বছরের গোড়ায় মনে হচ্ছিল মে’মাসের মধ্যে তৃণমূল সরকার পঞ্চায়েত নির্বাচন সেরে ফেলবে। তা  এখনো হয়নি; পঞ্চায়েতের প্রার্থী বাছাই করতে অভিষেকের তাঁবু-সফরও নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। তার থেকে অনুমান করা যায় যে তৃণমূলের পক্ষে সময়টা খুব ভালো যাচ্ছে না। বামপন্থী গণসংগঠনগুলির বর্ধিত শক্তি তাদের মনে কিছুটা ভয় ধরাচ্ছে নিশ্চয়ই, কিন্তু তার থেকেও তাদের বেশি হোঁচট খাওয়াচ্ছে গ্রামাঞ্চলে নিজেদের যে বহুবিস্তৃত নেটওয়ার্ক তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে সাহায্য করে তার দ্বন্দ্বে ফালাফালা হওয়া অবস্থা। যুবরাজকে দিয়ে তার কোনোই কিনারা হচ্ছে না।

আজকের এই পরিস্থিতিতে ইতিহাসের পৃষ্ঠা উলটে দেখা প্রয়োজন। ২০০৮ সালে বামফ্রন্টের আমলের শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়। সেসময়ে বামফ্রন্ট-বিরোধী প্রকাশ্য ও গোপন শক্তিগুলি ভালোভাবে এককাট্টা হবার সুযোগ পেয়েছে; নন্দিগ্রামের ঘটনা দেশে এবং বিদেশে আলোড়ন তুলে ফেলেছে, সিঙ্গুরের ‘আন্দোলন’ থেকে মমতা ব্যানার্জি প্রচুর রাজনৈতিক ফায়দা লুটছেন। বামফ্রন্ট অবশ্য সেকারণে পঞ্চায়েত নির্বাচন পেছনোর কোনো চেষ্টা করেনি এবং নির্বাচনের ফলাফলে গ্রামবাংলায় বামফ্রন্টের প্রভাব হ্রাস হবারও ভালোই প্রমাণ পাওয়া গেছে অনেকগুলি গ্রামপঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি এবং গোটাচারেক জেলাপরিষদ তাদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায়।

বামসমর্থকদের মধ্যে একাংশ কিন্তু তখনও ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয়ের আরশিতে নিজেদের মুখ দেখে চলেছেন এবং বলছেন পঞ্চায়েতটা রাজ্যের ক্ষমতা হাতে রাখার নিরিখে চূড়ান্ত মাপকাঠি নয়। মানুষ লোকসভা-বিধানসভায় অন্য হিসাব থেকে ভোট দেবে। তাঁদের এই বিশ্বাস অবশ্যই ইতিহাসে সত্য প্রমাণিত হয়নি। বরঞ্চ এই সত্যটাই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে ২০০৮এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের অগ্রগতিই ছিল ২০১১তে যা হবে তার অশনিসংকেত। পঞ্চায়েতে তৃণমূলের অগ্রগতিকেই আশ্রয় করে এবং বামফ্রন্টের রক্ষণাত্মক মনোভাবের সুযোগ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ভারসাম্যের সমূহ বদলের পালা শুরু হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তৃণমূল নেতৃত্বের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে পঞ্চায়েতে ক্ষমতা ধরে রাখাটা যে কতোটা জরুরি তা তারা ভুলে যায়নি। এব্যাপারে তারা মরীয়া। 

রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তৃণমূল সরকার পঞ্চায়েতগুলো নিয়ে তাদের যা করার কথা ছিল তাই করেছে। তাদের জমানার প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব্যাপক সন্ত্রাস, ভোটলুট ও এলাকা দখলের রণকৌশল নেবার অনেক আগে থেকেই নানা উপায়ে গ্রামাঞ্চলে একচ্ছত্র ক্ষমতা কায়েম করার লাগাতার প্রচেষ্টা তারা শুরু করেছিল। এপ্রচেষ্টার একটা দিক ছিল বিরোধী পঞ্চায়েতগুলিকে ভয় বা লোভ দেখিয়ে নিজেদের দখলে নিয়ে আসা। বামফ্রন্টের ঝাণ্ডা নিয়ে যারা জিতেছিল তাদের হাতে কোনোভাবে তৃণমূলের ঝাণ্ডা ধরিয়ে দেওয়া। অনেকে সত্যিই রাজ্যসরকার ও প্রশাসনের অসহযোগিতায় কাজ করতে না পেরে অন্যদিকে যেতে বাধ্য হয়েছিল, যদিও মনে মনে হয়তো বামফ্রন্টের দিকেই তাদের সমর্থন ছিল। আরেকটা পদ্ধতি ছিল বামফ্রন্টের সমর্থকদের জায়গাজমি থেকে উৎখাত করা, এমনকী যাঁরা ইতিপূর্বে জমির পাট্টা পেয়ে গিয়েছিলেন তাঁদেরও। আর তিন নম্বর পদ্ধতি ছিল যেসব কাজ নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যদের করার কথা ছিল সেগুলি তাঁদের হাত থেকে সরিয়ে প্রশাসনিক আধিকারিকদের হাতে তুলে দেওয়া।

