প্রখ্যাত কবি ও ছড়াকার সুকুমার রায় তাঁর ‘গোঁফচুরি’ কবিতায় এই নিবন্ধের শীর্ষনামে উল্লেখিত বাক্যবন্ধের অনুসারী ধারণা পোষণ করলেও অন্তত এই মুহূর্তে এই বাংলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের নপুংশক ভূমিকায় তা সঠিক বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনারের মুখে আছে একখানি পেল্লায় গোঁফ। তার মানেই তিনি বীর ও সাহসী মনে করার কোনো কারণ নেই। অথচ তিনি একজন দুঁদে আই এ এস। রাজ্য প্রশাসনের দীর্ঘদিনের আধিকারিক তথা রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। কিন্তু সেই তিনিই ‘কর্ত্রী’র ইচ্ছায় সদ্য সদ্য রাজ্যের মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বভার গ্রহণ করে নিজের ল্যাজেগোবরে অবস্থা করে ছেড়েছেন। এই বিষয়ে বিশদ বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ বিগত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহ ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা পর্যবেক্ষণেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

প্রথমত বিগত ৯ জুন নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি জারির দিন থেকেই ১৫জুন পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দেবার নির্ঘন্ট ঘোষণা ও দৈনিক বেলা ১১টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত এই কাজের সময়সীমা নির্দ্ধারণ একটি অবাস্তব সিদ্ধান্ত। অভিজ্ঞতা বলছে যে, প্রথম দুই দিন খোদ প্রশাসনই নিতান্ত অপ্রস্তুত অবস্থায় ছিল। ওই দুই দিন অনেক ব্লক অফিসেই মনোনয়নপত্র জমা নিতে পারেনি নির্বাচন কর্তৃপক্ষ। পরের চারদিনে অর্থাৎ মোট ছয়টি কাজের দিনের মোট ২৪ ঘন্টায় গ্রামসভা,পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের ত্রিস্তরে ৭৩ হাজার ৮৮৭টি আসনে মনোনয়নপত্র জমা নেবার অসম্ভব কাজকে সম্ভব করার ব্যর্থ প্রয়াস চালালেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার। ফল যা হবার তাই হয়েছে। খোদ শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসই অনেক আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি। এখন প্রশ্ন এই ঘাটতি কি তাহলে সীমাহীন নিয়োগ দুর্নীতির সাদা ‘ও এম আর’ সীট জমা দেবার মতো পুকুর চুরির প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে পিছনের দরজা দিয়ে গ্রহণ করে পূরণ করা হয়েছে? কমিশনার সাহেব স্পিকটি নট।

এই সন্দেহ দানা বেঁধেছে মনোনয়ন জমা দেবার শেষ দু’দিনে মোট ৮ ঘন্টায় শাসকদলের ৭৬ হাজার ৪৮৯টি মনোনয়নপত্র জমা পড়ায়। এই সন্দেহও দানা বেঁধেছে যে নির্বাচন প্রার্থীর জামানত জমার আগে অর্থাৎ ‘ডি সি আর’ কাটার আগে মনোনয়নপত্রগুলো জমা হয়েছে। আজ আর রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি কোনও সন্দেহই অমূলক নয়। আর মুখ্য নির্বাচন কমিশনার শাসকদলের দলদাস হয়ে এই অনিয়ম-বেনিয়ম হতে দিচ্ছেন না এমন কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না। এই সন্দেহরও উদয় হচ্ছে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক ব্যানার্জী ও তাঁর পরিবার-পরিজন সমভিব্যাহারে কমিশনার সাহেবের খানাপিনার ছবি সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায়। এর আগে সবাই দেখেছেন যে, সব মানসম্মান খুইয়ে কমিশনার সাহেব মুখ্যমন্ত্রীরও দাসানুদাসে পরিণত হয়েছেন। কারণ মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে নাম ধরে ও ‘তুমি’ বলে ডাকছেন কিন্তু কমিশনার সাহেব তাঁর পদমর্যাদা ভুলে তা মেনে নিচ্ছেন। অথচ একজনকে আই এ এস হতে হয় অনেক পড়াশোনার মাধ্যমে ও উচ্চ মেধার ভিত্তিতে। ‘সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ!’ একজন আই এ এস পদমর্যাদার আধিকারিকের মানমর্যাদার যদি এই হাল হয় এই রাজ্যে, তবে সাধারণ মানুষের মর্যাদার হাল কীরকম তা অবশ্যই অনুমেয়। এই মর্যাদাহীন বশংবদ আমলাই তো তৃণমূল আমলে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার হবার যোগ্য। তাই তো তিনি ওই পদে। তাঁর নপুংশতা, তাঁর অপদার্থতা তৃণমূল কংগ্রেসের তুরুপের তাস। অথচ এটি একটি সাংবিধানিক পদ। সেই পদের মর্ম শাসকদলের অনুগত ও বশংবদ একজন আমলা বুঝবেন কীভাবে? অন্ধের কিবা রাত কিবা দিন! অথচ এই রাজ্য দেখেছে মীরা পাণ্ডে নামের একজন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে। যিনি কোনওভাবেই শাসকদলের ক্রীড়নকে পরিণত হতে দেননি নিজেকে। প্রশ্নটা শিরদাঁড়ার। মীরা পাণ্ডের ছিল যে শক্তপোক্ত একটি শিরদাঁড়া! যার জোরে তিনি তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে নিজ দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন।

আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন জমার পর্বেই প্রথম দিন থেকে হামলা, সন্ত্রাস, খুনের ঘটনা ঘটে চলেছে শাসকদলের উদ্যোগে ও পুলিশ প্রশাসনের নিস্পৃহতায়। গত কয়েকদিনের মনোনয়ন পর্বে শাসকদলের সন্ত্রাস ও কিছুকিছু ক্ষেত্রে পাল্টা প্রতিরোধের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মুর্শিদাবাদের খরগ্রাম, রানিনগর, উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখা, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙর, কাকদ্বীপ, ক্যানিং, পূর্ব বর্ধমানের বলশূল, উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া সহ নানা জায়গা। ইতিমধ্যেই প্রাণহানি ঘটেছে চারজনের, আহত ও গুরুতর আহত বেশ কয়েকজন। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, যে নির্বাচন কমিশন মাত্র ৪০২টি মনোনয়ন কেন্দ্রের নিরাপত্তা বিধান করতে পারে না তারা দেবে ৭৩,৩৮৭টি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের নিরাপত্তা? একথা পাগলেও বিশ্বাস করবে? এরপর রয়েছে ভয় দেখিয়ে বিরোধী দলগুলোর প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের চাপ ও অন্যান্য নানা জবরদস্তির সম্ভাব্য ঘটনা। পারবেন কমিশনার সাহেব দলদাসত্বের উর্ধ্বে উঠে সংবিধান প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করে তাঁর গোঁফজোড়ার প্রতি সুবিচার করতে? অর্থাৎ একজন নীতিনিষ্ঠ কঠোর প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করতে?

আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন হল পঞ্চায়েতকে চোরেদের হাত থেকে উদ্ধার করে মানুষের পঞ্চায়েত গড়ে তোলার সংগ্রাম। এই মহাসংগ্রামে একইসঙ্গে পরাস্ত করতে হবে চোর তৃণমূল কংগ্রেস ও তাদের নেপথ্য মিত্র বি জে পি-কে। তৃণমূল এই রাজ্যে পঞ্চায়েত স্তর থেকে নবান্ন পর্যন্ত চুরির রেকর্ড সৃষ্টি করেছে, আর বি জে পি সারা দেশে সেই একই কাজ করে চলেছে। এস বি আই, এল আই সি সহ অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের অর্থ মোদীর বদান্যতায় কর্পোরেটদের দ্বারা অবাধ লুঠতরাজের কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। ওরা ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’। তাই তো সারদা, নারদার অভিযুক্তদের বিচার না করা থেকে আরম্ভ করে একেবারে হাল সময়ের কয়লা পাচারে অভিযুক্ত ভাইপোকে চার্জশীট দেওয়ায় ওরা অনিচ্ছুক। ওই দুই জনবিরোধী শক্তির বিরোধী অন্য সব শক্তি আজ এককাট্টা। তাই তো শাসকের বাধা উড়িয়ে হাজার আক্রমণের মধ্যেও মনোনয়ন জমা দিয়েছে তারা। আসন্ন নির্বাচন পর্বে রাজ্য নির্বাচন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকলে অথবা রাজ্য সরকারের সঙ্গে একযোগে ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী আসা আটকানোর লক্ষ্যে সুপ্রীম কোর্টে ছুটলেও সব হিসাব বুঝে নেবার জন্য মানুষ তৈরি আছে।