আদালতের নির্দেশকে তৃণমূল কংগ্রেস বুড়ো আঙুল দেখাতে অভ‍্যস্ত আবার প্রমাণিত হল আসন্ন  পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নপর্বের সূচনাতেই। কলকাতা হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে  পঞ্চায়েত নির্বাচনে কোনভাবেই সিভিক ভলান্টিয়ারদের কাজে লাগানো যাবে না।কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ঠিক তার বিপরীত। গত ১০ ই জুন মুর্শিদাবাদের রানিনগরে মনোনয়ন পর্ব চলাকালীন শান্তিরক্ষার দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে সিভিক ভলান্টিয়ারদের।  লাঠিচার্জ করতেও কসুর করেনি তারা। বসিরহাট বিডিও অফিসে মনোনয়ন চলাকালীন কেবলমাত্র সিভিক ভলান্টিয়ারদেরই পাহারা দিতে  দেখা গেছে।  অথচ বিচারপতি রাজশেখর মান্থার নির্দেশ মেনে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল মনোজ মালব‍্য সম্প্রতি আদালতের হলফনামায় জানিয়েছেন সিভিক ভলান্টিয়ারেরা কি কি কাজ করতে পারবেন আর কি কি কাজ করতে পারবেন না। গত ২৪শে মার্ট সিভিক ভলান্টিয়ারদের কাজ সম্পর্কে বিচারপতি রাজশেখর মান্থা যে নির্দেশ দিয়েছিলেন,গত ৯ ই জুনও সেই নির্দেশ বহাল রাখা হয়েছে। কার্যক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন ও রাজ‍্যপ্রশাসন দু পক্ষই সেই নির্দেশ অগ্রাহ‍্য করেছে।

প্রকৃতপক্ষে,সিভিক ভলান্টিয়ারদের ভোটের কাজে কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলার কাজে লাগানো যায় না।  ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ এবং আরও কিছু পরিষেবা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলানো কিংবা ভোটের কাজে সিভিক ভলান্টিয়ারদের ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু আসল কথাটি বলেছেন সিপিআই(এম) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস‍্য সুজন চক্রবর্তী। তিনি বলেছেন, পুলিশে নিয়োগ বহুদিন ধরে বন্ধ। থানাগুলি এখন সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়েই চলে। এখন দেখা যাচ্ছে,পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্বেও তাঁদের ব্যবহার করা হচ্ছে। বসিরহাটে বিডিও অফিসে সিভিক ভলান্টিয়ারদের ভূমিকার ভিডিও রাজ‍্য নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়ার কথা সিপিআই(এম) এর। অন‍্যদিকে ১২ ই জুন সোমবার  কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্য সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে মনোনয়ন পর্ব ও আইন শৃঙ্খলা সংক্রান্ত রিপোর্ট দিতে বলেছে। মনোনয়ন পর্বের জন‍্য পর্যাপ্ত সময় না থাকার কথা হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে রয়েছে,কিন্তু সে বিষয়ে যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আদালতে অভিযোগ জানিয়েছে,তারা সিভিক ভলান্টিয়ারদের কাজে লাগানোর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আদালত কি মন্তব্য করবেন তার অপেক্ষায় থাকতে হবে। 

তড়িঘড়ি পঞ্চায়েত  নির্বাচন ঘোষণা করার পরে শাসকদলের আগেই বিরোধী দলগুলোর প্রার্থীরা মনোনয়ন পত্র দেওয়ার তৎপরতা দেখে কিছুটা বেকায়দায় তৃণমূল কংগ্রেস। সাকুল‍্যে পাঁচদিন মাত্র বরাদ্দ করা হয়েছে  মনোনয়নের জন‍্য। সদ‍্য নিযুক্ত  নির্বাচন কমিশনারের এই কৌশল  প্রধানত তৃণমূল কংগ্রেসের গোঁজ প্রার্থীদের আটকানোর জন‍্য। কিন্তু কার্যত এই কৌশল ব‍্যূমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে। উপরন্তু প্রশ্ন উঠে গেছে সিভিক ভলান্টিয়ারদের ভোটের কাজে লাগানোর কৌশল নিয়েও। ফলে বেশ চাপে শাসকদল।

