চলতি মাসটি নভেম্বর মাস। এই মাসকে বলা হয় বিপ্লবের মাস। আজ থেকে ১০৫ বছর আগে এই  মাসেই ঘটেছিল রুশ বিপ্লব। সাত থেকে সতেরোই নভেম্বর, যা ইতিহাসের পাতায় ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’ নামে অক্ষয় হয়ে আছে। নিঃসন্দেহে সারা দুনিয়া জুড়ে এই বিপ্লব তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কারণ এই বিপ্লবের মধ্য দিয়েই দুনিয়ার বুকে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে সমাজতান্ত্রিক  ব্যবস্থার। ব্যক্তি মালিকানাহীন, শোষণহীন সমাজব্যবস্থা, যেখানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যে প্রতিটি মানুষের হক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। গড়ে উঠেছিল সামাজিক মালিকানার রাষ্ট্র—মেহনতী মানুষের রাষ্ট্র।      

সমাজতান্ত্রিক মতবাদের স্রষ্টা কার্ল মার্কস  ও ফ্রেডরিক  এঙ্গেলস। এই মতবাদ হল মার্কসবাদ। মার্কসবাদের শিক্ষা, মানব সমাজ শোষক ও শোষিতে বিভক্ত হবার পরের ইতিহাস  হল শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের সর্বশেষ রূপ পুঁজিবাদী সমাজ। শোষক ও শোষিতের সংগ্রামের মধ্য দিয়েই পুরনো সমাজ ভেঙ্গে গিয়ে সৃষ্টি হয় নতুন সমাজ। পুঁজিবাদী সমাজ পর্যন্ত সব সমাজই  ছিল শোষণমূলক এবং এই সমাজ পর্যন্ত শোষণ হয়েছে তীব্র থেকে তীব্রতর। দাস সমাজে ক্রীতদাসত্ব, সামন্ত বা জমিদারি সমাজে ভূমিদাসত্ব আর পুঁজিবাদী সমাজে মজুরিদাসত্ব শোষণ ব্যবস্থার ভিত্তি। এই শোষণমূলক ব্যবস্থার  অবসান ঘটানো যে সম্ভব সেকথা প্রমাণিত হল নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।       

এই বার্তা রটে গেল দুনিয়ার  দিকে দিকে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘মুক্তি’ কবিতায় রুশ বিপ্লব সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন, ‘সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে চমক হেনে ভাঙল আগল—‘। আর ‘প্রলয়োল্লাস ‘ গীতিকবিতায় ধ্বনিত হল তাঁর উদাত্ত আহ্বান, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর—ওই নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়—‘। পরবর্তীকালে সারা বিশ্ব জুড়ে নভেম্বর বিপ্লবের বিজয়কেতন উড়েছে  এবং আজও উড়ে চলেছে।       

নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাবে বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে বিপ্লবী আন্দোলন নতুন গতিবেগ পেল। চীন, ভিয়েতনাম, ভারত সহ ইন্দোচীনের দেশগুলিতে গড়ে উঠল কমিউনিষ্ট পার্টি। এই বিপ্লবের প্রভাবেই পরবর্তী কালে চীন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, কিউবা সহ বেশ কিছু দেশে বিপ্লব সফল হল। পরাধীনতার শৃংখল ভেঙে স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়যুক্ত হল অনেকগুলি দেশ। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের বীর জনগণের অমিত পরাক্রমশালী মরণপণ সংগ্রামে পরাস্ত হল মানব সভ্যতার হিংস্রতম শত্রু ফ্যাসিবাদী শক্তি। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি ফ্যাসিস্ট হিটলারের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হল। পরবর্তী সময়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের নেতৃত্বে যুদ্ধবাজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বেশ কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ল। বিশ্বশান্তির  সংগ্রামে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন।          

