একি গণতন্ত্রের দশা! হায় গণতন্ত্র !এই গণতন্ত্রকে আরও পাকাপোক্ত করার জন্য মমতা ব্যানার্জি ২০১১ সালের আগে স্লোগান দিয়েছিলেন” দলতন্ত্র নয় গণতন্ত্র”। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে এই স্লোগানকে তিনি উল্টে দিয়ে “গণতন্ত্র নয় দলতন্ত্র “কায়েম করলেন। তার অসংখ্য উদাহরণ রাজ্যে আছে। আসলে যারা স্বৈরতন্ত্রী তারা এইভাবেই নানান প্রতিশ্রুতি ,উপঢৌকন দিয়ে মানুষকে আকর্ষণ করে ক্ষমতা দখল করে। ক্ষমতায় বসে ধীরে ধীরে স্বৈরতন্ত্র প্রয়োগ করতে থাকে। মমতা ব্যানার্জিও মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেই তা  প্রয়োগ করতে শুরু করলেন। তার অসংখ্য উদাহরণ আমাদের রাজ্যে আছে।২০১৩ ও ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনে সরকারি দল কিভাবে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছিল তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ২০২৩ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে নানান অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে ,মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য, গণতন্ত্রের প্রস্থান রুখে দেবার জন্য মানুষ রাস্তায় নেমে, জীবন দিয়ে ,রক্ত ঝরিয়ে গণতন্ত্রের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। বামপন্থীরা লাগাতার শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন।

 যার ফলে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তারা রাস্তায় নেমে প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়েছে। হাড় হিম করা সন্ত্রাস, তৃণমূল কংগ্রেসের দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব, বোমা, পিস্তল, লাঠি ,বাঁশ ,দিয়ে বিরোধীদের  মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়া। এ সবই হয়েছে ১৫ ই জুন পর্যন্ত। তারপর শুরু হল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর্ব। সেখানেও দেখা গেল বাইক বাহিনীর দাপট। বাড়ি ভাঙচুর,বোমাবাজি,মারধর,জোর করে প্রত্যাহার করানো এ সবই ঘটে গেছে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায়। এমনকি কোথাও কোথাও থানার ওসিও বামপন্থী প্রার্থীদের প্রত্যাহার করানোর আসরে নেমে পড়েছিলেন।

এতই যদি উন্নয়ন, তাহলে তৃণমূল কংগ্রেস মানুষকে এত ভয় করে কেন।?? আসলে আপাদমস্তক দুর্নীতিতে দল ও সরকার নিমজ্জিত। সেই ভয়ে গাজোয়ারী। ভোটের উৎসবে চলেছে নরমেধ যজ্ঞ, আমাদের রাজ্য যেন এক বদ্ধভূমি। ১৪ দিনে ৯ জনের মৃত্যু। এতদসত্ত্বেও বাম ,গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি দাঁতে দাঁত চেপে,মাজা সোজা রেখে লড়াই চালিয়ে গেছেন। চোপড়ার ১৯ বছরের মনসুর আলম শহীদ হলেন গনতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে। অকালকুষ্মাণ্ড, কচুবনের কালাচাঁদ, ঘটিরাম ,ঢেঁকীর কুমির রাজীব সিনহা নির্বাচন কমিশনার হয়েই, কোন সাংবিধানিক রীতিনীতি না মেনেই নির্বাচন ঘোষণা করে দিলেন। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনার একেবারেই ল্যাজেগোবরে। হাইকোর্ট, ও সুপ্রিম কোর্টের থাপ্পড়, তিরস্কার খেয়েও কোন লজ্জা শরম নেই ঐ পা –চাটা ভৃত্যের।স্বৈরতন্ত্রের ব্যাটনটা মমতা ব্যানার্জি তুলে দিয়েছেন তাঁর অনুগত ভৃত্যের হাতেই। ন্যূনতম মনুষ্যত্ববোধ নাই ঐ ভদ্রলোকের। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানুষের উন্নত চেতনা, সাহসিকতা প্রত্যক্ষ করলাম এবং অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হলাম। হুগলী জেলার আরামবাগ মহকুমা সহ তারকেশ্বর,ধনেখালি, জাঙ্গিপাড়ার  কয়েকটি এলাকায় প্রচন্ড সন্ত্রাসের মধ্যেও প্রার্থীরা তাদের মাজা সোজা রেখে দৃঢ়তার সঙ্গে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন ও রক্ষা করেছেন।  হুগলীর খানাকুল ১ নং ব্লকের ঠাকুরানীচক জি পির মাইনান গ্রামের প্রতিবন্ধী প্রায় ৭০ বছর বয়সী রমজান আলী খাঁ সিপিআই(এমে)র পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। রাত্রি বারোটার সময় তার বাড়িতে ভয়ংকর আক্রমণ হয়। গরিব কৃষক প্রভূত  ক্ষতি হয়েছে তাঁর।তাসত্বেও তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের কাছে মাথা নত করেনি খোঁড়া রমজান আলী খাঁ। অনুরূপভাবে আরামবাগের তিরোল গ্রাম পঞ্চায়েতের পুইন গ্রামের সি পি আই (এম)এর মহিলা প্রার্থী নাসিমা বেগমের চুলের মুঠি ধরে মারা হয়েছে, বাড়ী ভাঙচুর করা হয়েছে,তার স্বামীর মোটরসাইকেল ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ভাইপোর হাত ভাঙা হয়েছে। তা সত্ত্বেও তাঁকে প্রত্যাহার করাতে পারেনি।গোঘাটের ২৯ বছর বয়সী সি পি আই (এম) প্রার্থী সুশীলা মুদি ১২ ই জুন ২০২৩, মনোনয়নপত্র পূরণ করে পার্টি অফিসে আমাকে যখন দেখাতে এলো, তখন তার চোখ দিয়ে টস টস করে জল পড়ছে। আমি জিজ্ঞাসা করায়, সে বলে ২০১১ সালের ২০ শে মে’র ঘটনা। তখন তার বয়স ১৭ ।আমাকে বলে ,আজ বাড়ি যাব না তবে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে যাবার মিছিলে হাঁটবো। বাড়িতে যাব না, কারন গেলেই তৃণমূল কংগ্রেসের দুষ্কৃতী বাহিনী আমার উপর অত্যাচার করবে। এই আশঙ্কা নিয়েই মা-বাবাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যায় তার দিদির বাড়ি।

