দেশে ৩৮টি দল একসাথে বৈঠক করেছে দেশের ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে আগামী ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এবং বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগ হতে দেবে না। এই মুহুর্তে বিজেপি বিরোধিতা অর্থাৎ দেশের অনেকগুলি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বিজেপি বিরোধিতা কেন প্রয়োজন দেশের স্বার্থে, সে বিষয়ে বামপন্থীদের সুনির্দিষ্ট ঘোষিত অবস্থান আছে। সি পি আই (এম) দল তার সর্বশেষ পার্টি কংগ্রেসেই সেই ঘোষিত অবস্থান স্পষ্ট করেছে যে দেশে প্রধান শত্রু হলো আর এস এস চালিত বিজেপি দল। স্বাধীন দেশের জন্মলগ্নের আগে থেকেই আর এস এস যে স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবং সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতারই বিরুদ্ধে তা তাদের নেতা সাভারকারের ব্রিটিশ সরকারের কাছে মুচলেখার ইতিহাসই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আমাদের। তাই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে গৌরবের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের কথা লেখা আছে। দেশের শ্রমজীবী, কৃষিজীবী মানুষের মধ্যে আন্দোলন গড়ে তুলেছে প্রাক-স্বাধীনতা যুগ থেকে কমিউনিস্ট পার্টি। এই কথার আজ প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? এই প্রসঙ্গ এসে পড়ে যখন এই সি পি আই (এম) সহ অন্যান্য কমিউনিস্ট পার্টি এবং বামপন্থী দলগুলি ২০২৪ সালের ভোটে ৩৮ টি দলের জোটে অংশগ্রহণ করে এবং তা নিয়ে গণমাধ্যম এই দলের দেশভক্তি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে। আসলে আর এস এস পরিচালিত বিজেপি কোনোমতেই বামপন্থীদের শাসনক্ষমতায় থাকা বরদাস্ত করে না। কিন্তু দেশের মধ্যে বামপন্থীদের পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলির ইতিহাস চর্চা করলে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে খুব বেশি কিছু বক্তব্য এখনো শোনা যায় না। দেশে অন্যান্য অনেক দল সম্পর্কে যে ভাবে জনবিরোধিতা, দুর্নীতির কথা শোনা যায়, বামপন্থীদের ক্ষেত্রে তা শোনা যায় না। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের প্রবাদপ্রতিম মুখ্যমন্ত্রী সি পি আই (এম) দলের নবরত্নের অন্যতম জ্যোতি বসু বিজেপিকে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর আখ্যা দিয়েছিলেন ‘অসভ্য বর্বর’ যা তিনি আমৃত্যু বলে গেছেন। ২০১৭ সালের গোমাংস রাখার সন্দেহে পেহলু খান খুন থেকে ২০২৩ সালে মণিপুরের উপজাতি মহিলার দলবদ্ধ ধর্ষণ – এর কোনটাই কি বিজেপি কে দেশ শাসন করার যোগ্যতা দেয়? এ কথা সত্য যে বিজেপি দল দেশের, দেশবাসীর শত্রু। বামপন্থীরা এই কথা অনেক আগেই বুঝেছিল। কংগ্রেস এবং বামপন্থী দল কোনদিনই বিজেপি দলের সাথে কোন সমঝোতা কোনদিন করে নি। তাই বামপন্থীরা এবং কংগ্রেস দলের বিজেপি বিরোধী অবস্থান নিয়ে বিস্ময় প্রকাশের কোন ভিত্তি নেই।তাছাড়া এই বিজেপি বিরোধিতার মধ্যে সততা আছে, আছে একাগ্রতা। ঠিক এই কারণেই ইউ পি এ ১ সরকারকে বাইরে থেকে বামপন্থীরা সমর্থন জানিয়েছিল। তৈরি হয়েছিল কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম- ঐকমত্যের ভিত্তিতে ন্যুনতম প্রক্রিয়ায় জনহিতকর প্রকল্প গ্রহণ করা। সেই সময়ে চালু প্রকল্প রেগা বা ১০০ দিনের কাজ। সে সময়ে চালু হল তথ্য জানার অধিকার আইন বা রাইট টু ইনফর্মেশন অ্যাক্ট।এরকম আরও অনেক জনহিতকর আইন এবং প্রকল্প দলমত নির্বিশেষে দেশের মানুষের স্বার্থে চালু করতে ঐকমত্য হয়েছিল কয়েকটি রাজনৈতিক দল।

