আগে থেকেই খবর দিয়ে কয়েকদিন পর নাজেম চাচার গ্রামে গেলাম। ডাকাডাকির পর অনেকেই এলেন। শুরু হল অতীতের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা এবং বামফ্রন্ট সরকার কিভাবে গ্রামের জীবন যাপন সহ সার্বিক পরিকাঠামো গড়ে তুলল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা, মজুরি, জমি,সেচ, বিদ্যুৎ,ক্ষুদ্র শিল্প –নানান বিযয়ে গ্রামের অর্থনীতির দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকলো। শংকর রায় বয়সের ভারে ন্যুব্জ কুব্জ। তিনি অতীতের কিছু কথা শোনালেন।তার সারমর্ম হলো,১৯৯০ –৯১ সালে তাঁর গ্রামের ছেলে ও মেয়েরা হেঁটে স্কুলে যেত।১৯৯৯ -২০০০ সাল থেকে স্কুলের ছেলেমেয়েরা সাইকেলে চড়ে স্কুলে যেতে শুরু করল। তার কিছুদিন আগে বামফ্রন্ট সরকার গরীব ছাত্র ছাত্রীদের সাইকেল দেওয়া প্রথম শুরু করে। ২০০৩ সালের পর থেকে স্কুলে সাইকেলে আসা বেড়ে গেল। ২০১০ সাল নাগাদ সব স্কুলে সাইকেল রাখার জন্য গ্যারেজ করতে হল। এখন আর কেউ হেঁটে স্কুলে যেতে চায় না। ক্ষেত-মজুরদের মজুরি বৃদ্ধি, জমির আন্দোলন, কৃষিতে সেচের প্রসার ,পঞ্চায়েতের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ, যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, এই সব কারনে গ্রামের মানুষের হাতে টাকা পয়সা এলো, কেনার ক্ষমতা বাড়লো। ফলে গ্রামের অর্থনীতির  আমূল পরিবর্তন হতে শুরু করল। আমাদের গ্রামের সব গরীব পাড়ায় আগের অবস্থা আর এখনকার অবস্থা আমুল পরিবর্তন ঘটে গেছে। বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন প্রায় সব পাড়াতেই বিদ্যুৎ হয়ে গেছে। এখন ঘরে ঘরে টিভি,মোটর বাইক, মোবাইল ফোন, অনুষ্ঠান বাড়ী ও পাড়ায় পাল পার্বনে জাঁকজমকের ঘনঘটা, পোশাকের পরিবর্তন, আচার ব্যবহারের পরিবর্তন এ সবই ঘটে গেছে বামফ্রন্ট সরকারের নীতির ফলে । এই সময় শিল্প-সামগ্রী কেনার চাহিদা বেড়ে যায় ফলে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকার শিল্প সামগ্রী বিকিকিনি হত। সেই সময় কে একজন বলে উঠল, সেই জন্যই তো সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানির মোটর গাড়ীর কারখানা শুরু হল। আর ঐ মমতা ব্যানার্জি তার দলবল নিয়ে সব বন্ধ করে দিল। আমাদের ঘরের ছেলে মেয়েরা সব লেখাপড়া শিখে বসে আছে। কোন চাকরি বাকরি নাই। সেই সময় সামেদভাই একপ্রকার জোর করেই বলতে শুরু করলেন, চাকরি বাকরি থাকবে কি করে! দুটি সরকারএখন সব বিক্রি করে দিচ্ছে। নতুন করে কলকারখানা আর হচ্ছে না। যেগুলো ছিল সেগুলোও বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। দুটো সরকারকেই হটাতে হবে। তবেই আমরা বাঁচতে পারব।এই সময় আমি সকলের উদ্দেশ্যে বললাম আমাকে এবার বলার সুযোগ দিতে হবে। সকলেই বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি বলুন।আমার কাছে কিছু তথ্য ছিল সেগুলো পড়ব বললাম। সকলেই রাজি হল। আমি বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্যগুলো পড়তে শুরু করলাম।** বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ১১,২৭৭লক্ষ একর জমি পেয়েছে ভূমিহীনরা। ২০১০ এর হিসেবে দেখা যাচ্ছে কৃষির বিকাশে সাফল্য–” ধান –১৪৮ লক্ষ মেট্রিক টন, পাট-৭৮৭২.৬ মেট্রিক টন, সবজি ১১৯ লক্ষ মেট্রিক টন।