পশ্চিমবঙ্গে  তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার প্রতিষ্ঠার পর পুলিশের কাজে সহায়তার জন্য ভিলেজ পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ করা হয়।কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে ভিলেজ পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়াররা শাসকদলের অঙ্গুলিহেলনে এক্তিয়ারের বাইরে বেরিয়ে কাজ করছে -এই মর্মে অভিযোগ ওঠা শুরু করে । বিশেষত বিরোধীদের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে প্রতিবাদী রাজনৈতিক কর্মীদের মারধর করা হেনস্থা করা থেকে শুরু করে কার্যত সিভিক ভলান্টিয়ার ও ভিলেজ পুলিশদের  তৃণমূলের দলদাস হিসাবেই দেখা গেছে।  অবশ‍্য এখনও পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যই সিভিক ভলান্টিয়ারদের কাজ পাওয়ার মাপকাঠি বলেই গণ‍্য হয়। সম্প্রতি  বর্ধমান জেলায় তৃণমূলের কমিটি প্রকাশ হবার পর দেখা গেছে  বিভিন্ন দায়িত্ব পূর্ণ পদে স্থান দেওয়া হয়েছে সিভিক ভলান্টিয়ার ও ভিলেজ পুলিশকে।যা নিয়ে পঞ্চায়েত ভোটার প্রাক্কালে জেলার কালনা ২ ব্লকের রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল।

তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মাস কয়েক আগে দলের ব্লক কমিটিতে জায়গা পাওয়া নেতা নেত্রীদের নাম প্রকাশ করা হয়।আর অতি সম্প্রতি প্রকাশ করা হয় জেলা কমিটি। এর পরেই জানা যায় কালনা ২ নং ব্লকের বিভিন্ন অঞ্চলে দল পরিচালনার দায়িত্বে পেয়েছেন তিন সিভিক ভলান্টিয়ার সৈকত পুজারি, সঞ্জয় ঘোষ ও রেজাউল মণ্ডল।সঞ্জয় ঘোষ আবার কালনা ২ ব্লকের বৈদ্যপুর অঞ্চলের যুব সভাপতি পদে দায়িত্ব পেয়েছে।এছাড়াও তালিকায় এক ভিলেজ পুলিশের নামও রয়েছে। তার নাম সৌভিক ঘোষ। তিন সিভিক ভলান্টিয়ার ও ভিলেজ পুলিশ কালনা থানার অধীনে কর্মরত।

রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেসের সাংগঠনিক পদে দায়িত্ব পাওয়া নিয়ে সিভিক ভলান্টিয়ার সৈকত পুজারির কাছে জানতে চাওয়া হলে তার সাফ জবাব ,’দল আমায় চাকরি দিয়েছে। ডিউটির পরে আমি রাজনীতি করতেই পারি’।একই উত্তর দেন অঞ্চলের যুব সভাপতি পদে দায়িত্ব পাওয়া অপর সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় ঘোষের বাড়ির লোকজন।

সিভিক ভলান্টিয়ারদের কাজ কর্ম নিয়ে মামলা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতের চাপে রাজ্যের সিভিক ভলান্টিয়ারদের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করেদিতে বাধ্য হয় রাজ্য সরকার । সেই মত ঠিক হয় আইনশৃঙ্খলা জনিত কোন বিষয়ে সিভিক ভলান্টিয়ারদের ব্যবহার করা যাবে না ।সিভিক ভলাণ্টিয়াররা শুধমাত্র ভিড়,যান নিয়ন্ত্রণ এবং কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মীদের সহযোগিতা করতে পারবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু  কালনা ২ ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি প্রণব রায় বলেছিলেন,”সিভিক ভলান্টিয়াররা ভলান্টিয়ারি সার্ভিস দেয়।এর জন্য সরকার তাদের কিছু মজুরি দেয় । যেহেতু এরা রাজ্য সরকারের বেতনভুক কর্মী নয় তাই সিভিক ভলান্টিয়ারদের