 জার শাসিত রাশিয়া ছিল একটি অতি পিছিয়ে পড়া দেশ। ক্ষুধা, বেকারি আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে রাশিয়ার মানুষ ছিল জর্জরিত। অগণিত ভূমিদাসদের ওপর ছিল জারের তীব্র শোষণ। ‘জমি, রুটি, শান্তি’র দাবিতে নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়েই দারিদ্রক্লিষ্ট পশ্চাৎপদ রাশিয়া হয়ে উঠল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। সুসংহত অর্থনৈতিক নীতি, শিল্প ও কৃষির বিকাশ, শিক্ষার প্রসার, উন্নয়নের লক্ষ্যে পাঁচশালা পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সর্বোপরি সাধারণ শ্রমজীবী মানুষকে জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে উঠল পৃথিবীর অন্যতম সেরা, শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ দেশ। কৃষিবিজ্ঞান, জৈব প্রযুক্তি, যন্ত্রবিজ্ঞান, মহাকাশ গবেষণা, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান, পরমাণুবিজ্ঞান, জনশিক্ষায় ঘটল বিস্ময়কর অগ্রগতি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ক্রীড়াক্ষেত্রে অর্জিত হল নজর-কাড়া সাফল্য।         

 আজ আর সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই। মতাদর্শগত বিচ্যুতি ও ভুলের পরিণামে সে দেশটি ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সারা দুনিয়াজুড়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য। কিন্তু শোষিত মানুষের  সংগ্রাম থামে নি। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে প্রতিনিয়ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নীতি ও পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে প্রতিরোধ, ধ্বনিত হচ্ছে প্রতিবাদ। চীন সহ অপরাপর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি বর্তমান সময়োপযোগি পদক্ষেপে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। চীনের অভাবনীয় আর্থিক অগ্রগতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসাবে সমুপস্থিত। সোভিয়েত  ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পরে ফুকুয়ামার’এন্ড অফ হিস্ট্রি’ আর মার্গারেট থ্যাচারের ‘দেয়ার ইজ নো অল্টারনেটিভ’ তত্ত্ব মুখ থুবড়ে  পড়েছে পরবর্তী বিশ্ব ঘটনা প্রবাহে।           

পুঁজিবাদ চিরন্তন নয়। এরও অবসান  ঘটবে। শোষণহীন  সমাজের প্রথম স্তর হিসাবে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হবে। ক্রমান্বয়ে মানব সমাজ শ্রেণিহীন সাম্যবাদী ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাবে। এটাই মার্কসবাদের শিক্ষা। পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ অনিবার্য, কারণ ব্যক্তি মালিকানার শোষণমূলক ব্যবস্থা চিরকাল টিকে থাকতে পারে না। তবে এই উত্তরণ আপনা আপনি হবে না। শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সমস্ত শোষিত-বঞ্চিত অংশের ঐক্য ও বিপ্লবী সংগ্রামের  মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন ঘটাতে হবে। এটাই নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা। আর এই পথে পুঁজিবাদের বর্তমান রূপটিকে গনণায় রাখার দায়িত্ব শ্রমিক শ্রেণির ওপর এসে পড়েছে।         

