যেখানে রাত নামে সাতটায়, আটটায় গভীর হয়ে যায়, সেখানেই সভা চলছে রাত সাড়ে দশটা নাগাদও। প্রত্যন্ত এই গ্রামে কম্যুনিস্ট পার্টির দু’টি শাখার যৌথ সভা। এক কমরেডের বাড়ির ছাদে। ঘাঘরা অঞ্চলের জররো গ্রাম; জঙ্গলে ঘেরা। এত রাতেও এই সভায় উপস্থিত দু’টি শাখারই সমস্ত সদস্য। এই উদ্যম কোত্থেকে আসে?

    পরদিন রাতে ঠিক পাশের গ্রামেই আরেকটি বাড়ির ছাদে বসেছে বুথের কর্মী সভা। উপস্থিতি প্রায় সত্তর; বেশি তো কম নয়। সেখানেই উত্তরটা পাওয়া গেল একজনের থেকে। বললেন, “ছোলাচের ধামসাটা বাইজলেই শরীলে রক্তটা যেমন টগবাগাঁই উঠে, লাল ঝাণ্ডাটা দেখ্যে বুকের আগুনটা তেমনেই হঁদকাই উঠছে গাঁয়ের লকের।“

    সেদিনই সকালে কাহানের বাঁধডি গ্রামে দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি প্রচারে বেরিয়েছিলেন পার্টির কর্মী-সমর্থক-দরদিরা। রাস্তায় ভিড়ে গেছেন সাধারণ মানুষও একাধিক। জীর্ণ এক কুটিরের দাওয়ায় একা বসেছিলেন সত্তরোর্ধ মহিলা। বাকিরা সকলে গেছে ক্ষেতে, বাদাম লাগানো হচ্ছে। এই বুথে বাম প্রার্থী শান্তিবালা বয়সে তাঁর নাতনির সমান। নকল ব্যালট পেপার দিদার দিকে এগিয়ে দিয়ে সে সিপিআই(এম)-এর নির্বাচনী প্রতীক চেনানোর চেষ্টা করছে। সহসাই শান্ত অশিতীপর মহিলা চিৎকার করে উঠলেন খানিক খেকিয়েই, “তুই হামাকে চিনহাবি রে ছা? ই ছাপট একবার দেইখলে ভুইলবার লই।“ পেছনে দাঁড়ানো বছর উনিশের ছেলেটার কাঁধে ধরা ঝান্ডাটার দিকে তর্জনি নির্দেশ ক’রে বললেন ফের, “ই রঙট ভুইলবার লই।“

    ভোলবার নয়। কিছুতেই ভোলবার নয়। অথচ ভোলানোর চেষ্টা তো কম হয়নি। ঝাড়খন্ডের হিংস্র হামলা থেকে সিআইএ-আনন্দমার্গী, ’৯৫-এর অস্ত্রবর্ষণ, ক্রমান্বয়ে তৃণমূলের ব্যবস্থাপনায় মাওবাদী তাণ্ডব, তারও পরে টিএমসি ঘুরে বিজেপির ঝাণ্ডার তলে জড়ো হওয়া। “আগে রাম পরে বাম” স্লোগান তুলে গ্রাম স্তরের বাম সমর্থক দরদিদের বিভ্রান্ত করার বিপুল আয়োজন মিডিয়া, স্যোশাল মিডিয়া, গঞ্জের আড্ডায়। আরএসএস-আইপ্যাক যৌথ অপারেশন। ই রঙটকে মুছে ফেলতে, তবু, কেউ পারেনি কিছুতে। পারবেও না বাপের জন্মে।

    পশ্চিমবঙ্গ ঝাড়খন্ডের সীমান্তবর্তী জয়পুর ব্লক। জেলা পুরুলিয়া। কাহান, বড়গ্রাম, মুকুন্দপুর, জয়পুর থেকে ঘাঘরা, রোপো, সিধি পর্যন্ত উঁচুনিচু জমি, সেগুন সোনাঝুরি পলাশ মহুলের বন আর টিলা, অনতিদূরেই ছোট মাঝারি পাহাড়, উপত্যকা। বহু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে রক্তপতাকাকে মাটিতে লুটাতে না দেওয়া বহু যুদ্ধের সেনারা লড়ছেন। এবারের রাজনৈতিক সংগ্রামে, তারই সাথে, যুক্ত হয়েছেন বহু নতুন, তরুন যোদ্ধাও। কারোর এইবারই প্রথম ভোট, কারোর বা দ্বিতীয়।