ভারতীয় জনতা পার্টি পরিচালিত এন ডি এ এরকম কিছু তো করতে পারলই না; বরং একের পর এক গণতন্ত্র রোধ করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে লাগল। ধর্ম, জাত, পাত, পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ শাণিত করে ভয়ভীতির পরিস্থিতি সৃষ্টি করল যাতে সব রকম বিরোধিতার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। তাই যেদিন থেকে বিজেপি বিরোধী জোটের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে সেদিন থেকেই আর এস এসের শক্তি সোচ্চার হয়েছে এই জোটের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বেশি আক্রমণ ধেয়ে এসেছে বামপন্থীদের দিকে। কেন এই আক্রমণ? কারা করছে এই আক্রমণ? স্বাভাবিকভাবেই যারা বিজেপি সরকারে থাকলে সুবিধা লাভ করে তারাই এই জোটের সম্ভাবনায় বিচলিত। সাধারণ মানুষ বিচলিত নয়; তাই যারা বিচলিত তারা উঠে পড়ে লাগল সাধারণ মানুষ অর্থাৎ যারা ২০২৪ সালের ভোটার তাঁদের মনকে বিচলিত করতে। কারা এই জোটে আতঙ্কিত? আর এস এস চালিত বিজেপির মদত দানকারী শক্তি আসলে কোটিপতি কর্পোরেট বাহিনী। আমরা সকলে এতদিনে জেনে গেছি আদানি গোষ্ঠীর শঠতার কথা। এরকম আরও অনেক গোষ্ঠী আছে যারা নির্বাচনী বন্ড কিনে সরাসরি বিজেপি কে লোকসভা নির্বাচনে ঢেলে আর্থিক সাহায্য করবে। অতীতে এই ঘটনাই ঘটেছে। আদানি গোষ্ঠীর ওপর মোদী সরকারের নির্ভরতা প্রকাশ্যে এসেছে বেশ কিছুদিন হল। এই কর্পোরেট গোষ্ঠী কেন মোদী সরকারকে সমর্থন করছে এবং কোটি কোটি টাকা ঢেলে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হল তাদের ব্যবসার স্বার্থে। তাদের অল্প সময়ে কোটিপতি হয়ে ওঠা , একছত্র আধিপত্য বিস্তার করা এবং দেশের প্রাকৃতিক, আর্থিক সব সম্পদের ওপর মালিকানা কায়েম করতে হলে এই গণতন্ত্র হরণ, মানুষকে ভয়ভীতি প্রদর্শণ বজায় রাখা দরকার। তবেই একমাত্র তাদের আর্থিক আধিপত্য বিস্তৃত হবে; দেশের একছত্র বাজারের দখল পাওয়া যাবে। এই মালিকানাই বহাল রয়েছে দেশের প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে। তাই সেই গণমাধ্যমই সবচেয়ে প্রথম এই জোটের বিরোধিতায় নেমে পড়ল এবং এই জোট যে কার্যকরী নয়, তা নিয়ে প্রচার শুরু হল একমাত্র এই কর্পোরেট পোষিত গণমাধ্যমেই। এই জোটের বিরুদ্ধে জোটে অন্তর্গত রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে বিক্ষোভ হয়েছে? না। এই জোটের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ কথা বলেছেন? কথা বলেছেন কি বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ? না। মানুষের মুখে কথা যোগানোর কাজ করছে শাসক এবং কর্পোরেট মালিকের মদত পুষ্ট মিডিয়া।

আসলে কর্পোরেটের মদতপুষ্ট মিডিয়া এই জোটের সম্ভাবনায় আশঙ্কিত। তাই বলা হচ্ছে বা বলার চেষ্টা করা হচ্ছে যে জোটের বাস্তবতা নেই। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস এই জোটে নাম লিখিয়েছে; কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস সেই দল যা বিজেপি কে হাত ধরে পশ্চিমবাংলার মাটিতে নিয়ে এসেছিল। তারা জোটে থাকলেও তাদের যেহেতু ঘোষিত শত্রু বামপন্থীরা, পশ্চিমবঙ্গে তাদের সঙ্গে বামপন্থীদের জোট হওয়ার সম্ভাবনা যে নেই, সে কথা দিনের আলোর মত স্পষ্ট। পশ্চিমবঙ্গের সর্বশেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসা, তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতির কদর্য রূপ, এর কোনটাই রাজ্যবাসীর অধিকার