মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় দিন গুনছে সিঙ্গুর। গত ১২ বছরের বেশী সময় ধরে প্রতারণার জবাব দিতে দিন গুনছে গ্রামের মানুষ। ৮ তারিখ ব্যালট বাক্সে প্রতারণার জবাব দেবে সিঙ্গুরের জমি। 

সিঙ্গুর ব্লকের বেড়াবেড়ি গ্রাম, নামটা এখনও রাজ্যের মানুষের স্মৃতিতে ফিকে হয়ে যায় নি। ২০০৮ সালের পর থেকে এই গ্রামে লাল পতাকা ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল ওরা। ২০১১ সালে সরকার বদলের পর লাল ঝাণ্ডার অসংখ্য কর্মী ঘরছাড়া থেকেছেন মাসের পর মাস। মিথ্যে মামলা চাপিয়ে চাকরি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে কারখানা ধ্বংসের কুচক্রীরা। বেড়াবেড়ি গোপালনগর রতনপুরের মানুষ কেমন আছেন সেই নিয়ে এক মুহূর্ত ভ্রুক্ষেপ দেখায় নি সরকার। জমি ফেরৎ তো পেয়েছেন কিন্তু চাষবাস হচ্ছে জমিতে? কিছুটা কৌতুহল থেকেই বেড়াবেড়ি বাজারে এক চায়ের দোকানে কথাটা পারলাম। রে রে করে উঠলেন চা-এর দোকানে যারা বসে ছিলেন সবাই মিলেই। বললেন ঘা শুকোয় নি এখনও, প্রতিটা দিন যন্ত্রণায় কাটছে। জমির যা হাল তাতে কোনও চাষই করা যাবে না আর। অথচ কারখানা টাও হল না, কারখানাটা হলে সিঙ্গুরের মানুষের এই হাল হত না। গোটা সিঙ্গুরই এখন পরিত্রাণ চাইছে এই লুঠেরা দের হাত থেকে।

গোপালনগরে এক সভায় গিয়ে কয়েক জনের সাথে কথা বলার, সুযোগ হল আবার, একই প্রশ্ন করলাম। উত্তর এলো, 'ওরা তো সিঙ্গুরের মানুষকে টুপি পড়িয়ে গোটা রাজ্যটাকে চুরিতে ভরিয়ে দিল, এবসর আর ওদের কথায় ভুলব না'। বুঝলাম তাওয়া, গরম হচ্ছে রোজ, জেগে উঠছে সিঙ্গুর। সত্যিই তো তাই সিঙ্গুরের মানুষকে শোষণ করে লুঠ করে এখন তো নিজেরা দুর্নীতি  পাহাড়ে বসে জেলে যাওয়ার দিন গুনছেন রোজ আর তিল তিল করে শেষ হচ্ছে সিঙ্গুরের মানুষের স্বপ্ন গুলো। এই দায় তো তৃণমূলের হোমরাচোমরা নেতা কিংবা জার্সি বদল করে নেওয়া বিজেপি কেই দিতে হবে। আর সেই জবাব চাইতেই সিঙ্গুর বেড়াবেড়ি গোপালনগরের মানুষ চোয়াল শক্ত করে লড়ে যাচ্ছেন রোজ। ১০০ দিনের কাজ নেই ১ বছর ধরে, আবাস যেজনা প্রকল্পের টাকা পান নি গরীব মানুষ অথচ তৃণমূল নেতাদের বাড়ির বাহার বাড়তে থেকেছে রোজ, চার চাকা গাড়ি হাঁকিয়ে সম্পত্তি বেড়েছে বহুগুণ।

বাজার আগুন জিনিসের দামের তাপে অথচ কৃষক ফসলের লাভজনক দাম পাচ্ছেন

 না। তাপসী মালিক স্মৃতি কৃষক বাজার বানিয়েছিল তৃণমূল সরকার, সেই কৃষক বাজার এখন এক মানুষ সমান জঙ্গলে পরিত্যক্ত প্রায়। সিঙ্গুর ব্লকের সবকটা গ্রাম পঞ্চায়েতই গত ২০১৮ সালে গায়ের জোড়ে দখল করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। পঞ্চায়েত প্রধানদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অভিযোগ লজ্জা দেবে যে কোনও রাজ্যস্তরের তৃণমূল নেতাকেও। বেড়াবেড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের বিদায়ী তৃণমূল প্রধানকে কয়েক মাস আগেই গ্রামের মহিলারা ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। 

