তৈরি করার একটা কৌশল রয়েছে। এই কৌশলটা রপ্ত করতে পারলেই আমরা ইচ্ছামত আমার মতামতকে আপনার উপর চাপিয়ে দিতে পারি এবং আমার উদ্দেশ্যকে সম্পূর্ণ গোপন রেখেই এই কাজ করা সম্ভব। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটা বড় অংশ এভাবেই জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হন। সম্পত্তির মালিকানা স্বত্বের উপর ভিত্তি করেই মতামত গঠন করা হয়।

প্রাক পুঁজিবাদী যুগে এই কাজটা করতেন ধর্মনেতারা। যদিও সব ধর্মই ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো না। যেমন, বৌদ্ধধর্ম, কনফুসিয়ান মতামত ইত্যাদি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই সমস্ত ধর্মীয় মতামতে বিশ্বাসীদের মধ্যেও একদল ধর্মনেতা ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল। এঁরাই পরবর্তী সময়ে ঈশ্বরের অনস্তিত্বে বিশ্বাসীদের ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী করে তুলেছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, গৌতম বুদ্ধ নিজে পুত্তলিকা পুজোর চরম বিরোধী ছিলেন। তিনি তাঁর শিষ্যদের সাথেও এ বিষয়ে বহুবার বহু আলোচনা করেছিলেন। আর দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা ব্রাহ্মণ্যবাদের নানান কঠিন কঠিন সামাজিক বিধান থেকে তৎকালীন সমাজের শ্রমজীবী-মেহনতি জনগণও মনেপ্রাণে চাইছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদের সেইসব কঠিন কঠিন বিধান থেকে বেরিয়ে এসে মুক্ত হাওয়ায় একটু প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে। গৌতম বুদ্ধ শ্রমজীবী-মেহনতি জনগণকে সেই মুক্ত হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়ার ক্ষেত্রটি রচনা করবার পথের দিশা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু চূড়ান্ত বেদ বিরোধী বৌদ্ধদের মধ্যেই ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে থাকে একদল বেদজ্ঞ মানুষ। এঁরা উচ্চ ব্রাহ্মণ পরিবার থেকেই দলে দলে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকেন। শেষ জীবনে বুদ্ধদেব নিজেই আশ্চর্যের সঙ্গে এটা লক্ষ্য করেছিলেন। বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর এঁরাই দ্বিগুণ উৎসাহে দলে দলে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করতে থাকেন এবং ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্মের ব্যাখ্যাকার হয়ে ওঠেন। নাগার্জুন ছিলেন এদের মধ্যে অন্যতম। উচ্চ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। সংস্কৃত ভাষায় পন্ডিত নাগার্জুন ছিলেন একজন বিখ্যাত বেদজ্ঞ পন্ডিত মানুষ। এই নাগার্জুন একটি গ্রন্থ আবিষ্কার করেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের নামে অদ্বৈতবাদের প্রচার করতে থাকেন। এই গ্রন্থটির নাম হলো, প্রজ্ঞা পারমিতাসূত্র।

প্রজ্ঞা পারমিতাকে গৌতম বুদ্ধের বাণী হিসেবে চিহ্নিত করতে একটি গল্প তৈরি করা হয়েছিল। এই গল্পটিই হলো কৌশল। যে কৌশলে পুতুল পুজোর চরম বিরোধীতা করা গৌতম বুদ্ধকেই পুতল হিসেবে পুজো করা হতে থাকে।

