গত দুই দশকে ভারতে গ্রাম-শহরের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য বেড়ে গেছে। দেশজুড়ে কৃষিতে বিপর্যয় এবং গ্রাম থেকে ক্রমাগত মানুষের শহরে কাজের খোঁজে আসা-এর সাথেই আমাদের পরিচয় হয়েছে। আমরা সবাই জেনে গেছি  পরিযায়ী শ্রমিক গ্রামের মানুষের এখন এক বড় অংশ । এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত কি গ্রামোন্নয়ন সম্পর্কে কোন বিকল্প পথের সন্ধান দিতে পারে? পঞ্চায়েত এবং বিকেন্দ্রীভূত উন্নয়ন অর্থাৎ মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গ্রামোন্নয়ন -এই বিকল্পের কথা একমাত্র আমাদের দেশে ভেবেছিল বামপন্থীরা। তাই বামফ্রন্ট সরকারই কেরালা, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গে মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গ্রামোন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছিল ভারতের মাটিতে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের পর ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল কংগ্রেস দল। ২০১১ সালের পর আমাদের রাজ্যে গ্রামোন্নয়নের ধারণা কি তাহলে বদলে গেল? বদলে যাওয়াই স্বাভাবিক কারণ তৃণমূল কংগ্রেস কোনদিন বলেনি তারা মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিকেন্দ্রীভূত উন্নয়ন রাজ্যে নিয়ে আসবে। আমাদের দেশের যারা শাসক সেই বিজেপি দলও কখনো বলেনি যে তারা পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করবে। তাই ২০১১ এবং ২০১৪ সালের পর পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের চিত্র ভীষণভাবে বদলে গেছে। 

তৃনমূল কংগ্রেসের “উন্নয়ন” ও বিজেপির “বিকাশ” খুবই কেন্দ্রীকরণের ধারণা। সেখানে যত কথাই বলা হোক না কেন, সব কিছুই প্রকল্প ভিত্তিক। কেন্দ্রের প্রকল্প , রাজ্য সরকারের প্রকল্প -জনকল্যাণকর প্রকল্প হলেও প্রকল্পের ধারণা, পরিকল্পনা সবটাই কেন্দ্রীকরণ। এরকম প্রকল্প স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের দেশে ছিল। কেন্দ্রীয় প্রকল্প এবং রাজ্য সরকারের নিজস্ব জনকল্যাণকর প্রকল্প আমাদের দেশে নয়া উদারীকরণের আগেও ছিল। নয়া উদারীকরণের পর আরও বেশি বেশি প্রকল্পের কথা শোনা গেছে। এই প্রকল্পগুলি সম্পর্কে বলতে গেলে স্পষ্টতই যে কথা বলতে হয় তা হল প্রকল্প পৃথিবীর সব দেশেই আছে; বিশেষ করে উন্নতশীল দেশগুলিতে একটু বেশি করে আছে। তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি এই দুটি দলের পশ্চিমবঙ্গের আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে বক্তব্য শুধুই প্রকল্প। বামপন্থীদের ধারণা পৃথক। বামপন্থীরা চায় মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে মানুষের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা যা পশ্চিমবঙ্গে ছিল ২০১১ সালের আগে। 

কেমন ছিল ২০১১ সালের আগের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা? বামফ্রন্ট সরকারের শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৮ সালে। সেই ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত গঠনের সামনে কি লক্ষ্য ছিল বামফ্রন্টের? বামফ্রন্টের লক্ষ্য কখনওই ছিল না বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত গঠন। উল্টে বামফ্রন্ট সেই সময়ে সপ্তম পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্বালে তার ইস্তাহারেই বলেছিল যে পঞ্চায়েত মানুষের অংশগ্রহণে গ্রামোন্নয়নের কথা যেহেতু বলে, বামফ্রন্ট -বিরোধীদের পরিচালিত পঞ্চায়েত কোন অবস্থাতেই যেন না ভেঙ্গে দেওয়া হয়। সেই সময়ে মালদা, মুর্শিদাবাদে বামবিরোধী জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা সত্ত্বেও বামফ্রন্টের সদস্যরা বাজেট পাশ করতে সাহায্য করেছিলেন, সহযোগিতা করেছিলেন। পঞ্চায়েতে বিরোধী স্বর ছিল; ছিল গণতান্ত্রিক পরিবেশ। গ্রামোন্নয়নে কোন অসুবিধা হয়নি এর ফলে। এর ফলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় যারা স্বাভাবিক নেতৃত্বে উঠে এসেছিলেন মানুষের মধ্য থেকে তার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ এসেছিলেন তফশীলী জাতি, উপজাতি এবং সংখ্যালঘু মানুষের মধ্য থেকে। সেদিনও তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি দল ছিল গ্রামে জোতদার-জমিদারদের পক্ষে। তাই গ্রামোন্নয়নের প্রশ্নেও শ্রেণীদ্বন্দ প্রথম থেকেই ছিল। তৃণমূল কংগ্রেস- বিজেপি সেদিনও পঞ্চায়েতের দখল নিয়ে বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা বন্ধ করতে চেয়েছিল।বামফ্রন্ট সর্বত্র যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নিয়ে এসেছিল, তার ফলে গ্রামের মানুষ নিজেদের কথা বলার জায়গা পেয়েছিল। গ্রামের মানুষ আমলাদের থেকে গ্রামের মাটির সমস্যা ভালো বোঝেন, এই কথা বিশ্বাস করে না তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি দল। তাই তাদের স্লোগান মানুষের পঞ্চায়েতের পক্ষে নয়। তাদের স্লোগান নানা প্রকল্প-যার জন্য পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই। 