সেই প্রধান এবার টিকিট না পেয়ে আম চিহ্নে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এরকম বহু কেন্দ্রে তৃণমূলের একাধিক গোঁজ। গোটা তৃণমূল টাই দুর্নীতির আখড়া। আর কিছু জার্সি বদল করে বিজেপি-র জার্সি পড়ে লাল ঝাণ্ডাকে আটকাতে মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ধর্মের, সুড়সুড়ি দিয়ে কিংবা তারাও নাকি কারখানা চায় এই মিথ্যে গল্প শুনিয়ে। যদিও হার না মানা জেদে শপথ নিয়েছে সিঙ্গুর। প্রতারণা বঞ্চনার জবাব দিতে লাল পতাকায় সেজেছে গ্রামের মেঠো পথ। প্রচারে টেক্কা দিচ্ছে তৃণমূল কে। লাল ঝাণ্ডা দেওয়াল লেখা পোস্টারে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে এক সময় তৃণমূলের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হওয়া বেড়াবেড়ি বাজার।

তৃণমূল বিজেপির প্রার্থীদের পয়সার দেমাক আছে উল্টেদিকে লাল ঝাণ্ডার প্রার্থীরা গ্রামের মানুষের নিত্যদিনের সুখ দুঃখের সাথী। গ্রামের মানুষ নিজেরাই একসাথে বসে সভা করে লাল ঝাণ্ডার প্রার্থী বেছেছেন।

লাল পতাকায় সাজিয়ে তুলেছেন বুথ। লড়াই করছে সিঙ্গুর ঘুরে দাঁড়াতে। প্রতিদিন মিছিলে লোক বাড়ছে, গরীব মানুষ কাঁধে তুলে নিচ্ছেন নিজেদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় লাল ঝাণ্ডা। জমিতে কারখানা চাই, কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম চাই, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের হকের পাওনা আদায় চাই দেওয়াল জুড়ে লেখা ঘুরে দাঁড়ানোর শপথ। 

আর পিছু হটা নয়, বঞ্চনার জবাব দিতে জানকবুল লড়াইয়ের মেজাজে সিঙুরবাসী। প্রচারের কাজ শেষে আজ ভোরের ট্রেনে কলকাতা ফিরছি, মধুসূদনপুর স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি ট্রেনের অপেক্ষায়। হঠাৎ একজন জীর্ণ জামা আর লুঙ্গি পড়া মানুষ এগিয়ে এসে বললেন, 'দাদা চলে যাচ্ছেন?' আমি কিছুটা অবাক হয়েই তাকাতে আবার বললেন 'কাল সভার সময় আমি ছিলাম'। বুঝলাম এই অঞ্চলেরই মানুষ। আমি জিজ্ঞেস করলাম লড়াই হবে তো? বললেন অবশ্যই হবে। শেষে যাবার সময় বলে গেলেন, 'এবার আর ওদের ছেড়ে দেব না, জিতব আমরা'। কথাগুলো বলে এগিয়ে গেলেন ভিড়ের মধ্যে ভারী মাল তুলতে ডাক পড়ায়। বুঝলাম গরীব মানুষ ফিরছে তাদের নিজের ঝাণ্ডার তলায়। লাল ঝাণ্ডাটা আরও উজ্জ্বল হচ্ছে রোজ এঁদের ছোঁয়ায়। একবুক তাজা অক্সিজেন নিয়ে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন ছেড়ে দিল, সত্যিই গ্রামের পথ বামদিকেই এগিয়ে চলল। এই নির্বাচন শুধু ভোটের অঙ্ক নির্ধারণ করার ভোট নয় এই নির্বাচন শ্রেণীর কাছে আরও মিশে যাওয়ার জেদ, এই নির্বাচন অনেক সম্ভাবনার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে রোজ। শ্রেণীকে ফিরিয়ে আনছে তার পতাকার কাছে, শুধু পড়ে পড়ে মার খাওয়া নয় জঙ্গী মনোভাবেই এককাট্টা হচ্ছে মেহনতীর পাল্টা প্রতিরোধ। টাকার লোভ দেখিয়ে আর কিনে নেওয়া যাবে না গরীব মানুষের রক্ত ঘামের ইজ্জত। ১ দিন উপঢৌকন দিয়ে বাকি ৩৬৪ দিন তৃণমূলকে আর চুরির লাইসেন্স দেবে না শ্রমজীবী মানুষ। সেই শপথেই রক্ত ঘামের বিনিময়ে জনগণের পঞ্চায়েত গড়ে তুলতে আওয়াজ উঠছে 'নয় সমর্পণ, লড়াই করেই জিতবে জীবন'। সিঙুর সত্যিই লড়াইয়ের ময়দানে মাও সে তুঙ এর ঐ লাইনটা মনে করিয়ে দিচ্ছে 'Everything Under Heaven is in Utter Chaos, The Situation is Excellent '...