গত ১০।০৭।২৩ তারিখে “আবার সেই প্রহসনের গণতন্ত্র” কলমে আমি লিখেছিলাম,” গণনাতেও কারচুপি, চুরির পরিকল্পনা চলছে। এটাও রুখতে হবে। এত চুরি, বুথ দখল ,ছাপ্পা সত্ত্বেও বামপন্থীদের শক্তি আগামী দিনে বাড়তে চলেছে এটা নিশ্চিত “। গণনা কেন্দ্র দখল করে ফলাফল শাসকদলের পক্ষে আনা হয়েছে,এটাও যেমন সত্যি । আবার এত চুরি ,বুথ দখল ,ছাপ্পা, গণনা কেন্দ্রে গুন্ডামি করা সত্বেও বামপন্থীদের শক্তি বেড়েছে এটাও তেমনই সত্যি ।ভোট গণনাতে কিছুটা প্রতিরোধ হলেও হরির লুঠকে শেষ পর্যন্ত ঠেকানো গেল না।বেশীরভাগ নির্বাচনী আধিকারিক, পুলিশ আর তৃণমূল কংগ্রেসের যৌথ বাহিনী বিরোধী এজেন্ট ও প্রার্থীদের , অস্রাব্য ভাষায় গালাগাল দিয়ে, চোখে ,মুখে আবির গুঁজে দিয়ে, গায়ে মদ ঢেলে – মারতে মারতে গণনা কেন্দ্র থেকে বের করে দিল।তখন একদিকে চলছে মমতা ব্যানার্জির জয়ধ্বনি আর একদিকে চলছে মদের বোতল নিয়ে নাচ ও উল্লাস ।এ এক চরম অসভ্যতা ও বর্বরতার স্বাক্ষ্যরেখে গেল ২০২৩ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনের এক কলংকিত অধ্যায়। রাজ্যে সরকার আছে বলে মনেই হল না।মনে হল– এটাই ,” অভিষেকের নবজোয়ার কর্মসূচি। চোরেরা যখন চুরি করে চলে যায় তার কিছু না কিছু “ক্লু”রেখে যায়।

নির্বাচনী আধিকারিককূলের এবং পুলিশ প্রশাসনের বড় মাঝারি কর্তাদের বৃহৎ অংশ এবং তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ও আইপ্যাকের মাথারা “ভোট গণনা কেন্দ্রে চুরির” ক্লু রেখে গেলেন।এত লুঠ,এত চুরি চেপে রাখা যায়!!যার জন্যই, বামপন্থী সহ অন্যান্য বিরোধী দলের প্রতীকে ছাপ দেওয়া ব্যালট পেপার রাস্তায়, পুকুরে,সাগরে, এঁদো গলিতে শ’য়ে শ’য়ে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। দৈনিক এ ঘটনা ঘটেই চলেছে।আর এইসব “ক্লু”ধরে হাইকোর্টে একটার পর একটা মামলা হচ্ছে। গণনা কেন্দ্রে যেভাবে ডাকাতি হয়েছে তারপরেও বামপন্থী, কংগ্রেস,আই এস এফ মিলিতভাবে তাদের শক্তি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।২০২১ এ বামপন্থীদের যে ক্ষয় হয়েছিল তা মেরামত করে বামপন্থীরা কিছুটা হলেও শক্তি অর্জন করেছে। এখন পর্যন্ত ফলাফলের খবর যা জানা গেছে তা হল — ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং আইএসএফ– মিলিতভাবে ১০% ভোট পেয়েছিল। ২০২৩ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে ঐ মিলিত জোট ২১ শতাংশ ভোট পেয়ে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। প্রায় ১১ শতাংশ ভোট বৃদ্ধি–এই বৃদ্ধি টাই গণতন্ত্রের পক্ষে ইতিবাচক। গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরে ,যেভাবে বুথ দখল, ছাপ্পা, সর্বোপরি গণনা কেন্দ্র দখল করে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীদের জয়ী করে দেওয়া হয়েছে ,আবার বিরোধী প্রার্থীরা জিতেছে সেটাকেও নস্যাৎ করে দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের হেরো প্রার্থীকে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে ।এরকম ঘটনা ভূভারতে কোথাও হয়নি।এ সবই হয়েছে সাধারণ ও পুলিশ প্রশাসনের বৃহৎ অংশের গেমপ্ল্যানের সহায়তায়। পুনরায় পঞ্চায়েত দখল করার উদগ্র নেশায় তৃণমুল কংগ্রেস, সাধারণ ও পুলিশ প্রশাসনের বৃহৎ অংশ গণনা কেন্দ্রে ব্যাপক তান্ডব চালালো কেন? পঞ্চায়েতে এখন কোটি কোটি টাকা আসে গ্রাম উন্নয়নের জন্য। পঞ্চায়েত এখন একটি গ্রামীণ সরকার। এটাও একটা ছোটখাটো রাষ্ট্র বলা যেতেই পারে। উন্নয়নের এই টাকার ছিটেফোঁটা কাজ করিয়ে বাকিটা ঐ তিনটি স্তরে ভাগ হয়ে যায়। এখানেও পুঁজির খেলা চলে।এই নির্বাচনে তৃণমুল কংগ্রেস চুরি বাটপারি করে যাতে পঞ্চায়েতের বোর্ড করতে পারে তার জন্য ঠিকাদার, গ্রামের নব্য ধনীরা ,বড় বড় ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করেছে।মদ , মাংসের ফিস্টি হয়েছে প্রায় প্রতিদিন।ভোটারদের টাকা ও নানা উপঢৌকন দিয়েছে। পঞ্চায়েত ,পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের কর্মকর্তা সহ পঞ্চায়েতের আধিকারিকদের সঙ্গে, তারপর পুলিশ তো আছেই — এদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বড় বড় ব্যবসা ও প্রকল্পের কাজ যাতে বাগিয়ে/হাতিয়ে নেওয়া যায় তাহলে সব পক্ষের রোজগার, আগামী পাঁচ বছরে অনেক বাড়াতে পারবে। অর্থাৎ পুঁজি বাড়বে। পুঁজি বাড়লেই ব্যবসা বাড়বে, ঠিকাদাররা আরও বেশি বেশি কাজ পাবে ।তার জন্যই এত খুনো –খুনি ,সন্ত্রাস করে ক্ষমতা দখলে রাখা। এই ক্ষমতাতে এখন ভাগ বসাতে চাইছে বিজেপি।এটাও খেয়ালে রাখতে হবে।এই পুঁজিকে কেন্দ্র করেই তৃণমূল কংগ্রেসের অভ্যন্তরে এত বিদ্রোহ, নির্দল ,একে অপরকে খুন করে দিচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক ।এত কাণ্ডকারখানার ভিতরে লুকিয়ে আছে স্বজনতোসী পুঁজি ।গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই পুঁজি এখন ধাবমান।এই পুঁজি অনৈতিকভাবে সকলকেই গিলে খেতে চায় ।আবার খুব বেপরোয়া।এই স্বজনতোসী পুঁজির পাহারাদার হিসেবে কাজ করে রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্লজ্জতা। সত্যের কণ্ঠরোধ করার জন্য চলে বর্বরতা। ২০২৩ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনের গণনা কেন্দ্রে চলল হাড় হিম করা বর্বরতা। জেতার তীব্র বাসনায় শাসক দলের প্রার্থী ব্যালট পেপার খেয়ে নিতেও দ্বিধা করল না।এইভাবেই গণতন্ত্রকেও গিলে খাচ্ছেন তৃণমূল কংগ্রেস।আর সেই গণতন্ত্রকে টেনে বার করেছে রাজ্যের মানুষ ও মহামান্য হাইকোর্ট। আর এই বিধ্বস্ত গণতন্ত্রের উপর দাঁড়িয়ে আমাদের রাজ্যের গণতান্ত্রিক মানুষ- কঠিন লড়াই করে সংসদীয় রাজনীতিতে ভোটের শতকরা হার বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, বিধ্বস্ত গণতন্ত্রের উপর দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রকে রক্ষা করা ও গণতন্ত্রের কাঠামোকে শক্তিশালী করার লড়াই আরও শক্তিশালী হচ্ছে। মানুষ যদি স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারে, রাজনৈতিক দলগুলো গণনা কেন্দ্রে যদি নিরাপত্তা না পায় তাহলে কিসের গণতন্ত্র !! কিসের জন্য সরকার!!