উৎপাদনে দেশের প্রথম স্থানে পশ্চিমবঙ্গ।”১৯৯২–৯৩ সালে শস্য চাষের নিবিড়তা ছিল ১৫৫ শতাংশ, বামফ্রন্ট সরকারের শেষ বছরে তা হয় ১৯২ শতাংশ। ১৯৭৬–৭৭ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন হতো ৭৪ লক্ষ টন। ২০১০ সালে তা হয় ১৭০ লক্ষ টন। চাল উৎপাদনে দেশের মধ্যে প্রথম স্থান পায় পশ্চিমবঙ্গ। ১৯৭৭–৭৮ সালে রাজ্যে সেচন ক্ষমতাযুক্ত জমির অনুপাত ছিল ৩২ শতাংশ, ২০১০–১১ সালে সেটা ৭২ শতাংশে চলে যায়। তখন একজন বললেন ভূমি সংস্কারের ফলে সরকারি সাহায্যে উৎপাদন অনেক বেড়ে গিয়েছিল। আমি আবার বলতে শুরু করলাম, জমি চোরেরা যে জমি লুকিয়ে রেখেছে তা আর ভূমিহীনদের মধ্যে দেওয়া যাবে না।তৃণমূল কংগ্রেস সরকারে আসার পর তা সার্কুলার দিয়ে ও আইন করে বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর পাট্টা প্রাপ্ত জমি জমিদারের পক্ষ হয়ে তৃণমূল কংগ্রেস কিছু কিছু জায়গায় কেড়ে নিয়েছে। সেই সময় জগন্নাথ বলল,২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের কিছুদিন পর পাশের অঞ্চলে ৫০ বিঘা খাস জমি ১৫০ জন ভূমিহীনদের পাট্টা দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। সেই জমি রেকর্ডও হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও তাদেরকে উচ্ছেদ করে দিয়ে মালিকপক্ষ দখল করে চাষ করছিল। পাট্টাদারদের পক্ষ থেকে মামলা করার পর জমি এখন পড়ে আছে। তৃণমূল কংগ্রেস জোতদারদের দালাল।  আমি তাকে থামিয়ে আবার শুরু করলাম। ২০১১ সালের ১৮ ই অক্টোবর “মা -মাটি মানুষের” সরকার একটি সার্কুলার জারি করে।তাতে বলা হয়, “ভূমিহীনদের মধ্যে মূলত কৃষি জমি বন্টন যে ধারায় আগে ভূমি সংস্কার চলেছে, তা থেকে এবার সরে আসতে হবে।” পশ্চিমবঙ্গ ভূমি সংস্কার (সংশোধনী) বিল ২০১২ ,পশ্চিমবঙ্গ ভূমি সংস্কার (সংশোধনী) বিল ২০১৩, পশ্চিমবঙ্গ ভূমি সংস্কার আইন (১৯৫৫)সংশোধনী বিল পাস করানো হয় ২০১৪ সালে। এখন আর সিলিং বহির্ভূত জমি নতুন করে খাস হচ্ছে না( এক নম্বর খতিয়ান)। নতুন করে ভূমিহীনদের পাট্টাও দেওয়া হচ্ছে না। বামফ্রন্টের আমলে যে জমি দেওয়া হয়েছিল সেগুলিই কিছু কিছু এখন পাট্টা দেওয়া হয়েছে।এই সময় নাজেম চাচা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের জমিগুলো কি হবে? আমরা কি পাট্টা পাব না ? আমি বললাম, তুমি ঠিক প্রশ্ন করেছো। ঐ জমি তোমরা যেমন দখল করছো, ঐভাবেই দখলে রেখে চাষ করে যাও। আসলে ভূস্বামী দের সংগঠন সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে রেখেছে, ফলে কয়েক হাজার একর জমি পাট্টা দেওয়া বন্ধ আছে জানিয়ে, শিক্ষার অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য আমার কাছে যা ছিল সেগুলো পড়তে শুরু করি। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার পড়ুয়াদের হার ৯৯.২৫ শতাংশ, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৯৫৪ টি মাদ্রাসা ৫৮১ টি, ডিগ্রী কলেজের সংখ্যা ৪২৯,১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়, আই টি আই এর সংখ্যা ৮৯ টি, পলিটেকনিক এর সংখ্যা ৫৭ টি, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলির সংখ্যা ৪০০০ এর কাছাকাছি।  শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য শিশু শিক্ষা কেন্দ্র, মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র চালু করা হয়েছিল। এই সময় একজন বলে উঠলো, এ বছর তো মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে।এ কথা বলতেই আমার কাছে থাকা তথ্য জানানোর সুযোগ পেলাম। তাহলে শোন –“১৯৭৭সালে সাড়ে তিন লক্ষ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী ছিল। ২০১১ সালে বেড়ে হয় সাড়ে ১০ লক্ষ। আর এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে 6 লক্ষ। এই তথ্য বলার পর আর একজন বলে উঠল, শিশু শিক্ষা কেন্দ্র, মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র গুলোর অবস্থা শোচনীয়।শিক্ষা এখন লাটে উঠেছে। হঠাৎ কালিপদ বলে এক কৃষক কর্মী এবছর আলুর কি হবে জানতে চাইল। আমি বললাম আন্দোলন করতে হবে।তবে বামফ্রন্ট সরকার কৃষককে যে হারে ভর্তুকি দিত এই সরকার তা দেয় না। কালিপদ বলতে থাকে, চাষের খরচ বেরেছে,সারের দাম দ্বিগুণ, আবার মিনি মালিক জলের দাম বাড়িয়েছে, বলছে বিদ্যুৎএর দাম বেড়েছে, সেজন্য জলের দাম আমাকেও বাড়াতে হয়েছে। তখনই বিদ্যুৎ সম্পর্কে আমার জানা তথ্য বললাম। তা হল এই — বামফ্রন্ট আমলের শেষ বছরে ২০১০-১১ বর্ষে কৃষিতে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ভর্তুকি দেওয়া হতো ৫৬৮ কোটি টাকা। এরা এসে ভর্তুকি কমাতে শুরু করে। ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪ সালে কমে হয়েছে ৪৫৯ কোটি, ২৫২ কোটি ,৩৫৭ কোটি টাকা। কৃষি গ্রাহকদের হোল –ডে মিটারে বামফ্রন্টের শেষ বছরে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম ছিল ২ টাকা ৭৩ পয়সা। মমতা ব্যানার্জির আমলে তার ৭৪ শতাংশ বেড়ে ২০১৯ এ তে হয়েছে ৪ টাকা ৭৫ পয়সা। ঘরে বিদ্যুতের দাম যেমন বেড়েছে তেমনি কৃষিতেও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। ২০১০–১১ সালে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের গড় দাম ছিল ৪ টাকা ৫২ পয়সা।, এটা বেড়েছে বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরে।আর এদের রাজত্বে দাম হয়েছে ৭ টাকা ১২ পয়সা প্রতি ইউনিট। ওনার অনুপ্রেরণায় এই সব হচ্ছে বলে একজন ফুট কেটে মন্তব্য করলেন, এই সব কারনেই কৃষি অর্থনীতি ক্রমশঃ খারাপের দিকে যাচ্ছে। তুমি ঠিক কথাই বলেছো বলে আমি বললাম, শোন – তথ্য কি –” পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ফলিত অর্থনীতি ও পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্যে দেখা যাচ্ছে ,২০০৬ –৭ সালে মোট আয়ের ১৭.২২ শতাংশ আসতো কৃষি থেকে। ২০১৪–১৫ সালে সেটা দাঁড়িয়েছে ১২ শতাংশে।এই তথ্য জানানোর পর বয়স্কদের কয়েকজন প্রস্তাব দিলেন, এখনকার ছেলেমেয়েদের অতীতের আন্দোলনের কথা শোনাতে হবে। না হলে গরীবদের সমূহ বিপদ।আট আনা –এক টাকা মজুরি বাড়াতে আমাদের কত কান্ড করতে হয়েছে। এখনতো আর মজুরি বাড়ছে না। অনেক লড়াইয়ের পর সকাল বিকাল কাজ হচ্ছে। এখন দরকার এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সাথে এই সব বিষয়ে আলোচনা করা।তাই হবে বলে সভা শেষ করা হল। শ্লোগান দিতে বললাম।আওয়াজ উঠল–বিকল্পের জন্য লড়তে হবে, সংগ্রাম কর ,সংহত কর,  এগিয়ে চল ,জয় আমাদের হবেই হবে।

[তথ্য সংগৃহীত]