
২০২৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন যত এগোচ্ছে ততই মনোনয়নপর্ব চলাকালীন শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের সন্ত্রাস এবং বিরোধী প্রার্থীদের ওপর আক্রমণের মাত্রা ততই বাড়ছে। এবং প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার তৃতীয় দিনে উত্তর চব্বিশ পরগণার মিনাখাঁতে এরিয়া কমিটির অফিসে তৃণমূল কংগ্রেসের আক্রমণে গুরুতর আহত হয়েছেন সিপিআই(এম) নেত্রী সোমা চক্রবর্তী দাস সহ রানা দাস ও নাজিবুল লস্করের মতো অন্যান্য পার্টি নেতা কর্মীরা। অন্যদিকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ভাঙড়ে বিডিও অফিসে চারঘন্টা আটক রেখে আই এস এফের মহিলাপ্রার্থীকে পুলিশ বাইরে ওত পেতে থাকা মারমুখী তৃণমূল কংগ্রেসের দুষ্কৃতীদের হাত থেকে বাঁচিয়ে পিছনের দরজার তালা ভেঙে বার করে নিয়ে গেছে। কোনভাবেই মনোনয়ন জমা না দিতে দেওয়ার উদ্দেশ্যে মিনাখাঁয় সিপিআই(এম) কার্যালয় ছয় ঘন্টা তৃণমূল কংগ্রেসের যে দুষ্কৃতীরা ঘিরে রেখেছিল তাদের অনেকের মিনাখাঁয় ঢুকলেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার কথা। কিন্তু পুলিশ গ্রেফতার করার ধারেকাছে যায় নি বরং সেই কুখ্যাত সমাজবিরোধীদের সঙ্গে বিড়ি সিগারেট ভাগ করে খেয়েছে। শুধু তাই নয়, সিপিআই(এম) প্রার্থীদের নিরাপত্তা দিয়ে মনোনয়ন কেন্দ্র অবধি নিয়েও যায় নি। উত্তর দিনাজপুরে চোপড়ায় সিপিআই(এম) নেতা বিদ্যুৎ তরফদার, আনসারুল হক সহ আরো দু জন কর্মী এবং প্রদেশ কংগ্রেসের নেতা অশোক রায়কে অপহরণ করা হয়েছিল হাতিঘিসার মোড়ে। কয়েকঘন্টা পরে তাঁরা ছাড়া পান। একইরকম আক্রমণের ঘটনা ঘটলেও তার মোকাবিলা করেই মুর্শিদাবাদের রানীনগর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কাকদ্বীপে পাল্টা প্রতিরোধ করে সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস মনোনয়নপত্র দাখিল করে।
১০ ই জুন হিংসাত্মক ঘটনা ও অশান্তির পরিবেশের মোকাবিলা করার জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশন মনোনয়ন কেন্দ্রের একশো মিটার সীমার মধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করেছিলেন। নির্দেশিকা জারি করা হয়েছিল যে প্রার্থীর সঙ্গে মনোনয়নপত্র জমা করার জন্য একজন যেতে পারবেন এবং কোনোভাবেই মনোনয়ন জমা করার সময় বাইক মিছিল করা যাবে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা যাচ্ছে, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার তৃতীয় দিনে শাসকদলের কর্মীরা বাইকে দাপিয়ে বেড়িয়েছে বিভিন্ন বিডিও এবং এস ডি ও অফিসের সামনে। তৃণমূলের কর্মীরা লাঠি সোটা হাতে জমায়েত করলে পুলিশ বলেছে,” মুখ ঢেকে বসুন।”
এই লেখা যখন আপনারা পড়ছেন,তখন একদিকে যেমন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ডাকে সর্বদল বৈঠক চলছে,তেমনি হাইকোর্টে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে কেন্দ্রীয়বাহিনী দিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন করানোর আবেদন করে কংগ্রেস ও বিজেপির করা মামলার রায় বেরোনোর উদগ্রীব অপেক্ষাতেও থাকতে হচ্ছে। কোন আইন নেই, কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনের নির্ঘন্ট প্রকাশের আগে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সমস্ত স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক মতবিনিময় করে থাকেন ২০১৮ সাল পর্যন্তও পশ্চিমবঙ্গে তেমনটাই ঘটেছে। এবার কোন কারণে এতো তাড়াহুড়ো করে এমনকি শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের দু নম্বর নেতার রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালীন পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করে দিয়েছেন,তার পিছনে আপাত দৃষ্টিতে প্রশাসনিক কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ না থাকলেও অনেক অভিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নবজোয়ার যাত্রার যেটুকু ইতিবাচক ফল,তাকে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারে কাজে লাগানোর লক্ষ্যেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকার এই ভরা বর্ষায় পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণা করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোগ্য বিকল্প হিসাবে সামনে রেখে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারকে তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ার বিপণনের প্রচেষ্টাও অন্যতম কারণ হতে পারে। কিন্তু তাঁর “শান্তিপূর্ণ পঞ্চায়েত ভোট” এর প্রতিশ্রুতি যে নিতান্তই কথার কথা সেটা তৃতীয় দিন পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে। এর কারণও বিশ্লেষণ করেছেন রাজনৈতিক মহল। তৃণমূল কংগ্রেস বুঝতে পারছে বিভিন্ন জনমোহিনী প্রকল্প ঘোষণা সত্ত্বেও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে তাদের জনবিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। অবাধ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে জনসমর্থনের নিরিখে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব। ফলে পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণার পর থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। তিনি নিজে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কোন মৌখিক প্রতিশ্রুতিও দেন নি। অবশ্য সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার দায় তাঁর দলের কর্মীরা এমনকি পুলিশ প্রশাসনও নিতেন না – এ কথা বলাই যায়।
কিন্তু মাননীয়া ও তাঁর ভাইপো, জনগণকে ঠেকাবেন কেমন করে? গায়ের জোরে বিরোধীদের মনোনয়ন পত্র জমা দিতে বাধা দেওয়ার তৃণমূলী কৌশল এবছর এখনো পর্যন্ত অনেক সময়ই ব্যর্থ হয়েছে। ভোটের দিন এবং গণনায় গা জোয়ারি হলে কলকাতার সরোজিনী নাইডু সরণীর নির্বাচন কমিশনের দপ্তরে জনরোষ আছড়ে পড়লে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।