ভাঙ্গড়ে রক্ত, চোপড়ায় রক্ত—ওটা কেবল নির্বাচনের শর্ত রক্ষা করতে-আসা কিছু তরুণের বুক থেকে আসেনি। ওটা সংবিধানের তাজা রক্ত। যখন সরকার নির্বাচন ঘোষণা করার বদলে সেবিষয়ে মৌনব্রত অবলম্বন করে বসেছিল তখন থেকেই বোঝা গিয়েছিল তারা কিছুটা বিপন্ন বোধ করছে। বোঝা গিয়েছিল, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত তাঁবুর অশ্লীল সমারোহ আর পুলিশপাহারার চাকচিক্য দেখিয়েও কোনো অভিষেকের সাধ্য হবে না তৃণমূলকে শত্রু মনে-করা মানুষের অদম্য প্রতিরোধের মেজাজকে এড়িয়ে যাবার। তৃণমূলের নিজেদের মধ্যে মারামারি আগেই শাসকদলের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। প্রশ্ন ছিল, অনিবার্যকে পিছিয়ে দেবার মরিয়া প্রচেষ্টায় তারা কতদূর যাবে?  

এবিষয়ে তাদের প্রথম নির্লজ্জ পদক্ষেপ এমন একজন নির্বাচন কমিশনারকে বেছে নেওয়া আমলা হিসাবে শাসকের কোলের মানুষ হয়ে থাকার ঘৃণ্য ইতিহাস যার আছে। কোনো কথা-বলা পুতুলকে নির্বাচন কমিশনার বানানোরই শামিল এই পদক্ষেপ। তৃণমূলের চরিত্রসম্মত এই বাছাই থেকে তারা এই ফল পেল যে নির্বাচনের দিন ঘোষণা শুধু তড়িৎগতিতে ঘটল না, মনোনয়ন দাখিল করার সময়কে এত সংকীর্ণ করা হল যাতে বিরোধী দলগুলির পক্ষে তা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কোথাও কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হলনা। সরকারের অঙ্গুলিহেলনে চলা পুলিশ তার কর্তব্য বুঝে নিল। ঘোষণা করলেন কমিশনার; কিন্তু আসলে এটা শাসকের পরিকল্পনারই দ্বিতীয় পদক্ষেপ।

তথাপি চোরাগোপ্তা পথে গিয়ে তৃণমূল যতসংখ্যক নমিনেশন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (এবং তারপরেও) জমা দিতে পারল, সি পি আই (এম), বামফ্রন্ট ও তার সহযোগী আই এস এফ এবং কংগ্রেসও অনেক লড়াই করে অনেক রক্তপাত করে সাহসের নজির রেখে তার চাইতে খুব একটা পিছনে রইল না। বোঝা গেল, তৃণমূলের ভয় পাবার সত্যি কারণ ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের কথা আরো আছে; এরাজ্যে কাগজে-কলমে যারা বিরোধীদল সেই বিজেপির কিন্তু একেবারে নিঃশব্দে মনোনয়ন দাখিল করে বিনা ঝামেলায় সংখ্যাগত দিক থেকে বামফ্রন্ট ও তার সহযোগীদের কাছাকাছি চলে আসতে কোনো অসুবিধাই হল না। এই কায়দাটিকে বলে ‘লাগে তাক না লাগে তুক’; এবং এতে পরোক্ষভাবে সাব্যস্ত হল যে এরাজ্যে এই পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াল বামফ্রন্ট, শুধু তাই নয়, তৃণমূলের দ্বিতীয় পদক্ষেপটি বিজেপি-র সঙ্গে গোপন সমঝোতারই নিশানা।  

