্রাট’দের মদতে ওই দুই নেতা ১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে ফ্যাসিস্টদের হাতে খুন হয়ে যান। 

এইভাবেই জার্মানিতে নাৎসিবাদের পথ প্রশস্ত হয়। লেনিনের নেতৃত্বে একটি কেন্দ্রীভূত পার্টি রাশিয়াতে বিপ্লব সফল করে কিন্তু জার্মানিতে এই রকম পার্টি না থাকায় বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে যায়। সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে সমগ্র শ্রমজীবী জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের লেনিনীয় নীতিতেই রুশ বিপ্লব জয়যুক্ত হতে পেরেছিল। জার্মানির নেতাদের, এমন কি এই প্রশ্নে রোজা লুক্সেমবার্গেরও ভিন্নমত ছিল। তিনি সর্বহারার আন্তর্জাতিক  সংগ্রামে নিপীড়িত  জাতিগুলি যে সর্বাধিক বিশ্বস্ত মিত্র হতে পারে, যা প্রমাণিত হয়েছে রুশ বিপ্লবের সাফল্যে, সেই মার্কসবাদী- লেনিনবাদী নীতিতেও আস্থাশীল ছিলেন না। এছাড়া ১৯০৩ সালে মেনশেভিকদের বুঝতে তিনি ভুল করেছিলেন। ১৯১৪ সালের জুলাইতে প্লেখানভ, গাণ্ডেরভল্ড, কাউৎস্কির মতো রোজাও বলশেভিক ও মেনশেভিকদের  মধ্যে সমঝোতার জন্য সওয়াল করেছিলেন। যদিও এক অসামান্যা বিপ্লবী হিসাবে রোজাকে লেনিন কদর করতেন। লেনিন রোজাকে বিপ্লবের ‘ঈগল পাখি’ বলে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর ভুলগুলি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছেন, কখনও সখনও ঈগল মুরগির উচ্চতায় নেমে আসতে পারে কিন্তু মুরগি কখনোই ঈগলের উচ্চতায় উড়তে পারে না।

 শেষমেশ নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা হিসাবে যে কথা বলা যায় তা হল—বিপ্লবী মতাদর্শ (মার্কসবাদ), বিপ্লবী সংগঠন (কমিউনিষ্ট পার্টি), বিপ্লবী কৌশল (নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ) ও বিপ্লবী পরিস্থিতি (স্থিথাবস্থার পরিবর্তনের জন্য শোষিত জনগণের আকাঙ্ক্ষা) ছাড়া বিপ্লব হয় না।