“এই সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে

 দিতে হবে ভাষা; এই সব শান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে,

ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা… “

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দেশের বৃহত্তর জনসমাজকে অশিক্ষার অন্ধকারে, দারিদ্র্যের দুঃসহ বেদনা, উপেক্ষা, বঞ্চনা আর উৎপীড়নের নিষ্ঠুরতার মধ্যে নিক্ষেপ করে কখনো দেশের উন্নতি সম্ভব নয় ।জনগণই যেখানে দেশের মূল ভিত্তি, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শক্তির উৎস, সেখানে তাদের উপেক্ষা বা অবজ্ঞার অর্থ গণতন্ত্রের সমাধিক্ষেত্র রচনা করা। জনগণের যথার্থ অংশগ্রহণেই গণতন্ত্রের বিজয়-মহিমা পঞ্চায়েতরাজ প্রতিষ্ঠা জনগণেরই অধিকার স্বীকৃতির সনদ ।

★ পঞ্চায়েত রাজের পটভূমি :-

পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা অতীত ভারতেরও এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। গ্রামীণ পটপ্রেক্ষায় সেদিনও তার এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ইংরেজ শক্তির অভ্যুদয়ে গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থার জীবনরঙ্গে যেদিন ভাঙনের প্রবল জোয়ার এলো, সেদিন পঞ্চায়েতী ব্যবস্থায়ও লাগল সেই ভাঙনের ঢেউ। তারপর কিছুকাল ধরে চলল ইংরেজ প্রবর্তিত ইউনিয়ন বোর্ড, লোকাল বোর্ড, জেলা-বোর্ড ইত্যাদির মাধ্যমে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রহসন। জীবনের যোগ না থাকায় এসব প্রচেষ্টা হলো ব্যর্থ। আমাদের দেশে মহাত্মা গান্ধীই পঞ্চায়েতরাজের ওপর গুরুত্ব দিলেন। গ্রাম-স্বরাজই ছিল তার মূল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা এক অপরিহার্য সোপান। আমরা জানি, ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণই সক্রিয় অংশীদার। তার অতন্দ্র প্রহরী। এলো প্রস্তুতির লগ্ন। দেশপ্রেম, রাজনীতি ও সমাজনীতি শিক্ষার আগ্রহে জাতি হলো উদ্বেল, অস্থির। পঞ্চায়েতরাজ প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে দীর্ঘ সুপ্তির পর আবার গ্রামের জাগরণ ঘটল । বহুদিন পরে তার মরাগাঙে এলো নতুন বান। গ্রাম ফিরে পেল তার স্বায়ত্বশাসন অধিকার, ফিরে পেল তার আত্মকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সর্ববিধ ক্ষমতা ।

★ পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সূচনা:-

১৯৫৮ সাল । পশ্চিমবঙ্গে প্রথম পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সূচনা হল। প্রথমে বীরভূম জেলার ৪টি ব্লকে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ৫০টি অঞ্চল-পঞ্চায়েত ও ২৫০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের সূত্রপাত হল । ১৯৬১ সালে আরও ৪টি ব্লকে ও ১৯৬৪ সালে জেলার অবশিষ্ট সব ব্লকেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রবর্তন হলো। ১৯৬৫ সালে প্রতি ব্লকেই আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলায় জেলা পরিষদের প্রতিষ্ঠা হলো। প্রত্যেক পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানেরই চার বছর পর নির্বাচনের শর্ত ছিল। কিন্তু সেই শর্ত পালিত হলো না। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার যে-জোয়ার পশ্চিমবাংলার গ্রামীণ জীবনকে নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনায় উচ্ছল, তরঙ্গমুখর করেছিল সেখানে একসময় এলো

ভাঁটা। প্রাথমিক পর্যায়ের উদ্দামম-উৎসাহ এলো ঝিমিয়ে। অনাগত দিনের স্বপ্ন-সম্ভাবনার যে উজ্জ্বল দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল, তা আবার নানা কারণে হলো মেঘাচ্ছন্ন। সময় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো না । কায়েমী স্বার্থ দানা বাঁধল। পঞ্চায়েত কর অনাদায়ী থাকল। অনাদায়ী করের জানো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণেও ছিল অনিচ্ছা, অক্ষমতা। গ্রামীণ উন্নয়নমূলক কাজের গতি ক্রমশ শ্লথ হলো। দিনে দিনেই পঞ্চায়েত-প্রতিষ্ঠান প্রাণহীন, অকর্মণ্য হয়ে পড়ল। সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা, নিস্পৃহতা বাড়ল। পঞ্চায়েতের সভা-অধিবেশনও ক্রমশঃ হলো অনিয়মিত । পশ্চিমবাংলার রাজনীতির তটরেখায় এসে আছড়ে পড়ল নানা তরঙ্গ বিক্ষোভ। সুদূর গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ল সেই ঢেউ। রাজনৈতিক চেতনার প্রসার ঘটল। জাগল অধিকার সচেতনতার আকাঙ্ক্ষা। এলো রাজনৈতিক অস্থিরতার দিন। পঞ্চায়েতের দুর্দশাও বাড়ল। অঞ্চল-প্রধান, গ্রামসভার অধ্যক্ষরা পদত্যাগ করলেন।

