১৯১৭ সালের দুনিয়া কাঁপানো দশদিনের নভেম্বর বিপ্লব ছাড়া সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়ে উঠত না এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফ‍্যাসিবাদকে রোখা যেত না। এই ইতিহাসকে অস্বীকার করলে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন,খেটে খাওয়া মানুষের মজুরির ও সামাজিক নিরাপত্তার জন‍্য লড়াই নেহাতই পণ্ডশ্রম মনে হবে। এমনকি এই ধরণের যাবতীয় আন্দোলনকে অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়াও আশ্চর্য নয়। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপে ব্রিটেন,ফ্রান্স,জার্মানী,ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মধ‍্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের সচেতন ভূমিকা ও অর্থনৈতিক সংকটের সমাধানের জন‍্য শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হতে পেরেছিল কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিক কৃষক মেহনতী জনতা দেখিয়েছিলেন তাঁরা রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। মার্কস এঙ্গেলস তাঁদের কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার পুস্তিকা শুরু করেছিলেন যে বাক‍্যটি দিয়ে ” ইউরোপ ভূত দেখছে কমিউজমের ভূত “- তার বাস্তব রূপ প্রকটভাবে দেখা গিয়েছিল ধনতান্ত্রিক বিশ্বে। কারণ কমিউনিজম এর মতাদর্শে সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণী কি অসাধ‍্য সাধন করতে পারে তা কমিউনিস্ট ইস্তাহার প্রকাশের ঊনসত্তর বছরের মাথাতেই হাতে কলমে দেখিয়েছিল নভেম্বর বিপ্লব। ধনতান্ত্রিক বিশ্বের অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের জন‍্য প্রচলিত ঔপনিবেশিক নীতিও ধাক্কা খেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই।

শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সার্থক উদাহরণ হিসাবে যেমন ১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লবের কথা বলা হয় তেমনি ১৯০৫ সালে রাশিয়ার ব‍্যর্থ বিপ্লব প্রয়াসের শিক্ষা ছাড়া যে বারো বছর পরের সাফল‍্য আসত না তা নভেম্বর বিপ্লবের নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন বার বার বলেছেন। এবং জারতন্ত্রের আধিপত্য খর্ব করে আইনসভা ডুমা র প্রশাসনিক মর্যাদালাভের ফলে রাশিয়াতে সংসদীয় গণতন্ত্রের যুগের সূচনা হয়েছিল ঐ সময়েই। রুশ- জাপান যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের ফলে রাশিয়ার বিপর্যস্ত অর্থনীতির প্রভাব জনজীবনে ব‍্যপকভাবে পড়েছিল। শুরু হয়েছিল অর্থনৈতিক মন্দা, শ্রমিক ছাঁটাই। ১৯০৫ সালের ২২শে জানুয়ারি রক্তাক্ত রবিবারে শীত প্রাসাদে জার দ্বিতীয় নিকোলাসের কাছে আবেদনপত্র পৌঁছে দিতে যাওয়া শ্রমিকদের বিরাট মিছিলে জারের বাহিনী নির্মমভাবে আক্রমণ চালিয়ে প্রায় দুশো শ্রমিককে হত‍্যা করে,তার চেয়েও আটশো শ্রমিককে জখম করে এবং ছয়হাজারের বেশি শ্রমিককে বন্দী করে। এই অভিযানে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ধর্মযাজক ফাদার জর্জি গ‍্যাপন। নির্মমভাবে দমনের পরেও শ্রমিক বিক্ষোভ প্রশমিত হয়নি বরং বূর্জোয়া শ্রেণীও চাইছিল তাদের আর্থিক ও সামাজিক প্রতিপত্তি বিস্তারের রাজনৈতিক অধিকার। সোশ‍্যালিস্ট রেভেলিউশনারি পার্টি অফ রাশিয়ার মেনশেভিক নেতা ভিকটর চের্নভ ও লিও ট্রটস্কি এবং বলশেভিক নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন যেমন নিরবচ্ছিন্নভাবে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করছিলেন তেমনি শিল্পপতি গোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রতিনিধি সের্গেই উইট জার দ্বিতীয় নিকোলাসের ওপর সাংবিধানিক সংস্কারের জন‍্য রীতিমতো চাপ সৃষ্টি করছিলেন। ফলে ১৯০৬ সালে ২৬শে মে প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ‍্যমে আইনসভা ডুমা স্থাপিত হয়। যদিও ডুমার অস্তিত্ব পুরোপুরি জারের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং ডুমার সদস্যদের হাতে প্রশাসনে প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণ ও জার মন্ত্রীসভাকে প্রশ্ন করার অধিকার কেবল দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ে সামন্ততান্ত্রিক শাসনের শেষ পর্যায়ে গণতান্ত্রিক যুগে প্রবেশ করার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে এই পরিবর্তনকে অবশ‍্যই চিহ্নিত করা যায়।