রাজনীতি করার ক্ষেত্রে আইনগত কোন বাধা আছে বলে মনে হয় না”। 

‘কিন্তু আদালতের নির্দেশ অগ্রাহ‍্য করে সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের কাজ করানোর অভিযোগের বিরুদ্ধে সাফাই দিতে  গিয়ে  তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, “সিভিক ভলান্টিয়ারেরা শুধুই সমাজসেবা করে। সেই কাজেই ওদের লাগানো হচ্ছে।”  কুণালের বক্তব্য , “যাঁরা বৃদ্ধ, বয়স্ক প্রার্থী হতে চান তাঁদের হাত ধরে নিয়ে যাওয়া, কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না দেখা এসব কাজই করছে ওরা। মূলত সমাজসেবা মূলক কাজের জন্য সিভিক ভলান্টিয়াররা আছে। কিন্তু, আচমকা যদি কোনও গন্ডগোল হয় তখন যে কোনও নাগরিকের কর্তব্য সেটাকে থামিয়ে দেওয়া। এর সঙ্গে কোর্টের নির্দেশের অবমাননার কোনও সম্পর্ক নেই।”

তাহলে মনোনয়ন জমার জায়গায় মাথায় হেলমেট, হাতে লাঠি নিয়ে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে কেন সিভিক ভলান্টিয়ারদের? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে  কুনাল ঘোষের জবাব , “আসলে ওরা তো সমাজসেবার জন্যই ছিল। এখন যদি দেখে কংগ্রেস, সিপিএমের লোকেরা ইট-পাথর মারছে তাই তাদের বাঁচার জন্য প্রোটেকশন দেওয়া হচ্ছে।” 

“প্রোটেকশন ” কেন জরুরি মনে হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের? কারণ বামপন্থীদের নেতৃত্বে  প্রতিরোধ গড়ছেন জনগণ। পাশে দাঁড়িয়ে পড়ছেন কংগ্রেস কর্মীরাও। মুর্শিদাবাদের রানীনগর থেকে ডোমকল হয়ে আসানসোলের বারাবনি পর্যন্ত প্রতিরোধের নতুন ইতিহাস লিখছেন জনগণ। তৃণমূল কংগ্রেস,তার বশংবদ পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়ারদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে জেলাপরিষদ থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত পর্যন্ত  মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছেন বিরোধী প্রার্থীরা।

কিন্তু সেইসঙ্গে বোঝা যাচ্ছে, পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিজেদের অনুগত নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার সিনহাকে সামনে রেখে নির্বাচনী বিধিকে অগ্রাহ‍্য করবে শাসকদল। যখন পর্যাপ্ত পুলিশবাহিনী ছাড়া পঞ্চায়েত নির্বাচন করানোর পরিকল্পনা রাজ‍্য নির্বাচন কমিশন করেছিলেন তখনই বোঝা গিয়েছিল সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সদিচ্ছা যেমন নির্বাচন কমিশনের নেই তেমনি ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের অরাজকতার অভিজ্ঞতা থেকে কোন শিক্ষাই নেননি নির্বাচন কমিশন। 

সবচেয়ে হাস‍্যকর স্থানে নিজেকে নামিয়ে এনেছেন সর্বভারতীয় তকমা হারানো  তৃণমূল কংগ্রেসের নাম্বার টু নেতা  সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়।তাঁর  শান্তিপূর্ণ সুষ্ঠু পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি  যে নেহাতই কথার কথা,তা “ডায়মণ্ডহারবার মডেল “- এর অভিজ্ঞতা মনে রাখা বামপন্থী কর্মীরা জানতেন। তিনি যতবার অবাধ নির্বাচনের কথা বলেছেন ততবারই বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া থেকে ভোট গণনা পর্যন্ত আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। ২০২৩ সালে গ্রাম বাংলার জনতা দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল কংগ্রেস ও তার দোসর বিজেপিকে এক ইঞ্চি জায়গা না ছাড়ার জন‍্য যে এককাট্টা হয়ে প্রতিরোধ গড়বে তা আগামীদিন আরও বেশি করে বুঝতে পারবে পিসি ভাইপোর বাহিনী।