২০১০-১১ সালে এইহাবে কৃষি উৎপাদনে সাফল্য ধরে রাখা গিয়েছিল। ফলে উৎপাদনেও অগ্রগতিও চোখে পড়েছিল। এ সব কিছুই হয়েছিল পঞ্চায়েতে মানুষের অংশগ্রহণের ফলে। গ্রামে আয় বৃদ্ধির ফলে কৃষিক্ষেত্র থেকে অকৃষি পণ্যের চাহিদাও বেড়েছিল। তিন দশকের পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় ২০১১ সালের আগে গ্রামীণ দারিদ্র্য কমেছিল সবচেয়ে বেশি এ রাজ্যে। ২০২৩ সালে যখন পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তখন গ্রামের মানুষের কাছে মূল প্রশ্ন গ্রামীণ দারিদ্র্য। এখানেই বামফ্রন্ট এবং তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির পঞ্চায়েত সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ।  

কতগুলি কথা ২০১১ সালের পর ভুলিয়ে দেওয়া হল। পঞ্চায়েত যে কৃষি ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক ভবিষ্যনিধি প্রকল্প রূপায়ণ করতে পারে, পঞ্চায়েত যে হস্তশিল্পী, রেশম শিল্পী, তাঁতশিল্পীদের সামাজিক সুরক্ষা দিতে পারে, বা এই গ্রামে প্রকল্পের প্রয়োজনিয়তা নিয়ে পরিকল্পনা পর্ষদে দরবার করতে পারে- এই প্রশ্নই উঠল না ২০১১ সালের পর। ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার তো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ব্যবস্থাই তুলে দিল। এর ফলে পঞ্চায়েতকে অকেজো করে দেওয়ার শেষ পেরেক পোঁতা হল। পঞ্চায়েতকে আর স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন নিয়ে ভাবতে হয় না। বর্তমানে পঞ্চায়েতকে আর শিশু শিক্ষা আর মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে ভাবতে হয় না। পঞ্চায়েত এখন আর পুরস্কারও পায় না। যেখানে ২০১১ সালের আগে কর্মসূচী রূপায়নের ভিত্তিতে পুরস্কার প্রাপ্ত পঞ্চায়েতের সংখ্যা জনসংখ্যার বিচারে সারাদেশের মধ্যে ছিল ৪০%। এখন পুরস্কার পায় রাজ্য সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী।বামফ্রন্ট সরকারের কিংবদন্তী মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন যে গ্রামে কি প্রয়োজন তা আমলাদের থেকে বেশী বোঝেন গ্রামের মানুষ। তাঁরাই ঠিক করবেন গ্রামোন্নয়নের ধারা। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভাবে ধাক্কা খেল ২০১১ সালের পর যখন বাস্তুঘুঘুদের সাহায্যে নির্বাচিত পঞ্চায়েতকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল তৃণমূল কংগ্রেস আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। আমলা এবং পুলিশের সাহায্যে নির্বাচিত পঞ্চায়েতের অধিকার হরণ করা হল। গ্রামে গ্রামে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দুষ্কৃতীরা যারা প্রচ্ছন্নভাবে শাসক-ঘনিষ্ঠ। তাদের কাজ এটাই দেখা যে গ্রামের মানুষ যাতে অধিকার প্রয়োগ না করেন।এর ফল আমরা সরাসরি দেখলাম যে গ্রামোন্নয়নের কাজের কোন খোঁজ খবর আর পঞ্চায়েতের কাছে থাকল না। গ্রামোন্নয়নের কথা শুধুই জানলেন মুখ্যমন্ত্রী। গ্রামে কি প্রকল্প থাকবে আর থাকবে না , তা শুধুই জানলেন মুখ্যমন্ত্রী। কতটা গ্রামোন্নয়ন হল বা না হল, তার হিসেবও জানল আমলারা এবং মুখ্যমন্ত্রী। পঞ্চায়েত অফিসের প্রয়োজন ফুরোল। ব্লক প্রশাসনের অফিস থেকেই গ্রামোন্নয়নের কাজ হবে-এমনটা তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি সকলের পছন্দ। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামোন্নয়নের ধারণার পরিবর্তন হওয়ার পর পশ্চিমবাংলার গ্রামের আর্থিক পরিস্থিতি কেমন হল? 