তৃণমূল সরকারের প্রথম বছরেই পাট্টাপ্রাপ্ত ৯৪০০ কৃষক এবং ২৭০০০ নথিভুক্ত বর্গাদার উচ্ছেদ হয়ে যান সেইসব জোতদারদের স্বার্থে যারা বামফ্রন্টের আমলে বেআইনি জমির দখলচ্যূত হয়েছিল। তৃণমূলের নিজস্ব নেটওয়ার্ক তৈরির এটা ছিল প্রথম ধাপ। দক্ষিণ ২৪ পরগণা, দুই মেদিনীপুর, কোচবিহার প্রভৃতি বিভিন্ন জেলায় এইসব উচ্ছেদের তথ্য দিয়ে বিধানসভায় তৎকালীন বিরোধী নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র মুখ্যমন্ত্রীকে একাধিক পত্র দেন, কিন্তু সরকার ছিল নিরুত্তর। জেলায় জেলায় প্রশাসনিক মিটিংগুলিতে শুধু যে জেলাপরিষদে নির্বাচিত বিরোধীপক্ষের সদস্যদের বাদ দেওয়া শুরু হল তাই নয়, বিভিন্ন কমিটিগুলিকে ভরানো হল আমলাদের দিয়ে। সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে এই আমলাদের দিয়ে নির্বাচিত সদস্যদের মাথার ওপর তদারকি কমিটি বসানো হল। অলিখিত ফতোয়ার দ্বারা জেলাপ্রশাসনগুলিকে বাধ্য করা হল সেই জেলায় কোনো নির্দিষ্ট তৃণমূল নেতাকে পঞ্চায়েতের কাজে খবরদারির অধিকার দিতে। রাজনৈতিক নেতাদের অবাঞ্ছিত উপস্থিতি পঞ্চায়েতের স্বশাসনের ক্ষমতার মূলে আঘাত করল। অর্থাৎ বিরোধীপক্ষকে খতম করতে গিয়ে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রাণ—তার গণতান্ত্রিকতারই অন্তর্জলি করা হল। আজ আমরা পঞ্চায়েতের মাধ্যমে যে লুটপাট ও দলবাজি দেখে শিউরে উঠছি তার গোড়াপত্তন হয়েছিল ২০১১তেই।

সবজায়গায় একাজ খুব সহজে করা গিয়েছিল এমন মনে করার কারণ নেই। কিন্তু গ্রামবাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে এতবড়ো পরিবর্তনের বিরুদ্ধে খুব বড়ো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না তার অর্থটা হৃদয়ঙ্গম করা আমাদের পক্ষে জরুরি। দুঃখের বিষয়, আমাদের মধ্যেই এখনো এর এমন ব্যাখ্যা কখনো কখনো শোনা যায় যে সাধারণ মানুষ পেয়ে পেয়ে এত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে আরো পাবার লোভই তাদের বামফ্রন্টের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। কখনো কখনো ‘পঞ্চায়েত এক দুমুখো তলোয়ার’ এই বিখ্যাত উপলব্ধিকে ব্যবহার করা হয় ‘অত্যধিক গণতন্ত্রের বিপদ’ বোঝাতে। আজ যদি পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা ‘মানুষের পঞ্চায়েতে’র আওয়াজ তুলি তাহলে পঞ্চায়েতি গণতন্ত্রের এইধরনের অপব্যাখ্যা থেকে শতহস্ত দূরে থাকা প্রয়োজন।

পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে ‘দুমুখো তলোয়ার’ বলার প্রকৃত অর্থ গ্রামাঞ্চলে রাজনৈতিক শক্তির প্রকৃত আকর এই ব্যবস্থা, বিশেষত ১৯৯৪-১৯৯৫এর পর থেকে সংশোধিত পঞ্চায়েত আইনে এই শক্তি অনেক বেড়ে যায়। জনসাধারণের হাতে বিকেন্দ্রীকৃত স্বশাসনের ক্ষমতা যেমন এর মধ্য দিয়ে তুলে দেওয়া সম্ভব তেমনই যাঁরা এই প্রক্রিয়ার পরিচালনা করবেন তাঁরা যদি নিজেরাই সেক্ষমতা দখল করে রাখতে চান, তাহলে আমলাতান্ত্রিকতা বৃদ্ধি পাবে শুধু তাই নয়, ক্ষমতার অপব্যবহারও অবশ্যম্ভাবী। বিশেষত বিগত নব্বইয়ের দশক থেকে বাম-পরিচালিত পঞ্চায়েতের কোথাও কোথাও এই বিচ্যুতি দেখা দিয়েছিল; তৃণমূলের আমলে যার বাড়বাড়ন্ত ঘটবে তার বীজ বপন এইসময়েই।  