সন্দেহ হয়, এই সমঝোতা আরো গভীরে গেছে। ভুললে চলবে না, গত দশবছরে অনেকগুলি জেলায়, যেখানে বিজেপি-র কোনো অস্তিত্বই নেই সেখানে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ নানা নামে তাদের শিকড়বাকড় ছড়িয়েছে, যেহেতু তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয় তাই বিজেপি-র সঙ্গে তৃণমূলের জায়গাদখল নিয়ে যে প্রতিযোগিতা তাদের সঙ্গে সেটা নেই। বরং হয়তো তৃণমূলের স্থানীয় কর্মীদের সহযোগিতাতেই তাদের বাড়বাড়ন্ত ঘটেছে। জেলার সেইসব অংশে বামফ্রন্ট হয়তো এখনো তার ছিন্নবিচ্ছিন্ন সংগঠন গুছিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু তাদের অস্তিত্বের জানানদারি আসছে মানুষের আশাআকাংখার মধ্য থেকেই। তৃণমূলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ যখন ‘মানুষের পঞ্চায়েতে’র বা ‘চোর তাড়িয়ে পঞ্চায়েতের দখল নেবার’ বামপন্থী স্লোগানের পাশে এসে জমাট বাঁধার প্রবণতা দেখাচ্ছে, তখন বিপদের ইঙ্গিত পেয়ে আর এস এস-এর দক্ষ ঠ্যাঙ্গাড়েবাহিনী স্থানীয় তৃণমূলী মাফিয়ার সঙ্গেই জোট বাঁধবে এবং তাদের উভয়ের স্বাভাবিক শত্রু বামপন্থীদের আক্রমণ করবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়?

যেখানে গণতন্ত্রের রক্তপাত ঘটছে সেখানে আর এস এস-এর ভূমিকা কী এখনো হয়তো আমরা খতিয়ে দেখিনি, কিন্তু এই নির্বাচনে এধরনের রাজনৈতিক মেরুকরণের সম্ভাবনা থাকতেই পারে। যেমন কিছু বিজেপি-র নামে তেমনই কিছু তৃণমূলের নামেও আর এস এস তাদের নিজস্ব লোক পঞ্চায়েতে নিশ্চয়ই ঢোকাবে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী যখন ভাঙ্গড়ে খুনজখমকে বর্ণনা করেন তাঁর ‘মুসলিম ভাইবোনদের’ ‘বিপথে পরিচালনা’ করার ঘটনা বলে তখন হঠাৎ এই সম্প্রদায়ভিত্তিক বর্ণনার পিছনে অন্যরকম এক রাজনৈতিক মোচড়ের ছায়াপাত ঘটে(সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, শুক্রবার, ১৬ই জুন) না কী? উনি যা বলেন সবসময়েই তার কিছু গূঢ় অর্থ থাকে যে!

মনোনয়ন দাখিলের পর্বে জান কবুল করে বামফ্রণ্ট ও তাদের সহযোগী দলগুলির যে কর্মীরা লড়াই করল তাদের সাহস দেখে শত্রুরাও অবাক হয়েছে। তাদের সঙ্কল্পকে সেলাম না জানিয়ে উপায় নেই। সাংগঠনিক শক্তির সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে গেছে এই সাহস। এটা ইতিহাসের নজির শুধু নয়, আগামী দিনের কাজের ভিত্তি হয়ে রইল। এবারে যে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে লক্ষ্য করেই শুধু এই লড়াই সংগঠিত হয়েছিল তা বোধহয় নয়। বিভিন্ন স্থানীয় ইস্যু নিয়ে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা, পার্টি ও গণসংগঠনগুলির নানা বিষয়ে তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ এসময়ে যে অনেক বেড়েছে তারই কিছু সদর্থক ফল পঞ্চায়েত নির্বাচনকে উপলক্ষ্য করে আমরা দেখতে পাচ্ছি এমনটা আশা করা সম্ভবত অসংগত হবে না। জনগণের শক্তিকে কীভাবে উদবোধিত করা যায় তার কিছু ইঙ্গিত আমরা এসব কাজের মধ্যে দিয়ে পেয়েছি।