মধ্যমা প্রতিপদ্ কে নাগার্জুনের দর্শনের অন্যতম সূত্র হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। যার অর্থ হলো মধ্যপথ। তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের নাম রাখেন মাধ্যমিক কারিকা।  মাধ্যমিক কারিকা আসলে প্রজ্ঞা পারমিতার সূত্রের টীকা। এখানে তিনি মধ্য পথকে তাঁর মতো করে ব্যাখ্যা করেন এবং মধ্যমা প্রতিপদে অধিবিদ্যক রহস্যের সংযুক্তি ঘটিয়ে চরম সত্তাকে চূড়ান্ত অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব কোনটিতেই ব্যাখ্যা করতে অস্বীকার করলেন। অর্থাৎ অস্তি ও নাস্তি কোনভাবেই চরম সত্তাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এভাবেই তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে এক রহস্য তৈরি করলেন যা শূন্যবাদের জন্ম দেয়। তিনি বললেন, সৃষ্টি কথাটাই মিথ্যা। যা কিছুই পৃথিবীতে এসেছে তা শর্তাধীন। আপনা আপনি কোন কিছুই সৃষ্টি হয়নি। সৃষ্টির ব্যাপারটাই মিথ্যা। তিনি শূন্যবাদের নামে যা বলেছিলেন তা হলো ভাববাদের সপক্ষে মোক্ষম যুক্তি। এভাবেই একটি যুক্তিবাদী মতবাদ ভাববাদী মতবাদের অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হলেছিল এবং বেদ বিরোধী গৌতম বুদ্ধ হিন্দু ধর্মের অবতারে পরিণত হয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে যে, ভাববাদ আসলে ব্যক্তি সম্পত্তিকে টিকিয়ে রাখারই এক হাতিয়ার। সম্পত্তি (পুঁজি) ও শ্রমের মধ্যে এক রহস্য তৈরি করে মৃত্যুর পরে কল্পিত স্বর্গের আশায় ইহজীবনে কষ্ট সহ্য করে যাওয়া ও গতানুগতিকতাকে মেনে নেওয়া সম্পর্কে জনমত তৈরি করাই ভাববাদীদের মূল লক্ষ্য, এবং এরা এটাই করে থাকে জনগণের সমর্থন আদায় করেই।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মতামতের একটা হেজিমনি থাকে। এই হেজিমনিটা প্রতিষ্ঠিত কথাই হচ্ছে কৌশল। এই কৌশলের সফল প্রয়োগের ফলেই সমাজের সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশকে প্রতিনিধিত্ব মূলক গণতন্ত্রে ব্যাক্তি মতের যে গুরুত্ব সেটিকে এই পীড়ন মূলক ব্যবস্থার পক্ষেই দাঁড় করিয়ে দেয়। একটি বুলেট বা লাঠির ভয় না দেখিয়েও দুনিয়ার সব থেকে বড় যুদ্ধবাজ আমেরিকার গায়ে ‘ডেমক্র্যাট’ ও ‘রিপাবলিক’ নামক গনতন্ত্রের জামা গলিয়ে রাখা যায়।

বর্তমান ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলি গভীর ভাবে পর্যবক্ষেণ করলে এই কৌশলী রাজনীতির বহু উদাহরণ আমরা দেখতে পাই। সোভিয়েতের পতন থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আফসোস আমরা বারংবার একথা উল্লেখ করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ নজরে আসেনি। ফলতঃ গতানুগতিকতার সাথেই ভেসে বেড়ানো চলতে থাকে। পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির পরিবর্তে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ব্যাপক প্রচার যখন সব থেকে বেশি জরুরি ছিল ঠিক তখনই আমরা মূলত বাজার অর্থনীতির পক্ষেই সোচ্চার হতে থাকি। ফলে ব্যাপক শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষ হতবাক হয়ে পরে এবং জন্ম নেয় এক পপিউলার রাজনীতির। মূলত কৃষক আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই জন্ম হলেও আসলে এটা হলো চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল শাসকের এক মুখোশ। কিন্তু শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষ যেহেতু দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা গতানুগতিকতার থেকে বেরিয়ে এসে মুক্ত হাওয়ায় একটু প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে চাইছিল তাই তারা খুব সহজেই পপিউলার নেতা-নেত্রীদের ভাষণের দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকেন এবং নিজেই নিজের তৈরি অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করে শূন্যবাদের দ্বারা পরিচালিত হতে থাকেন। কিন্তু খুব অল্প দিনের মধ্যেই বোঝা যাচ্ছিল যে, পপিউলার রাজনীতি দিয়ে সর্বদা সবাইকে খুশি রাখা যাচ্ছে না, মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে। তবুও সেই ক্ষোভকে, অর্থনৈতিক দাবি দাওয়াকে রাজনৈতিক দাবি দাওয়ায় রূপান্তরিত করা গেল না। ফলে মানুষের মধ্যে আরও ক্ষোভ সঞ্চারিত হলো। এমতাবস্থায় জন্ম নেয় সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তা যা ফ্যাসিবাদেরই নামান্তর। নয়া পপিউলারিজম ও উগ্র জাতীয়তাবাদের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। যদিও এই দুই শক্তির মধ্যে সংঘাত ছিল আসলে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যেকার লড়াই। কিন্তু এই লড়াইতে দুপক্ষই শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষকে সামিল করাতে সক্ষম হন। গতানুগতিকতার বাঁধন ছিঁড়ে শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষকে এই ছায়া যুদ্ধে বিরত থাকার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে হেজিমনি সৃষ্টি করতে না পারার ফলে সৃষ্টি হয় এক অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর পরিস্থিতি। সৃষ্টি হয় এমন এক পরিস্থিতির যাঁর ফলে সরকার ও বিরোধী পক্ষ ব্যক্তি মালিকানার পূজারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের সামান্যতম প্রতিনিধিত্বও বিলুপ্ত হয়। দুঃখের বিষয় হলো এই পরিস্থিতি তৈরি করা হলো তাদের নিয়েই যাদের বিরুদ্ধে এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করা হবে। অর্থাৎ তারা জানতেই পারলেন না যে, তারা কিসের বদলে কি প্রতিষ্ঠিত করতে চলেছেন;  কিন্তু বিচার সম্পন্ন হয়ে গেল। এটা এমনই এক কৌশল যার ফলে আমি, আপনি,  আপনারা সকলে মিলে নিজেদের ডেথ সার্টিফিকেটে হাসতে হাসতে স্বাক্ষর করে দিলাম এবং নিজের এই কৃতকর্মের জন্য অতুলপ্রসাদ লাভ করলাম।