★ পঞ্চায়েত ব্যবস্থার নতুন মূল্যায়ন :-

পঞ্চায়েতী-ব্যবস্থায় ছিল গ্রামবাসীদের উদ্যোগ-সৃষ্টির সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি মাত্র। সেখানে কোন রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক গুরুত্ব ছিল না। পক্ষান্তরে, পঞ্চায়েতরাজ ব্যবস্থায় আছে নিম্নতম গ্রামসভা থেকে উচ্চতম লোকসভা স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত পরিষদের হাতে অধিক ক্ষমতা অর্পণের কথা। তাদের হাতেই দেওয়া হলো স্থানীয় উন্নয়নমূলক কাজের দায়িত্ব।

দেওয়া হলো শাসন ও সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে বিচারের ভার। পঞ্চায়েত শুধু গ্রামীণ মানুষের জন্যে রাস্তা বা পানীয় জলের ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠান নয়। পঞ্চায়েতের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হল । কৃষি ও গ্রামীণ শিল্পের উন্নতি বিধান, গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তরসাধন এর কর্মসূচির অন্তর্গত হলো। পঞ্চায়েতরাজ প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। গণতান্ত্রিক উপায়ে পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানের ওপর অধিক শাসনক্ষমতা অর্পণের অঙ্গীকার। পঞ্চায়েতরাজ সংগঠনে তিনটি প্রধান স্তর । প্রথমে স্বায়ত্ত শাসন, পরে গ্রামীণ সমষ্টি উন্নয়নে ব্লক ও জেলা।  এমনি করেই গ্রামীণ সমাজের স্ব-নির্ভরতা অর্জনের প্রাণকেন্দ্র হলো পঞ্চায়েত-প্রতিষ্ঠান । পঞ্চায়েতরাজের উদ্দেশ্য, সার্থকতা এখানেই।

★ পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত রাজ প্রতিষ্ঠা:-

অবশেষে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম-জীবনে এলো আবার দিন বদলের পালা। এলো নতুন প্রাণোন্মাদনার জোয়ার। রাজনৈতিক অস্থিরতার দিন তখন বিদায় নিয়েছে। ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় পঞ্চায়েতরাজ বিল পাস হলো। সংশোধিত হলো পঞ্চায়েত আইন। এতে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতরাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রসারিত হলো। প্রশস্ত হলো আর্থিক অনুদানের ক্ষেত্র। আমলাতন্ত্রকে সংযত করার চেষ্টা হলো। শিথিল হলো

সরকারী লাল ফিতার বাধন। নতুন ব্যবস্থায় কায়েমী স্বার্থ রোধ করারও ব্যবস্থা থাকল। ১৯৭৮ সালে সংশোধিত পঞ্চায়েতরাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম নির্বাচন হলো । দ্বিতীয় নির্বাচন হলো ১৯৮৩ এর মে মাসে। তিনটি স্তরে মোট নির্বাচিত আসন সংখ্যা ৫৫,৩২০টি। পঞ্চায়েতরাজ প্রতিষ্ঠা এবং তার বিরাট কর্মযজ্ঞের ফলেই আটাত্তরের মহাপ্লাবী বন্যা বা তিরাশির সর্বনাশা খরার মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে। সম্ভব হয়েছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য-প্রকল্প গ্রহণ করে অনেক গ্রামীণ সমস্যার সমাধান । এই মহাযজ্ঞ উদযাপনে কিছু কিছু ভুলভ্রান্তি ও হয়েছে। মাথাচাড়া দিয়েছে কোথাও কোথাও দলীয় সঙ্কীর্ণতা। বেড়েছে রাজনৈতিক কোন্দল । তবু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই হবে এর নিরসন। প্রত্যেক গ্রামেই, সেই গ্রামের প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী-পুরুষের সক্রিয় অংশগ্রহণে ও তাদের নির্বাচিত

প্রতিনিধি নিয়ে গড়ে ওঠে গ্রামসভা। এরা গ্রামের সর্বপ্রকার পৌর ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখেন। আমলাতন্ত্রের দৃষ্টির বাইরে এদের নানাবিধ সমস্যা এরাই সমাধানের চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে সরকারের কাজ ছিলো, এদের প্রয়োজনমত সাহায্য করা। তা সরকার করেও ছিল।