গণতন্ত্রের বলি হয়ে গেল তরতাজা ৫৮ টি প্রাণ।এত রক্ত, বুকফাটা আর্তনাদ, তা সত্ত্বেও মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলছেন “পার্টি শৃঙ্খলাবদ্ধ আছে বলে কোথাও কোন ঘটনা ঘটেনি। সব জায়গায় অশান্তি হয়নি।…….. ভাঙড়ে তো আরাবুল জিতেছিল।……… কই ও তো কিছু বলেনি ।একটা — দু’টো আসন নয়, মানুষের জীবন গুরুত্বপূর্ণ।” হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বলেছেন,”রাজ্য যদি নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে না পারে, সেটা খুবই উদ্বেগের।”রাজ্যে এত সন্ত্রাস, এত মৃত্যু মুখ্যমন্ত্রী এসব গ্রাহ্যই করেন না। আসলে ওনারই অনুপ্রেরণায় এ সবই ঘটে চলেছে। কতদিন এই উন্মত্ত হিংসার তান্ডব চলবে! মমতা ব্যানার্জি বলেছেন,”আমরা শৃঙ্খলাবদ্ধ পার্টি”। উনি ঠিকই বলেছেন, শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবেই বুথ দখল, গণনা কেন্দ্র দখল,গণনাতে কারচুপি, অফিসার ও পুলিশকে নিয়ে ভোট চুরির নিখুঁত পরিকল্পনা করা হয়েছে। এরপরও বলা যাবে গণতন্ত্রের ভোটের উৎসব!! গণতন্ত্রের নিধনযজ্ঞের খেলায় মেতেছে দুটি দলই তৃণমূল ও বিজেপি। এই যে এত সন্ত্রাস এই সন্ত্রাসের উৎস কি? মাননীয় বিচারপতি সঠিকভাবেই বলেছেন যে ,”পঞ্চায়েত একটি রোজগারের জায়গা, যার ফলেই এত হানাহানি হচ্ছে।”বিচারপতি মহাশয় সঠিক কথাই বলেছেন। আসলে স্বজনতোসী পুঁজিবাদের চোরাস্রোত কাজ করছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাপনায়।যার মধ্যে আছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। তার জন্যই এত রক্ত। সিরাজদৌল্লা নাটকে শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত লিখেছিলেন,” বাংলার ভাগ্যাকাসে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা।” আজকের দুর্যোগ আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজর্ষি উপন্যাসে মন্দিরে শ্বেত পাথরের উপর রক্তের ধারা দেখে ফুলের মতন বালিকা হাসি রাজাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “এত রক্ত কেন?? “আজ শত শত হাসি মুখ্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করছে এত রক্ত কেন ? আপনি মুখ্যমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে কি দায়িত্ব পালন করেছেন!!এই মারন যজ্ঞ কবে থামিবে। এই হিংসা কবে বন্ধ হইবে? আপনি তো মুখ্যমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আইনের শাসন কায়েম করতে পারছেন না কেন ? গণতন্ত্রে দ্বিচারিতা কেন? আপনার বিধায়ক শওকত আলি ভাঙড়ে ঢুকতে পারবে আর বিরোধী দলের বিধায়ক ,আবার ঐ কেন্দ্রের বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী তাঁর এলাকায় ঢুকতে পারবেন না!! সারাদিন তাঁকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখল আপনার পুলিশ। নওশাদ সিদ্দিকী ও গণতন্ত্র সারাদিন ধরে বিধ্বস্ত হল। আপনি কি এর কোন উত্তর দিতে পারবেন, না পারবেন না।