কার্ল মার্কস  পুঁজি সম্পর্কে ব্যাখ্যায় পুঁজির পুঞ্জীভবন (Concentration), কেন্দ্রীভবন Centralisation) তথা একচেটিয়া রূপ পরিগ্রহের কথা বলেছিলেন। এই পুঁজিকে বলা যেতে পারে প্রথম প্রজন্মের পুঁজি। লেনিন বললেন লগ্নি পুঁজির কথা। একটি দেশের ব্যাঙ্কপুঁজি ও শিল্পপুঁজি  মিলিত হয়ে সৃষ্টি হয় লগ্নি পুঁজি। মুনাফার  জন্য সীমাহীন লালসার কারণেই লগ্নি পুঁজির চেহারা নিতে হল মার্কস বর্ণিত পুঁজিকে। একে বলা যেতে পারে দ্বিতীয় প্রজন্মের পুঁজি। লেনিনের যুগে লগ্নি পুঁজির চরিত্র ছিল দেশীয়—বাজার দখলের স্বার্থে তাই সেই সময় ঘটত দেশে দেশে যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। পুঁজিবাদ তার উচ্চতম স্তরে মুনাফা ও বাজারের লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদের স্তরে রূপান্তরিত হয়। তাই লেনিন লিখেছিলেন ‘সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর’ গ্রন্থখানি।  বর্তমানে এই লগ্নি পুঁজি বিপুল ও বৃহদায়তন আকার নিয়েছে। তার চরিত্র হয়েছে আন্তর্জাতিক। বর্তমানে দেশে দেশে আর বাজার দখলের যুদ্ধ নেই। বিপুল লগ্নি পুঁজির মালিক  মাল্টিন্যাশনাল, ট্রান্সন্যাশনাল কোম্পানিগুলি তথা বিশ্ব পুঁজিবাদী শিবির সম্মিলিতভাবে বিশ্বকে অর্থাৎ বিশ্বের বাজারকে কব্জা করার চেষ্টায় মত্ত। আগ্রাসী চেহারার লগ্নি পুঁজির বিনিয়োগের কেন্দ্রীয় নজর শেয়ার বাজারে, ফাটকায়। আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি ক্রমশ আন্তর্জাতিক ফাটকা পুঁজির রূপ পরিগ্রহ করছে। এই উদ্দেশ্য সিদ্ধির লক্ষ্যেই অর্থাৎ বিশ্বের শেয়ার বাজারের ওপর, বিনিয়োগ  ক্ষেত্রের ওপর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই  এসেছে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন। চরিত্রে অতি মাত্রায় সঞ্চরণশীল এই পুঁজিকে তৃতীয় প্রজন্মের পুঁজি  বললে ভুল হবে না।         

আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির ভয়ংকর মুনাফা লালসা ও সর্বগ্রাসী চরিত্র জন্ম দিয়েছে অতি দক্ষিণপন্থার রাজনীতির। ফলশ্রুতিতে জনসাধারণের ঘাড়ে একদিকে আর্থিক সংকটের বিপুল বোঝা চাপাচ্ছে শাসক শ্রেণি, অন্যদিকে খর্ব করা হচ্ছে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার। একই ঘটনা ঘটছে দেশে-বিদেশে সর্বত্র। আই এম এফ-এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে আর্থিক বৃদ্ধির হার ক্রমশ কমছে। ২০২১ সালে যা ছিল ৬ শতাংশ, ২০২২ সালে হয়েছে ৩.২ শতাংশ। ২০২৩ সালে তা আরও কমে দাঁড়াবে ২.৭ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতির হার ক্রমবর্ধমান। ২০২১-এর ৪.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২-এ এই হার ৮.৮ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশে মোদী জমানায় ইউ এস ডলারের দাম ৫৮ টাকা থেকে বেড়ে হয়ে গেছে ৮৩ টাকা। অর্থাৎ টাকার দাম ক্রমশ কমছে। অন্য দিকে চীনের আর্থিক বৃদ্ধির চিত্রটি ঠিক এর উল্টো। পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের পার্থক্য এক্ষেত্রে পরিষ্কার।            

অতি দক্ষিণপন্থার প্রভাবে দেশে-বিদেশে নয়া ফ্যাসিস্টদের আত্মপ্রকাশ এই সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ইতালি ও সুইডেনে এই প্রবণতা দেখা গেছে। গ্রেট ব্রিটেনে সবচাইতে স্বল্পস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী লিসকে সরে যেতে হয়েছে লগ্নি পুঁজির মালিকদের পূর্ণ স্বার্থ রক্ষা না করতে পারার অপরাধে। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক তাই অনেক বেশি আগ্রাসী জনস্বার্থ কোতল করার প্রশ্নে। বিপরীতে ব্রাজিল সহ সমগ্র লাতিন আমেরিকায়, ইউরোপের দেশ ডেনমার্কে নির্বাচনী ফলাফলে বামপন্থীদের জয় জয়কার।         

বিশ্ব লগ্নি পুঁজি পুঁজিবাদের  সংকটকে চেপে রাখতে পারছে না। বাড়ছে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, তীব্র বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, শোষণ-বঞ্চনা-অত্যাচার। তাই একথা বলা যায় দুনিয়ায় যতদিন পুঁজিবাদ থাকবে ততদিন নভেম্বর বিপ্লবের দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত  থাকবে, উড্ডীন থাকবে তার বিজয়কেতন । নূতনের বিজয়কেতন।