এরা কৃষি-উৎপাদন, গ্রাম্য-শিল্প, প্রসূতি ও শিশুকল্যাণ, চিকিৎসা-ব্যবস্থা, সাধারণের পশুচারণ ভূমির তত্ত্বাবধান, গ্রামের রাস্তা, পুকুর, দীঘি, নর্দমা সংস্কার ইত্যাদি নানা সমস্যার তদারক করেন। অনেক সময় প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রেও এঁদের নজর দিতে হয়। আবার কোথাও ভূমিরাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব থাকে এদের ওপর। দ্বিতীয় পর্যায়ে হলো গ্রাম-পঞ্চায়েত। কতগুলো গ্রাম-সভা থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হয় গ্রাম-পঞ্চায়েত। গ্রাম-পঞ্চায়েতের মধ্য থেকেই নিজেরা অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ নির্বাচন করেন । এঁদের কার্যকাল চার বছর। এর পরবর্তী স্তরই হলো অঞ্চল-পঞ্চায়েত । গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্য থেকেই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে অঞ্চল-পঞ্চায়েতের প্রতিষ্ঠা। অঞ্চল-পঞ্চায়েতের সদস্যরাও নিজেদের ভেতর থেকে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ নির্বাচন করেন। অতীতে গ্রামের বিরোধ-বিসংবাদ মেটাবার জন্যে ইউনিয়ন-বোর্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিচারালয় ছিল। বর্তমান ব্যবস্থায়ও অঞ্চল-পঞ্চায়েতের সঙ্গে বিচারকার্য পরিচালনার জন্যে রয়েছে একটি ন্যায়-পঞ্চায়েত। রাজ্য সরকারের অনুমোদনসাপেক্ষ অঞ্চল-পঞ্চায়েতগুলো তাদের অধীন গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে পাঁচজন সদস্যের একটি বিচারকমণ্ডলী গঠন করেন। এঁদের ওপর ভারতীয় দণ্ডবিধির লঘু অপরাধের বিচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শাস্তি দানের ক্ষমতাও এঁদের মাঝারি ধরনের ছিল।

 আমাদের সাফল্য :-

এখন যে রাজ্য সরকারের স্লোগান “দুয়ারে সরকার” সেই ভাবনা অনেক আগেই বাম আমলে নিয়ে আসা হয়েছিল। জ্যোতিবাবু প্রায়ই বলতেন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কথা। রাইটার্স বিল্ডিং থেকে নয়, পঞ্চায়েত দিয়েই চলবে সরকার।

কেন্দ্রীয় সরকারের আইন ব্যবহার করেই

শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, আধুনিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা গেছে।

ভূমিসংস্কার রাজ্যের গ্রামীণ মানুষকে যদি আর্থিক সুরাহা দিয়ে তাকে তাহলে বামফ্রন্টের আমলে পঞ্চায়েত তাদের দিয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা। পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক সম্পর্ক  এবং ক্ষমতার মূলে আঘাত হেনেছে।

এখানে নিয়মিত নির্বাচন হয়েছে।

পঞ্চায়েতের মাধ্যমে একেবারে নিচে থেকে উন্নয়ন পরিকল্পনা তুলে এনেছে। সরকারী খরচের প্রায় ৩৫ শতাংশ টাকা খরচ করা হতো ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত মারফত। খাপ পঞ্চায়েতের মত চূড়ান্ত পিছিয়ে পড়া ব্যবস্থার দেশে পশ্চিমবঙ্গ গোটা ভারতবর্ষে এক উদাহরণ।

বামফ্রন্ট সরকারের সময় পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ ৩৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করেছিল। একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল পুরসভাগুলির ক্ষেত্রেও। তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য সংরক্ষণ ছাড়াও, সপ্তম বামফ্রন্ট সরকরের আমলে ও বি সি সম্প্রদায়ের জন্য জনসংখ্যার অনুপাতে পঞ্চায়েতে আসন ও পদ সংরক্ষন করা হয়।

পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় জনগনের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে ১৯৯২সালে তৈরি হয় গ্রাম সংসদ। অর্থাৎ, ৭৩ তম সংবিধান সংশোধনের আগেই। সারা দেশের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম সংসদ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে। পঞ্চায়েতে গণঅংশগ্রহণে  পশ্চিমবঙ্গই এদেশে পথপ্রদর্শক।

পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার নেতৃত্বে উঠে এসেছিল দুর্বলতর মানুষের প্রতিনিধি। এদিক থেকেও পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত দেশে নতুন নজির সৃষ্টি করে।

★ লোডসেডিং এর মোকাবিলা :-

লোডসেডিং একটি পপুপার বিদ্রুপ হয়ে উঠেছিল সেই সময়ে। সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৭ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো মাত্র ১৬১৫ মেগাওয়াট। ২০১১ সালের নির্বাচনের আগে তা দাঁড়ায়, ১১,৩০০ মেগাওয়াটে। প্রতিটি পরিবারে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। আবার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সরকারকে যে রাজনৈতিক অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল তা সর্বজনবিদিত।