অন্তোদ্যয় যোজনার তথ্যই পঞ্চায়েত সম্পর্কে জানার একমাত্র তথ্যের সূত্র। রাজ্য সরকারের পঞ্চায়েত দপ্তর আর কোন তথ্য দেয় না। সেই তথ্যে জানা যায় যে ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে বেকারি বেড়ে গেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১১-১২ সালে পুরুষের ক্ষেত্রে বেকারির হার  ছিল ২.৮%। ২০১৯-২০ সালে তা গিয়ে দাঁড়াল ৪.৯%। মহিলাদের ক্ষেত্রে এই হার ২০১১-১২ সালে ছিল ২.৪%। ২০১৯-২০ সালে তা গিয়ে দাঁড়াল ৩.০%। জনসংখ্যার নিরিখে লক্ষাধিক বেকার আজ পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে। তাই তো যেভাবে হোক গ্রাম ছাড়ছে গ্রামের মানুষ । পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। গ্রামীণ দারিদ্য এই কয়েক বছরে মারাত্মক বেড়ে গেল। যে দারিদ্য অতীতে কমে এসেছিল নতুন ব্যবস্থায় সেই দারিদ্র্য বেড়ে গেল। দুর্নীতি হল আকাশছোঁয়া। সেই কারণেই ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত দখল নিয়ে এত হিংসা। ২০২৩ সালেও বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত গড়ার জন্য শাসকদল এত মরিয়া।২০১৮ সালের মনোনয়ন পর্ব থেকে হিংসা এবং একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ২০২৩ সালে শাসক দলের গ্রামোন্নয়নের বর্তমান ধারণা স্পষ্ট করে। গ্রামকে কেন্দ্র করে কয়লা পাচার, বালি পাচার, গরু পাচার চক্র এই কয়েক বছরে এত সক্রিয় যে গ্রাম চলে গেছে সমাজবিরোধীদের দখলে। বর্তমানে এই দুর্নীতির বিষয়টি সকলের চোখের সামনে এসেছে; কিন্তু এই সব পাচার চক্র সক্রিয় হয়েছে ২০১১ সালের পর থেকেই ধীরে ধীরে। ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার পরিকল্পনা ব্যবস্থা লোপাট করে দিয়ে পঞ্চায়েতের অস্তিত্বকেই প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার গুরুত্ব কমে যাওয়ার ফলে গ্রামে মানুষের দুর্দশা বেড়ে গেল। গ্রাম ছেড়ে বেড়িয়ে যাওয়া ছাড়া আর তাদের কোন উপায় রইল না। গ্রামে কৃষি ভিত্তিক পরিবারগুলির গড় মাসিক আয় ২০১৮-১৯ সালে দাঁড়াল ৬৭৬২ টাকা; যেখানে সারা দেশে তা ১০,২১৮ টাকা। দেশের অবস্থাও খুব আশাপ্রদ নয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে পরিস্থিতি করুন। ২০১৮-১৯ সালে ৪৪% পরিবারের কৃষি থেকে আয় প্রায় ৪০০০ টাকা। এই আর্থিকভাবে দুরবস্থায় বিপন্ন পরিবারগুলিকে ভয় দেখিয়ে দাবিয়ে রাখার জন্য তৈরি ছিল শাসকের আশ্রিত সমাজবিরোধীরা। কোপ পড়েছে ঐতিহাসিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু ও মহিলাদের উপর। মহিলাদের উপর গ্রামে হিংসা বেড়ে গেছে এই কয়েক বছরে। অপরাধীরা বেশির ভাগ শাসক দল আশ্রিত। গ্রামবাংলায় অপরাধ বাড়লেও অপরাধীদের শাস্তি বিশেষ হয় না। পঞ্চায়েতের কণ্ঠরোধ করার এই জন্যই প্রয়োজন । 

বিকল্পে দাঁড়িয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্বালে মানুষের পঞ্চায়েত গঠনের কথাই একমাত্র বিকল্প। আবার গ্রামবাংলার মানুষের হাতে পঞ্চায়েতকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য লড়ছে বামপন্থী দলগুলি। এ লড়াই আক্ষরিক অর্থে শ্রেণী সংগ্রামের লড়াই।সেই লড়াই লড়ছে গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষ বামপন্থার মতাদর্শে ভর করে।