রক্ষার কথা বলে না। এ ছাড়া সর্বোপরি বলা যায় তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতি সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। এই দলের কোন ঘোষিত রাজনীতি নেই; জন্মলগ্ন থেকে এই দলের নেতিবাচক অবস্থান। এই দলের কংগ্রেস বিরোধিতা, বামপন্থীদের বিরোধিতা করেই পরিচয় এবং উত্থান। তাই এরা জোটে নাম লেখালেও, যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া এদের কোথাও অস্তিত্ব নেই, স্বাভাবিকভাবেই এই দলের বিরোধিতা করবে বামপন্থীরা এবং স্পষ্টভাবে ভোটদাতাদের কাছে আবেদন জানাবে বিজেপি বিরোধী ভোট যাতে কোনভাবেই ভাগ না হয়। এই সহজ সত্য গুলিয়ে দিতে চাইছে বিজেপি এবং বিজেপি মদতপুষ্ট গণমাধ্যম।

এই ৩৮ টি দলের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগ হতে না দেওয়া। কিন্তু তাই বলে জোট শুধু কি পাটিগণিতের অঙ্ক? না কি জোটের একটি রাজনৈতিক চরিত্র আছে? ২০২৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জোটের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সবকিছুই আছে; কিন্তু প্রচার করা হচ্ছে জোট যেন পাটিগণিতের অঙ্ক। ভোট হলে নির্বাচনের পরে একটি পাটিগণিতের অঙ্কের গুরুত্ব নিশ্চয়ই থাকে; কিন্তু দেশের লোকসভা ভোটে দেশের মানুষের জীবন যাপনের ভবিষ্যৎ স্থির হয়, তা কি করে শুধুই পাটিগণিতের অঙ্ক হয়? কি করে তা শুধুই হয় যোগবিয়োগ? যারা ভোটে জিতে গেলেও বিরোধী প্রার্থী বরদাস্ত করতে পারে না; যারা একজন মাত্র বিরোধী থাকলেও তাকে ছলে বলে কৌশলে কিনে নেওয়ার চেষ্টা করে; তাদের কাছে জনগণের ভোট শুধুই পাটিগণিত।

২০২৪ সালের ভোটে কিন্তু দেশের মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। বেকারি, অনাহার, অশিক্ষা, অপুষ্টিতে আক্রান্ত দেশের অধিকাংশ মানুষ। প্রশ্ন যখন এখানে যে কয়েকজন কোটিপতি দেশ চালাবেন না কি দেশের আপামর সাধারণ মানুষ দেশ চালাবেন; তখন প্রশ্নটা রাজনীতির। এই রাজনীতিই তো জন্ম দিয়েছে বিজেপি বিরোধী জোটের। কোনও মিডিয়া এই কথা একবারের জন্যও বলতে পেরেছে, না দেশের মানুষের নজর এদিকে ঘুরিয়েছে? যেন বিজেপির পক্ষে এই গণমাধ্যম সমর্থন আদায় করতে ময়দানে নেমেছে-এরকমই মনে হচ্ছে এই বিজেপি বিরোধী জোট নিয়ে মিডিয়ার প্রচার কৌশলে। সি পি আই (এম) দলের প্রধান নেতা কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি তাই যথার্থই বলেছেন যে কংগ্রেস দল পরিচালিত ইউ পি এ ১ সরকারকে যেদিন বামপন্থীরা সমর্থন জানিয়েছিলেন, সেই ভোটে বামপন্থীদের সাংসদের বেশির ভাগ সাংসদ কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভোটে পরাজিত করে সাংসদ হয়েছিলেন। জোটের আকৃতি স্পষ্ট হয় সবসময় নির্বাচনের পড়ে। মানুষের পছন্দের ভিত্তিতেই একমাত্র কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম সংগঠিত করার যাথার্থ্য থাকে, আগে নয়। তাই শাসক দলের অস্ত্র মিডিয়া হলেও, দেশবাসীর কাছেও বিকল্প রয়েছে–এই বার্তাই পাওয়া যায় বিজেপি বিরোধী জোট থেকে। এই জোটের রাজনৈতিক বার্তা একনায়কতন্ত্রবিরোধী, ফ্যাসিস্ট প্রবণতা বিরোধী অবস্থান তৈরি করা। এই জোটের বার্তা দেশের মানুষের জীবন যাপনে সুরাহা সৃষ্টি করা। এই জোটের বার্তা দেশের সংবিধান রক্ষা এবং গণতন্ত্র রক্ষা করা। এই জোটের বার্তা দেশে বিভিন্নতার মধ্যে ঐক্য ফিরিয়ে আনা এবং দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রাখা। সুচতুরভাবে ‘ইন্ডিয়া’ নামে এই জোট সম্পর্কে অনেক কথা বলা হলেও এই কথাগুলি উদ্দেশ্য প্রণোদিত।