★ দারিদ্র হ্রাস:-

দারিদ্র হ্রাস এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভৌগলিক কারনেই ১৯৭৭-র আগে শহর-গ্রাম মিলিয়ে গড়ে ৬০ শতাংশের উপর মানুষ এরাজ্যে দারিদ্রসীমার নীচে ছিলেন। পরিকল্পনা কমিশনের হিসেবে, ২০০৪-০৫ সালেই তা ২০.৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল।কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য বলছে, দারিদ্র্য কমার হারে দেশের মধ্যে দ্বিতীয় ছিল পশ্চিমবঙ্গ; কেরালার পরই।   ষষ্ঠ এবং সপ্তম বামফ্রন্টের সময়কালে রাজ্যে আর্থিক অগ্রগতির হার জাতীয় গড়ের ওপরে থেকেছে। ২০০১-০৬ এই পাঁচ বছরে রাজ্যে আভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির হার থেকেছে ৭.৩ শতাংশ, যা ছিল জাতীয় হার (৬.৭%)  থেকে বেশি।

অর্থনৈতিক উন্নতির ফলেই ২০১০-১১ সালেই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে শিল্পপণ্যের বাজার ছিল প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকার। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে।

★ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য :-

১৯৭১ সালে রাজ্যে সাক্ষরতার হার ছিল ৩৮.৮৬ শতাংশ। ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭ শতাংশ। সর্বভারতীয় হারের চেয়ে তা অনেক বেশি।

বিকেন্দ্রীভবণ ভাবনা থেকে মানব সম্পদ উন্নয়নের ভাবনা আসে। বামফ্রন্ট সরকার  শিক্ষাকে অনুৎপাদক খাতে ব্যয় মনে করেনি।

স্কুল শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষায় সুস্থ স্বাভাবিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার  সুযোগ সম্প্রসারিত করা এবং গুণমান বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছিল  বামফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে।

সবচেয়ে সাফল্য এসেছিল প্রাথমিক শিক্ষায়। রাজ্যে  ছয় থেকে দশ বছর বয়সী শিশুদের ৯৯.৬ শতাংশকে স্কুলে আনা গিয়েছিল। মিড ডে মিলের আওতায় আনা গিয়েছিল ৯৬% শিশুকে। স্কুলছুটের সংখ্যাও দ্রুতহারে কমে আসছিল।  প্রাথমিক স্তরে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ১.৮ শতাংশ। উচ্চ প্রাথমিক স্তরে ৫.৪ শতাংশ।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরেও শিক্ষার সুযোগ বেড়েছিল নজিরবিহীনভাবে। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল  ২ লক্ষেরও কম ছাত্রছাত্রী। ২০১১ সালে সাড়ে ১০ লক্ষের মতো। মেয়েরা পরীক্ষা দিয়েছে ছেলেদের চেয়ে বেশি সংখ্যায়।

মাদ্রাসা শিক্ষকদের সরকারী তহবিল থেকে বেতন, পেনশনের ব্যবস্থা, উন্নততর বেতন, পাঠক্রমের আধুনিকীকরণ, মাদ্রাসার সংশাপত্রকে বিদ্যালয় শিক্ষার সমতুল্য ঘোষণা – এসব কাজ গোটা দেশের প্রশংসা পেয়েছে।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও সাফল্য নজরকাড়া ছিল।

বামফ্রন্ট  সরকারের নিরন্তর প্রচেষ্টায় কেন্দ্রীয় সরকার ২০০৬ সালে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’ এবং ২০০৯ সালে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বায়োমেডিক্যাল জেনোমিক্স’ এবং ২০১০ সালে মুর্শিদাবাদে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস চালু করে।

বামফ্রন্ট সরকারে উদ্যোগেই পশ্চিমবঙ্গে ১৪টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। চালু হয়েছিল একটি ডিমড বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০-র বেশি নতুন কলেজ। শুধুমাত্র সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের আমলে  ৭৩টি নতুন ডিগ্রি কলেজ রাজ্যে চালু হয়েছিল। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উচ্চগবেষণার সুযোগ আজ যা দেখা যায় তার প্রায় পুরোটাই বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠেছে। উচ্চশিক্ষায় সংখ্যালঘুদের আরও বেশি উৎসাহিত করতে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেছিল বামফ্রন্ট সরকার।

এরাজ্যে ১৯৭৬-৭৭ সালে ২ লক্ষেরও কম ছাত্র-ছাত্রী উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেত। ২০১১ সালে রাজ্য সরকারের উচ্চশিক্ষা দপ্তরের অধীনস্থ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্টানে ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে দশ লক্ষ।

