২০২৩ সালের জুলাই মাসের গোড়ায় পঞ্চায়েত ভোট। ২০১৮ সালে শেষ পঞ্চায়েত ভোটের হিংসা জাতীয় আন্তর্জাতিক খবরের শিরোনাম কেড়েছিল। এবারেও হিংসা প্রায় সর্বাত্মক। প্রচারের প্রথম কদিনেই প্রাণ চলে গেছে ২১ বছর বয়সের মনসুরের। এই হিংসার পিছনে রয়েছে বোমা তৈরির বেআইনি কারখানার রমরমা, এবং বেকার, ঋণগ্রস্ত গ্রামের মানুষকে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির দুষ্কৃতী রাজের অন্তর্গত করে নেওয়ার প্রক্রিয়া। আর্থিক সঙ্কট তীব্র। গ্রামে বেকারি সর্বকালীন রেকর্ড। কাজ করলেও মজুরি কম; ক্ষুদ্র বেসরকারী ঋণদান সংস্থা থেকে কোনরকমে ঋণ নিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে মানুষের; রেগায় কাজ নেই; বাড়ির পুরুষেরা চলেছে দূর রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে কিছু অর্থ জোগাড় করতে। গ্রামীণ দারিদ্র্যকে পশ্চিমবাংলায় আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। গ্রামের সাধারণ দরিদ্র ঘরের কিশোরেরাও এই দুষ্কৃতীর দুনিয়ায় ঢুকে পরছে আর্থিকভাবে বাধ্য হয়ে।পঞ্চায়েত ভোটের আগের কয়েকটি মাস জুড়ে খবরের শিরোনামে কি খবর ছিল? কয়েকটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এগরার কারখানায় বোমা বিস্ফোরণে নিহত মালতী বাগের পরিবার কি বলেছিল? নিহত শ্রমজীবী মহিলার পরিবার জানিয়েছিল যে জবকার্ড থাকলেও দীর্ঘদিন রেগায় কাজ নেই বলে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন কাছে বাজি কারখানার নামে যে বেআইনি বোমা কারখানা ছিল তাতে কাজ করতে।এ কথাও গ্রামের মানুষ জানিয়েছিলেন যে বোমা কারখানায় কাজ এখন একটু বেশি কারণ ভোট আসছে।

এগরা, বজবজ, বনগাঁ- এই সব কারখানায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেই। জুন মাসের গোড়ায় তৃণমূল কংগ্রেসের নেতার বাড়িতে ঘটেছে বোমা বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণ ঘটেছে এইরকম বীরভূমের দুবরাজপুরে , মালদার চাঁচলে, এবং অন্যত্র। অনবরত সব ঘটনা ঘটেছে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্বালে। যেখানে শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, সেখানে খবর প্রকাশ্যে এসেছে। কিন্তু গ্রামবাংলায় বোমা-বারুদের কারখানায় শেষ কয়েক মাসে সামান্য হলেও বেআইনি কাজ মিলেছে কিছু গ্রামবাসীর। এটাই বর্তমান গ্রামবাংলার নির্মম অর্থনীতির রোজনামচা।পশ্চিমবঙ্গের পথে ঘাটে শুট আউট এর ঘটনা ঘটেছে অহরহ। উত্তর দিনাজপুর, হুগলী, হাওড়া, নানা সময়ে গত কয়েক মাসে শিরোনামে এসেছে গুলি চলার খবর। শুট আউট এর অর্থ হল প্রচুর অস্ত্রের যোগান। দিনে দিনে গ্রামবাংলায় আগমন হয়েছে দুষ্কৃতীর যারা গরুপাচার, কয়লাপাচার, বালিপাচারকে ভিত্তি করে গ্রামে সমান্তরাল অপরাধের অর্থনীতি চালিয়ে গেছে। বগটুই গ্রামের ভাদু শেখকে মনে পড়ে? তিনি ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস দলের পঞ্চায়েতের উপপ্রধান।তিনি খুন হওয়ার পর একাধিকবার তাঁর স্ত্রীকে ক্যামেরার সামনে বলতে শোনা গেছে যে কেন তিনি খুন হলেন বোঝা যাচ্ছে না কারণ তিনি টাকা তুলতেন ঠিকই; তবে তার ভাগ সবাইকেই দিতেন।তোলাবাজকে স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত করা এবং গ্রামীণ পরিবারগুলিকে সন্ত্রস্ত করে তোলা – এটাই রীতিতে পরিণত হয়ে গেছে। এর থেকে এটা কি স্পষ্ট নয় যে দুর্নীতিকে সহজভাবে গ্রামের মানুষের মধ্যে মানিয়ে নেওয়ার এক প্রচেষ্টা চলেছে দুর্নীতিবাজদের তরফ থেকে? কখনো এই দুর্নীতিবাজেরা তৃণমূল, কখনো বিজেপি। একই মানুষ দল বদল করে এদিক, ওদিক গেছেন। অপরাধের মাত্রা বেড়েই গেছে বাংলার গ্রামে। তৃণমূল কংগ্রেস দলের গোষ্ঠী কোন্দল এবং তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে গণ্ডগোলকে কেন্দ্র করেও হিংসা উঠেছে চরমে গ্রামবাংলায়। বগটুই গ্রামের স্মৃতি এখনো মুছে যায় নি। অপরাধ যেহেতু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শনাক্তকরণ করা সম্ভব হয় না তাই ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর হিসেবে অপরাধের সংখ্যা দেখলে পরিস্থিতি বোঝা যায় না। কিন্তু রাজনৈতিক সঙ্ঘর্ষের ঘটনা দেখলে এবং সেই সঙ্ঘর্ষে অস্ত্রের ব্যবহার দেখলে, বোমা বারুদের ব্যবহার দেখলে অপরাধের মাত্রা এ রাজ্যের গ্রামে বোঝা যায়।