     বিকাশ প্রথমবার পঞ্চায়েত ভোট দেবে, বালিকা দ্বিতীয়বার। শুধু ভোট দেবে না, দু’জনেই প্রার্থী নিজ নিজ গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে। সিপিআই(এম)-এর।

মাধ্যমিক পাশ করেই লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল বিকাশকে, মজিদুরি করতে চলে যেতে হয়েছিল নাগপুরে। ফিরে আসার পর থেকে গত দু’বছর বাড়িতেই বসা। কোনো কাজ নেই। কাজ ছাড়া সংসারও চলতে চায় না। আপাতত কাঠ-বেকার। ছেলেটি একা নয়, প্রতিটি ঘরেরই ছবি এক। তিপান্নটা ঘর এই গ্রামে যার পঁচিশটিতেই এই মুহূর্তে নেই কোনো জোয়ান ছেলে। কেউ গেছে হায়দ্রাবাদ, কেউ ব্যাঙ্গালোর, কেউ চেন্নাই। কেউ হোটেলে রেস্টুরেন্টে ওয়েটার, কেউ নির্মান শিল্পে শ্রমিক। শুধু এই গ্রাম কেন? এ তল্লাটের প্রতিটা গ্রামেরই এই এক বাস্তবতা। অর্ধেক জোয়ান ছেলে ভিন রাজ্যে কাজ করতে গিয়েছে, বাকি অর্ধেক বেকার। ফ্যা ফ্যা ক’রে ঘুরে বেড়াচ্ছে আদাড়ে বাদাড়ে। আর মেয়েদের অধিকাংশেরই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে বাড়ির লোক আঠারো হওয়ার আগেই। বাধ্য হয়েই।

     রুখা-সুখা এই জেলায় চাষবাস কম, যেটুকু রয়েছে তাও আর লাভজনক তো নয়ই। ছোট-মাঝারি শিল্প লাটে উঠেছে তৃণমূল আমলে। বামফ্রন্ট সরকার রঘুনাথপুরে বড় কারখানা করতে চেয়েছিল, সেটাও করতে দেওয়া হয়নি। ১০০ দিনের কাজ? তার হাল কহতব্য নয়। জব কার্ড সব জমা থাকে পঞ্চায়েত নেতাদের কাছে। যেখানে তৃণমূলের প্রধান সেখানে তৃণমূল নেতার কাছে, যেখানে বিজেপি প্রধান সেখানে বিজেপি নেতার কাছে। পঞ্চায়েত নেতাদের দুর্নীতির শাস্তি স্বরূপ রেগা প্রকল্পে বরাদ্দই বন্ধ করেছে কেন্দ্রের সরকার এখন আবার। অথচ বিকাশদের মতো ছেলেদের হাতগুলো কাজ চায় নিজেদের মাটিতেই। মুখ বুজে এ জীবন কাঁহাতক মেনে নেওয়া যায়? এইবার যুদ্ধে নেমেছে তাই কুড়ি-বাইশ-তেইশের যৌবন। রাজনৈতিক যুদ্ধে।

    রাজনৈতিক সংগ্রামে বেকারের কাজ, রুটিরুজির প্রশ্নকে ঢেকেচেপে দিতে পুরনো কৌশল নতুন ক’রে প্রয়োগ করছে শাসক। বিভাজনের কৌশল। কুড়মির সাথে আদিবাসীকে লড়িয়ে কিস্তি মাত করার ধান্দা। অথচ এই ব্লকেরই আরেক প্রান্তে বিকাশ মাহাতোর মতোই লড়ছে বালিকা হাঁসদা। কাঁধে কাঁধ; কাস্তে-হাতুড়ি-তারার প্রতীকে।

জঙ্গলের মধ্যেই পিরি গ্রাম। নিচ দিকে আদিবাসী মানুষের বসতি। বালিকা হাঁসদার বাবা নেই; প্রয়াত। মা-মেয়ের ছোট্ট সংসার। হাড়িয়া বিক্রি ক’রে কেবলই ক্ষুণ্ণিবৃত্তি নয়, মেয়েকে গ্র্যাজুয়েশন করিয়েছেন মা। বালিকা ইতিহাসে স্নাতক। মাস্টার্স পড়ার সাধ আছে। সাধ্য? চাকরি দরকার, দরকার রোজগার। মায়েরও তো বয়স বাড়ছে!