নয়া উদারবাদী নীতি যখন স্বাস্থ্যকে মুনাফার উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র মনে করেছে, তখন যতটা সম্ভব সরকারের উদ্যোগে কাজ হয়েছে। ১৯৭৭ সালে  পশ্চিমবঙ্গে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ১৩২৬। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১২ হাজার। এইসব গ্রাম শহরের স্বাস্থ্য কেন্দ্রই এলাকায় এলাকায় কোভিড পরীক্ষা, ভ্যাকসিনেসন এর স্থান। নতুন কিছু দেখা যাচ্ছে না। হাসপাতাল প্রাথমিক কেন্দ্র কাছাকাছি থাকার ফলে গড় আয়ু, জন্মহার, মৃত্যুহার, প্রসূতি মৃত্যুর হার এবং শিশু মৃত্যুর হার অনেক কমেছে। পশ্চিমবঙ্গ জাতীয় হারের চেয়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। গড় আয়ু জাতীয় ক্ষেত্রে পুরুষ ৬৫.৮ বছর ও মহিলা ৬৮.১ বছর। পশ্চিমবঙ্গে পুরুষের ক্ষেত্র গড় আয়ু ৬৮.২৫ বছর, মহিলাদের ক্ষেত্রে ৭০.৯ বছর। জন্মহার জাতীয় স্তরে প্রতি হাজারে ২২.৮। এরাজ্যে ১৭.৫। শহরাঞ্চলে জন্মহারের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সবার আগে — ১২.৪। জাতীয় হার ১৮.৫। মৃত্যুহার জাতীয় স্তরে প্রতি হাজারে  ৭.৪।

প্রসূতি মৃত্যুর হার জাতীয় স্তরে প্রতি লক্ষে ২৫৪ জন; পশ্চিমবঙ্গে ১৪১ ।

সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে রোগনির্ণয় কেন্দ্র চালু করে একদিকে গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষকে কিছুটা সুরাহা দেওয়া গিয়েছিল, অন্যদিকে বেসরকারী ক্ষেত্রেও খরচের উপর পরোক্ষে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হয়েছিল।

★ সুস্থ  সংস্কৃতির পরিবেশ নির্মাণ :-

সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বহুত্ব ও বৈচিত্র্য বিকশিত করতে অভূতপূর্ব ভূমিকা  পালন করেছে বামফ্রন্ট সরকার। । লোকসংস্কৃতির চর্চা থেকে শুরু করে  চলচ্চিত্র চর্চা, সাহিত্য চর্চার সুস্থ ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা গিয়েছিল। লিটল ম্যাগাজিনকে উৎসাহিত করতে উদ্যোগ নিয়েছিল রাজ্য সরকার। বাংলা অকাদেমী, হিন্দি অকাদেমি, উর্দু অকাদেমি, সাঁওতালি একাদেমি, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র (২০১০ সালে উত্তরবঙ্গেও শাখা গঠিত হয়)—সবই বামফ্রন্ট সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠা। ভূমিসংস্কার, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ও শিক্ষার প্রসারের ফলে গ্রামাঞ্চলে নতুন নতুন অংশের মানুষ নতুন অধিকারবোধ নিয়ে সংস্কৃতি চর্চার অঙ্গনে উঠে এসেছিলেন। তার জন্য যতটা সম্ভব উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিকাঠামোর তৈরির কাজে বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য নজিরবিহীন।

★ কর্মসংস্থান:-

হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসে ন’শোর বেশি অনুসারী শিল্পেই দু’লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল। তথ্যপ্রযুক্তিতেও  কাজের সুযোগ বেড়েছিল নানা স্তরে। সিঙ্গুরেও মূল কারখানার পাশাপাশি যন্ত্রাংশ তৈরির কয়েকশো কারখানায় বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বামফ্রন্ট সরকারের কাছে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বৈষম্যকারী লাইসেন্স প্রথা যখন বড় ও মাঝারি শিল্প স্থাপনে বাধা তখন ক্ষুদ্র শিল্পে বামফ্রন্ট সরকার  জোর দিয়েছে। ক্ষুদ্র শিল্পে সংখ্যার বিচারে ও কর্মসংস্থানের বিচারে পশ্চিমবঙ্গই ছিল দেশের সেরা। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে রাজ্যে প্রায় ২৮ লক্ষ ক্ষুদ্র শিল্প ইউনিটে কর্মসংস্থান হয়েছিল প্রায় ৫৫ লক্ষ মানুষের। উপকৃত মানুষের সংখ্যা আরও কয়েকগুন বেশি। কিন্তু বড় ও মাঝারি শিল্প না এলে ক্ষুদ্রশিল্পের বিকাশ থমকে যেতে এবং পিছু হঠতে বাধ্য। তাই শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকার  কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে বামফ্রন্ট সরকার বৃহৎ শিল্প প্রসারে গুরুত্ব দেয়।

আন্তরিকতার সঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার দাঁড়িয়েছিল স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির পাশে। পশ্চিমবঙ্গে ২০০৬ সালে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ৮০ হাজার। ২০১১ সালে এই সংখ্যা লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১৫ লক্ষে। সদস্য সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লক্ষের উপর; যাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই মহিলা। দলগুলির সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। আয়ের সংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে ব্যাঙ্ক ঋণে সুদের উপর ভরতুকি দিত। গোষ্ঠীগুলিকে সুদ দিতে হত মাত্র ৪ শতাংশ। কারণ, বাকি ৭ শতাংশ সুদের টাকা ভরতুকি হিসেবে দিত রাজ্য সরকার। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে ধান চাল সংগ্রহের এজেন্ট হিসেবে যুক্ত করার ব্যবস্থা ছিল দেশের সামনে নতুন নজির। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার রাজ্য সরকারে পৃথক একটি দপ্তর চালু করেছিল – স্বয়ম্ভর ও স্বনিযুক্তি প্রকল্প দপ্তর।