 এদিকে গোঘাটের বিরামপুর গ্রামে মুদি পাড়ার উপরে আক্রমণ শুরু হয়। ১৪ ই জুন মুদি পাড়ার মানুষজন প্রতিরোধ গড়ে তুলে — তৃণমূল কংগ্রেসের বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। ২০ শে জুন নমিনেশন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে আবার সুশীলার বাড়িতে আক্রমণ।  মা-বাবাকে বলে ,”সুশীলা কোথায় আছে, না বললে বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেব।

”  সে কোথায় আছে জেনে নিয়ে  সেই দিকে বাহিনী বেরিয়ে যায় সুশীলা কে আনতে। এই দিকে পাড়ার লোক সুশীলাকে খবর দেয়,” তুই দিদির ঘর”থেকে সরে যা। সুশীলা এই কথা জানার পর তার দিদির ঘর থেকে সাইকেল নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। ফোন করে জানা যায়, গোঘাট থানার সীমান্ত এলাকার বাঁকুড়া জেলার কোতুলপুর থানার  লাউগ্রাম অঞ্চলের  কোন এক গ্রামের স্কুলে বসে আছে। সুশীলা বলে,” তিনেটের পর দিদির বাডী ফিরে যাবো।” আমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারিনি। বাঁকুড়া জেলার কোতুলপুর থানার সিপিআই(এম)নেতৃত্ব ও কর্মীদের সাহায্যে তাকে উদ্ধার করে গোঘাটে আনা হয়। তার সাহস, অদম্য জেদ, আর তেজ বামপন্থী আন্দোলনের কর্মীদের কাছে শিক্ষণীয়। সুশীলা মুদির মা ছায়া মুদি, বাবা- সত্য মুদি, দাদা খোকন মুদি,- কে ২০১১ ,২০শে মে  পুলিশ গ্রেফতার করে। টানা ৬২ দিন জেলে থাকার পর তারা বাড়ি ফেরে। কি হয়েছিল সেদিন! ২০১১ এর বিধানসভা নির্বাচনে ওই বুথে বামফ্রন্ট প্রার্থী বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন । সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল বিরামপুরের মুদিপাড়ায় ও সংখ্যালঘু মুসলিম পাড়ায়। আত্মরক্ষার তাগিদে মুদিপাড়ার মানুষজন প্রতিরোধ করে। উভয়পক্ষের মোট কুড়িজন গ্রেপ্তার হয়। তার মধ্যে সুশীলার মা ছায়া মুদি সহ ৫ জন মহিলা। ২০১১ সালের স্মৃতি তার মনকে যেমন ভারাক্রান্ত করে তেমনি তার জেদ বাড়িয়ে দেয়। ১২ বছরে অসংখ্যবার ওই মুদিপাড়ার উপর আক্রমণ হয়ছে। অনেক  প্রলোভন দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও মুদিপাড়ার মানুষজন তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে মাথা নত করেনি।এবারও চেষ্টা করেছিল বিরামপুর বুথে যাতে কেউ প্রার্থী হতে না পারে। কিন্তু সুশীলার অদম্য জেদ, সাহস আর লাল ঝান্ডার অতি আনুগত্য ও ভালবাসাই তৃণমূল কংগ্রেস বাহিনীকে হারিয়ে দিল। ওই জন্যই বলা হয়, “বল –বল নিজের বল”। মানুষ আর বামপন্থীদের সংগঠন মিলিতভাবে যুক্ত হলে  প্রশাসনও সেই শক্তিকে সমীহ করে। বিরামপুরের  ঘটনা আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। মুদিপাড়ার পঞ্চু মুদী জেলে থাকাকালীন অসুস্থ হয়। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে তিনি প্রয়াত হন । মমতা ব্যানার্জির “বিকশিত গণতন্ত্রে “পঞ্চু মুদির মৃতদেহ হুগলীর গোঘাটের বিরামপুর গ্রামে আনার অনুমতি পাওয়া যায়নি মমতা ব্যানার্জির ভাইদের কাছ থেকে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই হুগলির শেওড়াফুলি ঘাটে, পঞ্চু মুদির শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। এই নির্মম জ্বালা যন্ত্রণা নিয়ে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে মুদিপাড়ার মানুষজন লাল পতাকাকে রক্ষা করে আসছেন। তার জন্যই তো শত্রুর চোখে চোখ রেখে, শত্রুর প্রতি ঘৃণা নিয়ে সুশীলা মুদি সি পি আই (এম ) র প্রার্থী হয়েছে।সুশীলা বামপন্থীদের কাছে গর্বের প্রতীক। আর এক  গর্বের প্রতীক বনশ্রী বাগ। হুগলি জেলার কনিষ্ঠতম সিপিআই(এম)প্রার্থী। বর্তমানে কলেজে পাঠরতা বনশ্রী বাগ সন্ত্রাসের আঁতুড় ঘর ফুলুই গ্রামে সিপিআই(এম)-র হয়ে মনোনয়নপত্র দাখিল করার হিম্মত ধরেছে।

যখন বদনগঞ্জ ফুলুই ১ নং গ্রাম পঞ্চায়েতের সীমান্ত এলাকায় পশ্চিম মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলার গ্রামগুলিতে প্রার্থী হতে কেউ সাহস করেনি, তখন এই বনশ্রী বাগ ও তার পরিবার মতাদর্শে বলিয়ান হয়ে ,লাল ঝাণ্ডাকে ঊর্ধে তুলে ধরার আকাঙ্ক্ষায়, অদম্য জেদ ও সাহস নিয়ে বনশ্রী প্রার্থী হয়েছে। প্রত্যাহারের জন্য প্রবল চাপের কাছেও বনশ্রী ও তার পরিবার আত্মসমর্পন করেনি। খেতমজুর পরিবারের মেয়ে ।বসবাস করার সেরকম বাড়িও নেই ।এরকম পরিবেশ পরিস্থিতিতে লেখাপড়ার সাথে রাজনীতিতেও যুক্ত হয়ে এস এফ আই- গোঘাট আঞ্চলিক কমিটির সদস্যা হয়েছেন।আমাদের জেলায় ও রাজ্যে অসংখ্য উদাহরণ এরকম আছে। হুগলি জেলার গোঘাট, খানাকুল, আরামবাগ এলাকায় মনোনয়নপত্র দাখিল পর্বে কাজ করার সুবাদে আমার এই অভিজ্ঞতা।এর থেকেই শিক্ষা নিয়ে মতাদর্শে শান দিতে দিতে আগামীদিনে মানুষকে নিয়ে লড়াইয়ে নামতেই হবে।

মানুষের শক্তি, মতাদর্শ , সংগঠন, আন্দোলন, সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এই দুর্বৃত্তদের হটিয়ে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতেই হবে। কবি শঙ্খ ঘোষের কথায় ,” আমি তো আমার শপথ রেখেছি, অক্ষরে অক্ষরে, যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন ,দিয়েছি নরক করে।”(সবিনয় নিবেদন-শঙ্খ ঘোষ)যে সরকার আমাদের জীবন নড়ক করে দিয়েছে সেই সরকারকে উৎখাত করতে হবেই এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।