নিজের জীবনের এই লড়াই বালিকার একার লড়াই তো নয়। এ পাড়ার, এ জেলার, এ রাজ্যের অগণিত যুবক-যুবতীর লড়াইও তো এই একই। নিজের সাথে সবার দাবি তুলে ধ’রে সেও তাই রাজনৈতিক যুদ্ধে নেমেছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে গরিব মানুষকে দূরে রাখার উদ্দেশ্যে ওরা যতই লড়িয়ে দিতে চাক কুড়মিক-আদিবাসীকে, বিকাশ মাহাতো আর বালিকা হাঁসদার পা মিলে যায় একই মিছিলে। লাল পতাকার। নিজ নিজ জীবন যন্ত্রনার অভিন্নতায়, সংগ্রামের একাত্মতায়।

বিভাজনের পাটিগাণিতিক হিসেবপত্র ঘেঁটে যাচ্ছে গরিব ঘরের এই ছেলেমেয়েদের জোটবদ্ধতায়। পার্টিকে সাফ ক’রে দেওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত অতীতের সমস্ত ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়ে মালভূমির মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে পার্টির ভবিষ্যত।

এবারের নির্বাচন আর স্রেফ পঞ্চায়েত সদস্য, প্রধান, উপপ্রাধান, সমিতি সদস্য, সভাপতি, সভাধিপতি ঠিক করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। এবারের নির্বাচন হয়ে উঠেছে ভবিষ্যতের অভিমুখ নির্ধারণ করার সংগ্রাম।

বামফ্রন্ট সরকার শ্রমজীবী মানুষের অনুকূলে গ্রামীন রাজনীতির ভারসাম্যে যে পরিবর্তন এনেছিল ত্রিস্তর পঞ্চায়েত গঠনের মাধ্যমে, গত বারো বছরে তৃণমূল তা নিয়ে গেছে উল্টোদিকে। গ্রামের গরিব মানুষের যেটুকু যা সম্পদ, মান ইজ্জত সব লুট ক’রে ওরা ভারসাম্য নিয়ে গেছে ফড়েদের অনুকূলে। গ্রামের নব্যধনীদের অনুকূলে। তাদেরই সিন্দুকে জমা করেছে টাকার পাহাড়। গরু, বালি, কয়লা পাচারের টাকা। জমা করেছে গ্রামের মানুষের জবকার্ড, আবাস যোজনার কাটমানি, এমনকি বিওধবাভাতা, বার্ধক্য পেনশনের টাকাও। তাদেরই মুঠোয় নিয়ে গেছে গ্রামীন রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ।

এবারের নির্বাচন আর স্রেফ পঞ্চায়েত সদস্য, প্রধান, উপপ্রাধান, সমিতি সদস্য, সভাপতি, সভাধিপতি ঠিক করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। এবারের নির্বাচন হয়ে উঠেছে গাঁ-ঘরের রাজনীতিতে গরিব মানুষের নিয়ন্ত্রণ পুন;প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। ফের শ্রমজীবী মানুষের অনুকূলে গ্রামের অর্থনীতি-রাজনীতির ভারসাম্য পরিবর্তনের লড়াই।

জয়পুর থেকে পুন্দাগ যাওয়ার পথে দু’ধারে অরণ্য, দীগন্ত বরাবার পরপর পাহাড়ের দেখা মেলে। ছাড়া-ছাড়া গ্রামগুলো। ঘেঁষে ঘেঁষে মানুষ রয়েছে। প্রান্তিক, শোষিত, পীড়িত। এই মানুষের একতাই এ লড়াইতে জয়ের গ্যারান্টি।

লাল পতাকাই বিজয় নিশান।