প্রশ্ন হলঃ অতঃ কিম্‌? শত্রুপক্ষ যে অত্যন্ত শক্তিশালী এবিষয়ে সন্দেহ রাখার কোনো অবকাশ নেই। দ্বিতীয় পদক্ষেপের পরে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম পদক্ষেপের প্রস্তুতি তারা নিয়েই রেখেছে। তৃণমূলের সংকটে তাকে বুদ্ধি দেবার লোক যে তৃণমূলের বাইরেও থাকতে পারে সে আশংকা তো আগেই প্রকাশ করেছি। উচ্চ আদালত থেকে কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী নিয়োগ করার নির্দেশ, রাজ্যপালের রণহুংকার কোনোটাতেই শাসকের নির্ধারিত কার্যক্রম বিশেষ বাধা পাবে না। গোটাকয়েক লাশের বিনিময়ে গ্রামবাংলায় নিজেদের দাপট অব্যাহত রাখতে শাসকদল পিছ-পা হবে না তা তো আগেও দেখা গেছে। ৮ই জুলাই পর্যন্ত সময়টা সন্ত্রাসের কালই থাকবে মনে হয়। লাঠিবন্দুক বাইকবাহিনী ও ঠুঁটো জগন্নাথ পুলিশের সাহায্যে নির্বাচনের আগেই নির্বাচনে যতোটা জয়লাভ করা যায় তার চেষ্টা এসময়ে লাগাতার চলতে থাকবে। মামলা মকদ্দমায় ফাঁসানোও চলবে।

তবে এতকিছুর পরেও তারা খুব সহজে জয়লাভ করতে পারবে না। বামপন্থীদের প্রভাবকে তারা লাঠিগুলি দিয়েই মানুষের মন থেকে সরাবে ঠিক এই পরিস্থিতিটা এখন আর নেই। হয়তো কোথাও কোথাও সত্যিই মানুষের পঞ্চায়েত গঠিত হবে, লুটতরাজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের মেজাজটা থেকেই যাবে। কিন্তু মুশকিল হল, সারারাজ্যে যদি ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই প্রবণতার জোরেই সরকার চলতে থাকে, পঞ্চায়েতের বরাদ্দ যদি লুটেরাদের ভোগেই লাগানো হয়, তাহলে অল্পকিছু জায়গায় নির্বাচিত পঞ্চায়েত কাজ করতে চাইলেই বা কীভাবে তা হবে? যতক্ষণ না রাজ্য থেকে এই লুটের জমানাকে হটানো যায় ততদিন এখানে ওখানে পঞ্চায়েতে ক্ষমতায় থাকলেও সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগানো সম্ভব নয়।

এই পঞ্চায়েত নির্বাচনকে তাই রাজনৈতিক লড়াইয়ের একটি অংশ হিসাবে দেখা আক্ষরিক অর্থেই প্রয়োজন। আমরা এখানে এক পা এগোলাম এই অর্থে যে এবার পরিষ্কার হয়ে গেল মানুষের জীবনজীবিকা ও আত্মসম্ভ্রমের এই লড়াইতে কারা তাদের পাশে আছে আর কারা তাদের শত্রু। আবার এর পরে দু পা পেছোনোর জন্যও যেন আমরা তৈরি থাকি। নির্বাচনে জয়পরাজয়ের চাইতেও বড়ো লক্ষ্য আমাদের সামনে রয়েছে।

বন্ধুত্বের মুখোস পরে মানুষকে ভুলিয়ে রাখার পর্ব থেকে বেশ কিছুটা  বেরিয়ে এসেছে আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। আমি মনে করি আশার কথা এইটা যে এই বিবর্তনে আমাদের বামপন্থীদের সীমিত হলেও একটি সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। আর ঠিক সেই কারণেই ধর্মের নামে, পরিচিতিসত্তার নামে মানুষকে বিভাজিত করার প্রয়াস আরো কুৎসিত আকারে আমাদের গায়ে তার বিষনিঃশ্বাস ফেলছে। আমাদের লক্ষ্য থেকে আমাদের সরিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে। তার মোকাবিলা করতে  নিজেদের শক্তিকে আরো সংহত করার প্রয়োজনে যদি দুপা পেছোতেও হয় ক্ষতি নেই। যে জমিনে নিজেদের কাজের মধ্য দিয়েই আমরা পা রাখার সুযোগ পেয়েছি, সেখানকার মানুষের মনের ভিতরে আরো ধৈর্যসহকারে প্রবেশ করার সেটাই হবে সুযোগ। আজকের রক্তঋণ শোধ করার স্বার্থে তা করতেই হবে।