বাজারি মিডিয়াতে ব্রেকিং নিউজ হিসাবে দূরে থাক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হিসাবেও উঠে আসেনি এই মামলার খবর। কারণ, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কারচুপির অভিযোগে গত ১৯শে জুন কলকাতা হাইকোর্টে এই মামলা করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, যার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের অভিযোগও। পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল করার শেষ দিন১৫ ই জুন অস্বাভাবিক বেশি সংখ‍্যায় মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে শাসকদলের পক্ষ থেকে – এই খবরটা কমবেশি সব গণমাধ্যমেই প্রচারিত হয়েছিল। সিপিআই(এম) এর পলিটব্যুরোর সদস্য তথা পশ্চিমবঙ্গের রাজ‍্য কমিটির সম্পাদক মহম্মদ সেলিম স্পষ্ট অভিযোগ করেছিলেন, ডিসিআর কেটে মনোনয়নপত্র পূরণ করে যাবতীয় নথিপত্র সহ জমা দিলে কয়েক ঘন্টায় চল্লিশ হাজার মনোনয়ন দাখিল করা বাস্তবে অসম্ভব। অথচ গত ১৪ ই জুন তেমনই ঘটনা ঘটেছিল। ব‍্যঙ্গ করে মহম্মদ সেলিম সেদিন বলেছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেসের জন‍্য কোন হোমডেলিভারি এজেন্সিকে দিয়ে কি এই বিশেষ ব‍্যবস্থা করেছিল নির্বাচন কমিশন?

গত ১৯শে জুন কলকাতা হাইকোর্টে প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানমের ডিভিশন বেঞ্চে গৃহীত মনোনয়ন কারচুপি নিয়ে এই মামলায় অভিযোগে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল করার শেষ দু দিনে আট ঘন্টার মধ‍্যে ছিয়াত্তর হাজার মনোনয়ন জমা করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। অন‍্যদিকে আদালতের নির্দেশ হাতে নিয়েও মনোনয়ন জমা দিতে পারেন নি বিরোধী দলগুলোর অনেক প্রার্থী। সেভ ডেমোক্র‍েসি,শান্তি গণতন্ত্র সংহতি মঞ্চ এবং মনোনয়নপত্র জমা না দিতে পারা বেশ কিছু ইচ্ছুক প্রার্থীর করা এই মামলার প্রথম শুনানি হবে আগামী ২১শে জুন। মামলাকারীদের বক্তব্য,হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার ভিডিও ফটোগ্রাফি করা বাধ‍্যতামূলক। সেই ভিডিও ফুটেজ খতিয়ে দেখলেই ধরা পড়বে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় আদৌ শাসকদলের ক জন প্রার্থী মনোনয়ন কেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন। আবেদনকারীদের পক্ষে এই মামলায় আইনজীবী হিসাবে সওয়াল করবেন শামিম আহমেদ,রাজিতলাল মৈত্র ও সিদ্ধার্থ শঙ্কর মণ্ডল।

বস্তুত মনোনয়ন পর্বে শাসকদলের গুণ্ডামি ছাড়া ২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের নির্ঘন্ট ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই যা দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে,তা হলো রাজ‍্য নির্বাচন কমিশন ও তার মাথার ওপর বসে থাকা নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহার কদর্য পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ,যা একটি স্বাধীন স্বশাসিত সংস্থার পক্ষে বেমানান। গত ৯ ই জুন পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। পুলিশ বাহিনীকে দিয়ে সন্ত্রাস ও হিংসা মোকাবিলায় ব‍্যর্থ নির্বাচন কমিশন। শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন বলেই প্রথমে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন রেখে পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনা করার কথা বলেও রাজ‍্য নির্বাচন কমিশন এক দিনের মধ‍্যে রাজ‍্য সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করতে পৌঁছে গেলেন কেন্দ্রীয় বাহিনী আনার বিরোধিতা করতে। শুধু তাই নয় প্রশ্ন উঠছে এই কারণেই কি শাসকদল সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মোট আটজন কর্মী মনোনয়ন পর্বে নিহত হলেও নির্বাচন কমিশন তা নথিভুক্ত করে নি? যাতে সর্বোচ্চ আদালতে রাজ‍্যের পরিস্থিতি নিরাপদ দেখানো যায়?
এখানেই শেষ নয়। পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক কর্তাদের ভূমিকাও সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। গতকাল শিলিগুড়ি থেকে অভিযোগ এসেছে রাজগঞ্জে সিপিআই(এম) সমর্থিত নির্দল প্রার্থী সাদ্দাম হোসেনের মনোনয়নপত্র স্ক্রুটিনিতে সর্বসম্মতভাবে অনুমোদিত হওয়ার পরেও রাজগঞ্জের বিডিও তা বাতিল করে দেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করিয়ে দেওয়ার জন্য। লিখিতভাবে নয়, বাম সমর্থিত প্রার্থীকে ফোনে জানানো হয় তাঁর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।

মনোনয়ন কারচুপি নিয়ে হাইকোর্টের মামলার অভিযোগে বিশেষভাবে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ভাঙড় এবং উত্তর চব্বিশ পরগণার মিনাখাঁ বসিরহাটে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়াল জন‍্য বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা ইচ্ছুক প্রার্থীদের জন‍্য পুলিশি নিরাপত্তার নির্দেশ দিলেও নির্বাচন কমিশন সে বিষয়ে কোন পদক্ষেপ না নেওয়ায় সন্ত্রাস এবং হিংসার কারণে অনেক প্রার্থী নির্ধারিত সময়ে মনোনয়ন দিতে পারেন নি। যেহেতু বর্তমান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে রাজ‍্য নির্বাচন কমিশন কোনভাবেই সুষ্ঠুভাবে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের অনুকূল পরিস্থিতি নিয়ে আসতে সফল হচ্ছেন না তাই তাঁকে বহিস্কার করার আবেদন জানানো হয়েছে।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত জানা গেছে এ যাবৎ বাতিল হওয়া ৩১৬৪টি মনোনয়নপত্রের মধ‍্যে তৃণমূল কংগ্রেসের ৪৯৬টি,বিজেপির ৯০৫ টি,কংগ্রেসের ২৪২ টি এবং সিপিআই(এম) এর ১২৪২টি। পঞ্চায়েতে ত্রিস্তরে মোট আসন ৭৩ হাজার ৮৮৭টি হলেও তৃণমূল কংগ্রেসের ৮৩ হাজার ৬৪৬টি মনোনয়ন রয়ে গেছে। অর্থাৎ মনোনয়ন পর্বেই ঘাসফুলের গোঁজ প্রার্থীর সংখ‍্যা ৯হাজার ৭৫৯ জন। তাদের মধ‍্যে ক জন কে শেষ পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীপদ প্রত‍্যাহার করাতে পারবে সেটাই প্রশ্ন হলেও পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে এমন পরিস্থিতি কার্যত নজিরবিহীন এ কথা বলাই যায়।