২০০৮ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধী নেত্রী হিসেবে আপনি কি বলেছিলেন মনে আছে!আর এখন কি বলছেন ——।মুখ আর মুখোস।রাজ্যে হিংসা, সন্ত্রাস করে যে নরমেধ যজ্ঞ চলছে তার প্রধান কুচক্রী নির্বাচন কমিশন আর রাজ্য সরকার। আপনারা কোন দায়িত্ব -ই পালন করেননি। যেটুকু দায়িত্ব পালন করেছে তা মহামান্য আদালত। এমনকি আগামী দশদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিশেষ কমিটি করতে হয়েছে হাইকোর্টকে। মাতব্বর যুবরাজ অভিষেক আবার হাইকোর্টকেই হঁসিয়ারী দিয়ে শাসিয়েছে। কত বড় স্পর্ধা থাকলে হাইকোর্টের বিচারপতির নাম ধরে এইভাবে হুঁশিয়ারি দিতে পারে !!তাহলে সাধারণ মানুষের কি হবে?? মানুষও প্রতিরোধে সামিল হচ্ছে।রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের উপরেই বর্তায়। সেক্ষেত্রে হাইকোর্টকে কেন হস্তক্ষেপ করতে হলো!! জবাব তো মুখ্যমন্ত্রীকেই দিতে হবে। আজ হোক কিংবা কাল।নির্বাচন পর্বে হাইকোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও গোটা নির্বাচন পর্বে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বসিয়ে রাখা হলো ।একটা পুলিশ, সিভিক দিয়ে নির্বাচন পর্ব শেষ করলেন। ফলে যা হবার তাই হল। তবে নির্বাচন কমিশন একটা বিষয়ে কিন্তু ঠিক আছে। মাতাল হলে কি হবে,তালে ঠিক আছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর খরচ বাবদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার হিসাব দিয়ে টাকা চেয়ে কেন্দ্র কে চিঠি দিয়েছে।এদের লজ্জা সরম কিচ্ছু নেই। এখানে রক্তের হোলি খেলা চলছে আর উনি কেন্দ্রকে টাকা চাইছেন। আগামীদিনে পঞ্চায়েতকে শ্রেণীসংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে কিছুটা যদি ব্যবহার করতে হয় , তাহলে শ্রেণী আন্দোলন ও গণআন্দোলন আরও তীব্র করতে হবে। স্বজনতোসী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, নানান ইস্যুতে, পঞ্চায়েতে দুর্নীতি ও স্বজনপোষনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করেই দুই পেশীশক্তিকে হঠানো সম্ভব। রাজনীতি বিমুখ মানুষদের ভয় ভীতি কাটিয়ে তাদের বামপন্থীদের পক্ষে নিয়ে আসতেই হবে। তবেই এই দুর্বৃত্তের শক্তিকে প্রতিহত করা যাবে। এথেন্স একাডেমির বারান্দায় দাঁড়িয়ে বহু বছর আগে প্লেটো সোচ্চার কণ্ঠে বলে গেলেন,” রাজনীতিতে অংশগ্রহণে অনীহার অন্যতম শাস্তি হলো নিজের চেয়ে নিকৃষ্টদের দ্বারা শাসিত হওয়া”। প্লেটোর কথা কি মিথ্যা !! না মিথ্যা নয়, মিথ্যা নয় কথাগুলো। বিধ্বস্ত গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য, সত্যের পক্ষে, ন্যায়নীতির পক্ষে, সততার পক্ষে, উদারনীতির বিরুদ্ধে, স্বজনতোসী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে — সময় এসেছে রাস্তায় নামার। আগামী দিন শ্রেণী আন্দোলন ও গণ আন্দোলনেরই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

[তথ্য সংগৃহীত]১৭।০৭।২৩