কেন্দ্রীয় সরকারী স্বনিযুক্তি প্রকল্পতে দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ উঠে আসে এক নম্বরে। ‘প্রাইম মিনিস্টারস এমপ্লয়মেন্ট জেনারেশন প্রোগ্রাম’ – কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প। সবচেয়ে ভালো কাজ করেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

বামফ্রন্ট সরকার শুধু রাজ্য সরকারী কর্মচারী নয়,স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা,বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী, পৌরসভা, পঞ্চায়েত, সমবায় প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের বেতন, পেনশন, পারিবারিক পেনশন, কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, মাদ্রাসা, বিদ্যালয় প্রভৃতিতে নিয়মিত নিয়োগের প্রক্রিয়া জারি ছিল। বেতন, পেনশন, মহার্ঘভাতাতেও রাজ্য সরকার কখনই ছাঁটাই করেনি।

★ বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলা:-

কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ালেও বামফ্রন্ট সরকার গরীব নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য ভর্তুকি দিয়েছে। ২০১০ সালের জুলাইয়ে রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিদ্যুতের দাম বাড়ালে ১২০ কোটি টাকা ভরতুকি দিয়েছিল রাজ্য সরকার। ফলে ২০ লক্ষ গ্রাহকের ক্ষেত্রে মাশুল আগের চেয়ে কমে যায়।

★ বাজার:-

২০০৯-১০ সালে অধিক ফলনে ক্ষতিগ্রস্ত আলুচাষীদের বাঁচাতে ৪০০ কোটি টাকা ভরতুকি দেয় রাজ্য সরকার। যাতে আলুর দামের অনিশ্চয়তায় কৃষক মার না খান।

পেট্রোল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির আঁচ সাধারণ মানুষের উপর যতটা সম্ভব কম যাতে লাগে সেজন্য রাজ্য সরকার নিজের তহবিল থেকে  ভরতুকি পর্যন্ত দিয়েছিল।

বিশ্বমন্দার পরিপ্রেক্ষিতে খোলা বাজারের বর্ধিত আঘাত থেকে সাধারণ মাগনুষকে বাঁচাতে  ২০০৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ৫১০৬ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। যার মূল্য লক্ষ্য ছিল পিছিয়ে পড়া মানুষের সুরাহা।

নয়া উদারবাদী কেন্দ্রীয় নীতির ফলস্বরূপ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের উপর  মূল্যবৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান চাপ প্রশমনের কোনো পরিকল্পনাই  কেন্দ্রীয় সরকার নেয় নি। বামফ্রন্ট সরকার  কর ধার্য করার ক্ষেত্রে চাপে থাকা সাধারণ মানুষকে যতটা সম্ভব রেহাই দেওঞয়ার চেষ্টা করেছিল।

★ অসংগঠিত শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষা:-

বামফ্রন্ট সরকার যেভাবে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এরাজ্যে তা কংগ্রেসী আমলে ছিল অকল্পনীয়।  বামফ্রন্ট সরকার অনেক আগে থাকতেই প্রতিবন্ধী ভাতা (শুরু ১৯৮০সাল), বার্ধক্য ভাতা (শুরু ১৯৭৯ সালে), আদিবাসী বার্ধক্যভাতা (একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে দেওয়া হতো), কৃষক ভাতা, বিধবা ভাতা – এরকম যে কটি ভাতা রাজ্য সরকার দিত সেগুলির টাকার পরমাণও বাড়ানো হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে উপভোক্তার সংখ্যাও।ম

১৯৯০-র দশকে যখন জাতীয় স্তরে নয়া উদারবাদী নীতির আগ্রাসী রূপ সাধারণ মানুষের উপর দ্রুত চাপ বাড়াচ্ছিল। তখন  সীমিত আর্থিক ক্ষমতার মধ্যেও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিতে বাড়তি জোর দেওয়া হয়।লক্ষ লক্ষ মানুষকে এইসব সামাজিক সুরক্ষামূলক প্রকল্পগুলির আওতায় কিছুটা হলেও নিরাপত্তা দেওয়া গেছে।

ভূমিহীন কৃষকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড প্রকল্প শুরু করেছিল বামফ্রন্ট সরকারই। দেশে এর কোনো পূর্বনজির ছিল না। ১৯৯৮ সালে রাজ্যের বন্ধ কলকারখানা ও বন্ধ চা-বাগানের শ্রমিকদের মাসকাবারি আর্থিক সাহায্য দেবার একটি প্রকল্প চালু করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। রাজ্যে এরকম প্রকল্পের কোনো পূর্বনজির ছিল না।