বাম আমলের প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে সি পি আই(এম) পেয়েছিল ৬১.০৩ শতাংশ আসন, বামফ্রন্ট মোট ৭০.২৮ শতাংশ। জেলা পরিষদে সিপি আই(এম) পেয়েছিল ৭৬.৭৫ শতাংশ আসন, বামফ্রন্ট ৮৯.৪৯%। অনেকেরই পঞ্চায়েতের কাজ সম্বন্ধে কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। কিন্তু পার্টির গণতান্ত্রিক সদিচ্ছা এবং শোষিত মানুষের ক্ষমতায়নের প্রতি দায়বদ্ধতা  অনেকগুলি শরিক এবং বিরোধীপক্ষের নির্বাচিত সদস্যদের ওপরেও তার মতাদর্শগত সুপ্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল বলেই পঞ্চায়েতের কাজে বিপুল সাফল্য পাওয়া গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এই মতাদর্শগত নেতৃত্ব যে অনেকাংশে খর্ব হয় তার প্রমাণ আমরা পাই ২০০৮এর নির্বাচনে। আজ যদি কেউ মনে করেন, শুধু নির্বাচনটা হবার ওয়াস্তা, একবার আসনদখলে বামফ্রন্ট এগিয়ে যেতে পারলেই সর্বত্র ‘মানুষের পঞ্চায়েত’ স্বতঃই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে তাহলে তিনি অলীক স্বপ্ন দেখছেন।

এটা ঠিক কথা যে পাঁচ বছর আগেকার পরিস্থিতি আজ আর নেই। তৃণমূলের অত্যাচার যেখানে পৌঁছেছে সেখানে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ তাকে অনেক জায়গায়—বিশেষত যেখানে পার্টি ও গণসংগঠনগুলির সক্রিয়তা বেড়েছে—লাল ঝান্ডার দিকে যেতে উৎসাহিত করছে। কিন্তু তৃণমূলের সুরক্ষা ও সুবিধাভোগের নেটওয়ার্ক থেকে তারা সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে পেরেছে কিনা সেটা একটা বড়ো ব্যাপার। ভোটের সময়ে তৃণমূল যে সে নেটওয়ার্ক বহাল রাখতে সন্ত্রাস ও ধোঁকাবাজির সব অস্ত্রই নামিয়ে আনবে এতেও কোনো সন্দেহ নেই। সেইসঙ্গে নির্বাচনে বিজেপি-র ভোট যদিও কমতে দেখা যাচ্ছে অনেকগুলি জেলাতেই বিজেপি-র প্রাণভোমরা আর এস এস খুব ভালোভাবে নিজেদের সংগঠনকে জোরদার করে তুলেছে। কিছু পঞ্চায়েত এলাকায় তাদের নির্ণায়ক ভূমিকা থাকবেই। প্রয়োজনে মারদাঙ্গা বাধিয়েও বাম-উত্থানের বিরুদ্ধে নিজেদের যুদ্ধ তারা জারি রাখবে।

এইসব সত্ত্বেও এখন পঞ্চায়েত নির্বাচন হলে বামপন্থীরা যে আগের চাইতে অনেক ভালো ফল করবে, অনেক এলাকায় গ্রামপঞ্চায়েত ও অন্যান্য স্তরেও সাফল্য পাবে এ আশা নিশ্চয় দুরাশা নয়। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে জনসাধারণের ক্ষমতায়নের মূল পরিসরগুলি হল কৃষকের সহায়তা, স্কুলশিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থা, গ্রামীণ কর্মসংস্থান। এর জন্য যাবতীয় অর্থবরাদ্দ শাসকদল এতবছর ধরে চুষে শেষ করেছে। কেন্দ্রের জনবিরোধী নীতির ফলে গ্রামভিত্তিক বহু প্রকল্প ধুঁকছে, নয়তো সেগুলি গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ‘মানুষের পঞ্চায়েত’ গড়তে হলে জাতিধর্মনির্বিশেষে এলাকার জনসাধারণকে তাদের এইসব হকের ধনের পুনরুদ্ধারের জন্য ঐক্যবদ্ধ জঙ্গি লড়াইয়ের অভিমুখে সচল করে তুলতে হবে। যাঁরা পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমাদের পক্ষ থেকে লড়বেন তাঁরা এই লড়াইয়ে নতুন হতে পারেন, কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শগত এই সংকল্পে তাঁদের দৃঢ় ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন। রাজনৈতিক ভারসাম্যকে নাড়িয়ে দেবার এই লড়াইয়ে প্রত্যয় ও আপসহীন মনোভাব নিয়ে এগোলেই ‘মানুষের পঞ্চায়েত’ গড়তে মানুষের শক্তির নতুন উদবোধন ঘটানো যাবে।