এই কৌশলের মোকাবিলা করবার জন্য দরকার আত্ম নির্মাণের। দরকার ব্যাক্তি পুঁজির বদলে যৌথ পুঁজির বিকাশের। কিন্তু সে অবকাশ আজকের দিনে কোথায়ই বা আমরা প্রত্যক্ষ করছি! উল্টে ব্যাক্তি পুঁজিকে আঁকড়ে ধরেই সমাজতন্ত্রে পৌঁছে যাওয়ার দিবা স্বপ্ন দেখছি। আশার কথা এটাই যে, এখনও বেশ কিছু মানুষ স্রোতের বিপরীতে চলবার অসীম ধৈর্য ও সাহস দেখিয়ে চলেছেন। NRC বিরোধী আন্দোলনে, দিল্লিতে চলতে থাকা কৃষক আন্দোলনে ও করোনা পরিস্থিতিতে গড়ে ওঠা ‘রেড ক্যান্টিন’ নামক যৌথ খামার (কাউন্টার হেজিমনি) গড়ে তোলার মধ্যে দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। শত সম্পত্তিবানদের চরিত্র পরিবর্তন স্বত্বেও সম্পত্তি বিহীন রাষ্ট্র গড়ার ন্যায্যতা গড়ে উঠতে পারেনি। সুতরাং সম্পত্তির বন্টনের সাম্য আনা অনিবার্য হয়ে গেছে। ব্যক্তি সম্পত্তি বিহীন রাষ্ট্র গড়ার কাজটাতে যাঁরা হাত লাগান, তাঁদের লড়াইটা হল এই প্রভাব বলয়ে হেজিমনি সৃষ্টি করার লড়াই। আন্তেনিও গ্রামশি যাঁদের সংপৃক্ত (Organic) বুদ্ধিজীবী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এঁরাই ক্রমাগত ব্যক্তি সম্পত্তি বিহীন সমাজ গড়ার ন্যায্যতার সম্পর্কে সংখ্যা গরিষ্ঠের মতামত আদায় করবেন এবং এই কাজকে ত্বরান্বিত করার লড়াই চালিয়ে যাবেন। পপিউলারিজমের নামে, উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে পুরাতন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার সমস্ত কৌশলের বদলে শ্রমজীবী-মেহনতিকে নিয়ে ও ব্যাপক জনগণের সমর্থনে নতুন কৌশলকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। অতএব মালিকানা স্বত্বের আমূল পরিবর্তন না ঘটা পর্যন্ত স্বাধীন ভাবে মতামত ঘঠনের পরিবেশ পরিস্থিতি ও গঠন করা যায় না। সুতরাং ফাইট ফাইট এবং ফাইট…