দেশের মধ্যে প্রথম পশ্চিমবঙ্গেই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড প্রকল্প (সাসপফাউ) চালু করেছিল বামফ্রন্ট সরকার।  পরিবহন শ্রমিকদের জন্য পেনশন ও অন্যান্য সুরক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছিল সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার। প্রায় ২৫ লক্ষ পরিবহন শ্রমিকের জন্য রাজ্য সরকার নিজের উদ্যোগ। বিড়ি শ্রমিকদের জন্য চালু করা হয়েছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ বিড়ি শ্রমিক কল্যাণ প্রকল্প’। কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবীমা প্রকল্পেও শ্রমিকদের দেয় বাবদ অর্থ দিয়ে দিত রাজ্য সরকার। সংশ্লিষ্ট শ্রমিককে দিতে হতো না। নির্মান কর্মীদের জন্যও পেনশন, পারিবারিক পেনশন, গৃহনির্মানে সাহায্যের মতো একগুচ্ছ কল্যাণ মূলক প্রকল্প চালু করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। গঠন করা হয়েছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ ভবন ও অন্যান্য নির্মাণ কর্মী কল্যাণ পর্ষদ’। বামফ্রন্ট সরকার ২ কোটি ৬৪ লক্ষ গরিব মানুষকে ১টাকা কোজি দরে চাল দিত। শুধু বি পি এল নয়, এ পি এল-র দরিদ্র মানুষেরও এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে।  সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ‘‘শহরাঞ্চলের হকার সংক্রান্ত নীতি’’ (অক্টোবর ২০১০) গৃহীত হয়েছিল। হকারদের আইনী স্বীকৃতি দেওয়া ও  হকারদের স্বার্থরক্ষায়  অভূতপূর্ব পদক্ষেপ।

★ বাসস্থান:-

আবাস যোজনায় গরীব মানুষের জন্য পাকাবাড়ি এবং পারিবারিক শৌচাগার নির্মান প্রকল্পে বামফ্রন্ট সরকার ধারাবাহিক গুরুত্ব দিয়েছে। আবাসন দপ্তর ২০০৯ সালে দরিদ্রদের জন্য ‘আমার বাড়ি’  প্রকল্প গ্রহণ করে। বস্তির উন্নয়নে এবং বস্তির মানুষের জন্য নতুন বাড়ি তৈরির জন্য অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করেছিল নগর উন্নয়ন দপ্তর। কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট (২০১০) অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলে গরিবের জন্য বাড়ি তৈরিতে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে প্রথম তিনটি রাজ্যের মধ্যে স্থান করে নেয়। সংখ্যালঘু গরিব মানুষের জন্য বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে তখন রাজ্য ছিল দ্বিতীয় স্থানে। বামফ্রন্ট সরকারই ‘ও বি সি’-দের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছিল। সংরক্ষণের সুযোগ প্রসারিত করেছিল। গরিব মুসলিম জনগোষ্ঠীদেরও ‘ও বি সি’ হিসেবে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে এসেছিল। এক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারই দেশে পথিকৃৎ।

★ উদারনীতি ঘোষনার পর :-

কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯১ সালে নয়া উদারনীতি ঘোষণার পর সার্বিকভাবে পরিস্থিতি বিচার করে বামফ্রন্ট সরকার নতুন পরিকল্পনা তৈরি করে। ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরের ২৩ সেপ্টেম্বর রাজ্য সরকারের ‘শিল্পায়ন সংক্রান্ত নীতি বিবৃতি’ ঘোষিত হয়। ১৯৯১ থেকে ২০০৮-এর মধ্যবর্তী সময়ে শিল্প বিনিয়োগের পরিমাণের প্রশ্নে এই রাজ্য উঠে আসে দেশের মধ্যে তিন নম্বর স্থানে। বিনিয়োগ  আসে পেট্রোকেমিক্যালস, তথ্য প্রযুক্তি, লৌহ ও ইস্পাত, ম্যানুফ্যাকচারিং, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের মতো মতো ক্ষেত্রগুলিতে। ২০০৫ সালে রাজ্যে বিনিয়োগ এসেছিল ২৫১৫.৫৮ কোটি টাকা। ২০০৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০৭২.২৬ কোটি টাকা। ২০০৮ সালে মন্দার বছরেও ৪৪৩৪.৫০ কোটি টাকা। ২০১০ সালে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছিল ১৫হাজার ৫২ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা।

★ নগরোন্নয়ন:-

পরিকল্পিত নগরোন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় শিলিগুড়ি, দুর্গাপুর, আসানসোল শিল্পাঞ্চল, খড়গপুর প্রভৃতি অঞ্চলে। নতুন বিমান বন্দর তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয় অন্ডালে।

কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ক ও যুক্তরাষ্ট্রিয় কাঠামো  রক্ষার লড়াই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থবরাদ্দের মূল দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। ন্যায্য কারণেই বামফ্রন্ট সরকার দাবি করেছিল, রাজ্য থেকে সংগৃহীত সম্পদের অন্তত ৫০ শতাংশ  রাজ্যের হাতে তুলে দেওয়া হোক। কেন্দ্র শোনে নি। তা সত্ত্বেও বামফ্রন্ট সরকার সম্পদ সংগ্রহের প্রশ্নে সবসময় দরিদ্রতর মানুষকে রেহাই দিতে চেষ্টা করেছে এবং এই অংশের মানুষের প্রয়োজনের কথা বিবেচনায় রেখেই সম্পদের সিংহভাগ বরাদ্দ করেছে।  সম্পদ বন্টনের সিংহভাগ বরাদ্দ করা হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় উন্নয়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো ক্ষেত্রগুলিতে। পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে। কোষাগারের উপর বাড়তি চাপ সহ্য করেছে রাজ্য সরকার। জিএসটির পরিকল্পনাও ছিল অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের। যা এখন রাজ্যগুলির নিজস্ব আয় বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। ফলে এখন রাজ্য সরকার গুলো নানাভাবে  সাইকেল, সরাসরি টাকা ইত্যাদি দিতে সক্ষম হচ্ছে।

শিল্প হলে যেমন ছিল কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রসারিত হয়, তেমনই রাজ্য সরকারের সম্পদ সংগ্রহের সুযোগ বাড়ে। সংগৃহীত বাড়তি অর্থ তখন জনকল্যাণে বরাদ্দ করা যায়। শিল্পায়নে বাধা দিলে রাজ্য সরকারের সম্পদ সংগ্রহের সুযোগকেও বাধা দেওয়া হয়।

এই সময়কালের বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যা যা কেন্দ্রীয় ভাবে তৈরি হচ্ছিল এবং গত পাঁচ ছয় বছরে ক্রমশ তা সাধারন গরীব মানুষের ব্যক্তি পরিচিতি ও অস্তিত্ব রক্ষার  কৃত্রিম  সংকট নির্মিত হয়েছে, সেই সময়কে প্রতিহত করে পশ্চিমবঙ্গের মত দেশভাগসময়কালের বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যা যা কেন্দ্রীয় ভাবে তৈরি হচ্ছিল এবং গত পাঁচ ছয় বছরে ক্রমশ তা সাধারন গরীব মানুষের ব্যক্তি পরিচিতি ও অস্তিত্ব রক্ষার  কৃত্রিম  সংকট নির্মিত হয়েছে, সেই সময়কে প্রতিহত করে পশ্চিমবঙ্গের মত দেশভাগ পীড়িত রাজ্যে বামপন্থীদের নির্বাচনী সাফল্য হয় নি। কিন্তু বামপন্থার প্রভাব ও দৈনন্দিন জীবনে প্রগতিশীল  সাংস্কৃতিক ভাবনার প্রকাশ বজায় থাকবে। সাম্প্রদায়িক চিন্তার বিকাশের যায়গা নেই।  বাংলার নবজাগরণের হাত ধরে বামফ্রন্ট সরকারের কর্মসুচী পর্যন্ত  অনেক দোষ ত্রুটির মধ্যেও এক উদাহরণ যোগ্য মানবোন্নয়নের সন্ধান দেবে।

গণতন্ত্রের লক্ষ্য যেখানে দেশের অতি সাধারণ ও দরিদ্রতম মানুষের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্পণ, পঞ্চায়েতরাজ-ব্যবস্থা সেখানে সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর বাস্তব ভিত্তি। এর সার্থকতা ও সফলতার ওপরই দেশের ভবিষ্যৎ। সত্যিকারের গণতন্ত্রের প্রাণস্পন্দন। এতে আছে সমগ্র জাতির এক মহৎ সংকল্পে অনুপ্রাণিত হওয়ার শর্ত, আছে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হয়ে দেশ গঠনের ব্রত, আছে সুষ্ঠু জীবন-বিকাশের উদার ক্ষেত্র-রচনা। এতে যেমন হবে গ্রাম-জীবনের শিক্ষা, স্বাস্থ্যের পুনরুজ্জীবন, তেমনি হবে গ্রামীণ সংস্কৃতি-অর্থনীতির পুনরুদ্ধার। পঞ্চায়েতরাজই বর্তমানে সকলের অধিকার-প্রতিষ্ঠার, স্ব-নির্ভরতার, আত্ম-নিয়ন্ত্রণের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।

তাই আসন্ন ত্রিস্তর দশম পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানুষের কথা বলার অধিকার ফিরিয়ে দিন।

একটা মন প্রস্তুত করি চলুন ১০ টা লুম্পেন’কে বুঝে নেবার। একটা মন অনেক মন’কে শত্রু চিনিয়ে দেবার দক্ষতায় পথ চলুক নিরলস।  একটা মন ধারালো হোক পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তনের উপযুক্ততায়। একটা মন অনেকটা জায়গা নিক যাতে তার পাশে আরো একশো মন বেঁধে বেঁধে থাকতে পারে।

একটা একটা মন দিয়ে এক এবং একমাত্র প্রতিরোধের শপথ হোক।

 অনেক মন খেলা ঘোরানোর দম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুক।

 বাম পথে গ্রাম ফিরুক চেনা ছন্দেই।