ঐতিহাসিক ক্রমপর্যায় অনুযায়ী কার্ল,স্ক‍্যাপার, কার্ল মার্কস ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের নেতৃত্বে ১৮৪৭ সালে কমিউনিস্ট লীগ ছিল বিপ্লবী সর্বহারা শ্রেণীর প্রথম আন্তর্জাতিক সংগঠন। কমিউনিস্ট ম‍্যানিফেস্টো এই সংগঠনের
ই প্রয়োজনে লিখিত হয়েছিল। বূর্জোয়া শ্রেণীর উৎখাত এবং কমিউনিস্ট সমাজ গঠনের লক্ষ্যে “দুনিয়ার মজদুর এক হও শ্লোগান “এই সংগঠনেরই অবদান। বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করা ও তার নীতি কর্মসূচি নির্ধারণে সহায়তা করা,মতবিনিময়ের জন‍্য ১৮৬৪ সালে মার্কস এঙ্গেলসের উদ‍্যোগেই উন্নততর আকারে প্রথম কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গঠিত হয়েছিল। বিজ্ঞানভিত্তিক কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশের শ্রমিক শ্রেণীর ভ্রাতৃত্বমূলক ঐক্য গড়ে তোলার জন‍্য সক্রিয় সংগ্রাম পরিচালনা করা প্রয়োজন বলে এই সংগঠন বিভিন্ন দেশের শ্রমিকদের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহায়তা এবং ঐক‍্যের মনোভাব ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ১৮৭১ সালের প‍্যারি কমিউনের প্রেরণা হিসাবে প্রথম কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক
অবশ‍্যই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু এটাও ঘটনা ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধে কমিউনিস্ট মতাদর্শের বহু প্রচারক থাকলেও বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের পূর্বে কেউ শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রণী বাহিনী হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টিকে সংগঠিত করার কথা ভাবেন নি। ১৯১৭ সালে নভেম্বর বিপ্লবের পরেই পৃথিবীর প্রথম বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে বলশেভিক পার্টি আত্মপ্রকাশ করেছিল। তার আগে বলশেভিক পার্টি ছিল রেভেলিউশনারি সোস‍্যালিস্ট পার্টি অফ রাশিয়ার চরমপন্থী অংশ যা মেনশেভিক অর্থাৎ নরমপন্থীদের সঙ্গে রাষ্ট্রবিপ্লবের পন্থা নিয়ে নিরন্তর সংঘাত ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়ত। মেনশেভিক নেতা লিও ট্রটস্কি ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর নির্বাসন থেকে ফিরে আসেন এবং বলশেভিক পার্টির অন‍্যতম নেতা হিসাবে যোগ দেন।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে কৃষকের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীর নির্ভুল বোঝাপড়া গড়ে তোলার তত্ত্ব লেনিনের অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান। ১৯০১ সালেই শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি ও কৃষক প্রবন্ধে তিনি ভূমিদাসত্বের অবশেষ দূর করার জন‍্য দাবি জানানোকে অগ্রগামী শ্রমজীবী সংগঠনের অবশ‍্য কর্তব‍্য বলে চিহ্নিত করেছেন। রাশিয়াতে ১৯০২ সালে ব‍্যর্থ কৃষক বিদ্রোহের পরে গ্রামের কৃষক ও শহরের শ্রমিকদের মধ‍্যে আন্দোলনের জন‍্য কার্যকরি সহযোগিতা গড়ে তোলার প্রয়োজনীতা লেনিনের পক্ষে বোঝানো সহজতর হয়েছিল। সামন্তবাদ ও স্বৈরতন্ত্র থেকে কৃষকদের মুক্তি একমাত্র নীচে থেকে কৃষকদের বিপ্লবী শক্তির পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ‍্যমেই সম্পন্ন হতে পারে একথা প্রথম থেকেই লেনিন বলেছিলেন এবং শ্রমিকদের কাছেও বূর্জোয়া ও পেটিবূর্জোয়া সংস্কারের প্রতারণামূলক দিকটি উন্মোচন করেছিল। বিপ্লবের মাধ‍্যমে রাষ্ট্রের মতৌই উৎপাদন ব‍্যবস্থায় শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা যেমন অবশ‍্য কর্তব‍‍্য হিসাবে লেনিন চিহ্নিত করেছিলেন,তেমনি গ্রামে বিপ্লবী কৃষক কমিটি গঠন করে তার মাধ‍্যমে জমিদারি বাজেয়াপ্ত করার লক্ষ্যে বিপ্লবী সংগ্রাম সংগঠিত করা প্রধান কাজ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

শ্রেণী সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণীর বিজয়ের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে নভেম্বর বিপ্লব কিভাবে রক্তক্ষয় ছাড়া সুসম্পন্ন হয়েছিল তা আজও অনেকের বিস্ময়। আগামী পর্বে আমরা সেই দিকে আলোকপাত করার চেষ্টা করব।

(দ্বিতীয় পর্বে সমাপ‍্য)