গ্রামের মানুষ ২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে কিভাবে বেঁচে আছে তার খতিয়ান সবথেকে বেশি ভালোভাবে মিলেছে করমণ্ডল এক্সপ্রেসে হতাহতের তালিকায়। ট্রেনটির অসংরক্ষিত কামরায় ভিড় করে যারা গিয়েছিলেন তাঁরা তো পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম থেকে পরিযায়ী শ্রমিকের দল। এ রাজ্যের গ্রামে কাজ নেই। মজুরি নেই। তাই কোনরকমে খোঁজ পেয়েছে কি পায়নি, দূরের রাজ্যে পারি দিয়েছে গ্রামের কিশোর থেকে পুরুষ। বিশেষ করে দক্ষিণ ২৪ পরগণা, উত্তর ২৪ পরগণা, উত্তর দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ থেকে দলে দলে কিশোর এবং পুরুষেরা চলেছে অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরালা, গুজরাট, কর্ণাটক এই সব বিভিন্ন প্রদেশে। গ্রামে ছাত্রদের মধ্যে স্কুলছুট বেড়েছে।সঙ্কট বেড়েছিল গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের পড়ে। কোভিড অতিমারির আগে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী কিশোরদের মধ্যে স্কুলছুটের পরিমাণ ছিল ১৪.১% এবং কিশোরীদের মধ্যে তা কিছুটা কম ১৩.৬%। মাধ্যমিক পরীক্ষায় যে ৪ লাখ ছাত্রছাত্রী কম পরীক্ষা দিল, তার মধ্যে কিশোর পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কিশোরীদের থেকে কম।

সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে জানা যায় যে রাজ্যগুলি থেকে কিশোর ছাত্রদের স্কুলছুট বেশি তার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। পড়ানোর মত পরিবারের আর্থিক অবস্থা নেই।গ্রামে বেড়েছে কৃষক আত্মহত্যা। রাজ্য সরকার অস্বীকার করলেও এই আত্মহত্যা ঘটে চলেছে।রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়েছে যে এখানে কৃষক আত্মহত্যা শূন্য। কিন্তু তথ্যের অধিকার আইনের এক প্রশ্নের উত্তরে জানা যায় যে ২০২১ সালে মাত্র একটি জেলায় পশ্চিম মেদিনীপুরে ১২২ জন কৃষক আত্মহত্যা করেন। সারা ভারত কিষাণ সভার তথ্য জানায় কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা ২৫০ ছাড়িয়েছে । আলুচাষির আত্মহত্যা খবর আসে। কোভিডের পরে পরিযায়ী শ্রমিকেরা ঘরে ফিরে এলে জমির উপর চাপ বেড়ে যায়। অনেক বেশি মানুষ কৃষিজমির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ২০২০ সালেই রাজ্যের মোট আয়ের ২১.৮% আসত কৃষি থেকে; কিন্তু কৃষির উপর নির্ভর করে ৩৭.১% শ্রমজীবী মানুষ। এই পরিস্থিতি কোভিডের পড়ে বদল হয়েছে; কৃষি থেকে আয় বাড়েনি কিন্তু কৃষির উপর আরও বেশি মানুষ নির্ভর করে। গ্রামীণ মজুরি কমেছে ক্রমাগত। আয় নেই; কাজ নেই।গ্রামে বেকারের মধ্যে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়স্ক ৯০%। যে যুবশক্তি রাজ্যের সম্পদ ছিল, তাকে আজ অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে ফ্যাসিস্ট ধর্মী কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবং তাদের সহযোগী তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। এই বেকারদের মধ্যে বেশির ভাগ ঐতিহাসিক ভাবে সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা তফসিলি জাতি, আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ।এদের পরিবারগুলি থেকেই স্কুলছুট বাড়ছে। গ্রামীণ দারিদ্র্য বেড়ে গেছে দ্রুত।২০২২ সালেই মাত্র চারটি জেলায় দরিদ্র মানুষজন জনসংখ্যার ৮০%।জব কার্ড থাকা সত্ত্বেও কাজ পায়নি এবং কেন্দ্রের টাকা আসেনি- তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতি এবং বিজেপি সরকারের অসত্য ভাষণের ফলে রেগার কাজ থেকে বঞ্চিত আজ গ্রামবাংলার শত শত মানুষ। কাজের প্রতিশ্রুতি ছিল; কাজ মেলে নি।পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ার ৭টি গ্রামের এক স্বাধীন প্রকাশিত সমীক্ষার ফল অনুযায়ী কোন কোন পরিবারের সব কিশোর যুবকেরাই অন্যত্র কাজের খোঁজে গিয়ে রোজগার করছে।অন্যদিকে গ্রামীণ পরিবারগুলি সংসার চালাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে বেসরকারী ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থাগুলির কাছে। এরা মহিলাদের উদ্যোগী বানানোর জন্য ঋণ দান করে চড়া সুদের হারে। সেই ঋণ শোধ করতে আবারও তাদের ঋণ নিতে হয় অথবা পরিবারের পুরুষেরা বেড়িয়ে পড়ে অন্য রাজ্যে। ক্ষুধা বাড়ছে। অনাহার বাড়ছে। সব তথ্য জানা যায় না। রাজ্য সরকার কোন তথ্য দিতে নারাজ। ২০২২ সালে দুটি অনাহারে মৃত্যুর খবর শিরোনামে আসে। একটি হল পশ্চিম মেদিনীপুরের ভুলাভেদা গ্রামে, অন্যটি হল জলপাইগুড়ি জেলার ক্রান্তিতে।প্রথম জন কাজ হারানো তফসিলি জাতি সার্টিফিকেট না থাকা তফসিলি জাতিভুক্ত । দ্বিতীয় জন চা-বাগানের শ্রমিক।শিশুরা অঙ্গনয়াড়ি প্রকল্প প্রায় গুটিয়ে নেওয়ার ফলে অভুক্ত। মহিলাদের বেশির ভাগ ভুগছে রক্তাল্পতায়।এই পরিপ্রেক্ষিতে পরিবারগুলির আর্থিক দুরবস্থাকে বাজি রেখে শাসক গোষ্ঠীর যুবকদের দুষ্কৃতায়নের কাজে লাগাচ্ছে। অর্থের বিনিময়ে অস্ত্র হাতে তুলে দিয়ে, বোমা হাতে তুলে দিয়ে লুম্পেন বাহিনী তৈরি করে চলেছে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি দল। বিজেপি এই নীতি অন্যান্য রাজ্যে নিয়েছে।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতেও এভাবেই তারা লুম্পেন তৈরি করেছে। ফ্যাসিস্ট সহযোগী শক্তি এই একই ভাবে অশিক্ষিত, স্কুলছুট, দরিদ্র পরিবারের থেকে কিশোর, যুবকদের মধ্য থেকেই দুষ্কৃতী তৈরি করছে। এই লুম্পেন বাহিনী ভোটের স্বার্থে ব্যবহার করে এই দলগুলি। যে বিপুল দুর্নীতির পাহাড় গ্রাম বাংলা জুড়ে গড়ে উঠেছে, আবাস যোজনার দুর্নীতি, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, শত শত প্রকল্প চালু হলেও গ্রাম বাংলার মানুষের হাল ফিরবে না কারণ দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন এই বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।প্রকল্প থাকলে কি গ্রামবাংলার জীবন যাপনে সুরাহা হবে? গ্রামে দুষ্কৃতীর দৌরাত্ম্য কমবে?গ্রামবাংলার হাজার হাজার দরিদ্র পরিবারের রুটি রুজিকে বাজি রেখে পঞ্চায়েত ভোটে সামিল হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি। যেভাবেই হোক পঞ্চায়েত দখল না করলে প্রকল্পের টাকা, গ্রামীণ সম্পদ লুঠ করা যাবে না। এই লুঠের পঞ্চায়েত গঠন করতে শাসকের চাই লুম্পেন বাহিনী। গ্রামবাংলার শোব হারানো পরিবার থেকে , যাঁদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে এমন পরিবার থেকে বাছাই করে নিয়ে আসছে অর্থের বিনিময়ে তৈরি সশস্ত্র লুম্পেন বাহিনী।আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচন তাই গ্রামের মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। যার হাতে বোমা বারুদ তুলে দিয়েছে শাসক, লড়াইটা তারও। সেও কি বোমা বারুদ গুলির জীবন চায় না সুরক্ষিত জীবন জীবিকা চায়? তাকে তো এই সুস্থ জীবন বাছার অধিকার দেওয়া হয় নি। সুস্থ জীবনের অধিকার দিতে পারে একমাত্র মানুষের অংশগ্রহণে চালিত মানুষের পঞ্চায়েত। শাসক তৃনমূল কংগ্রেস বা বিজেপি কখনওই গ্রামের মানুষের জীবন জীবিকার অধিকারকে স্বীকার করে না। যেসব রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আছে, সেখানেও এই বোমা বারুদ নিয়েই তারা পঞ্চায়েত নির্বাচন করে। তাই ২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে পঞ্চায়েত নির্বাচন মানুষের আত্মসন্মান নিয়ে বাঁচার লড়াই; দুষ্কৃতীর বিরুদ্ধে লড়াই; সুস্থ সমাজের পক্ষে লড়াই।