আগের দিনের নাজেম চাচা ও মোহনদার সাথে কথা অনুযায়ী পদযাত্রার প্রস্তুতি কেমন হচ্ছে তার খোঁজ খবর নিতে পদযাত্রার আগের দিন ওদের গ্রামে গেলাম। গিয়ে দেখি তোরজোড় ভালো। কয়েকজন যুবক তার মধ্যে সবুর ও  দু -চারজন যুবক আছে। তারা ঝান্ডা ও পোস্টার ঠিক করছে। নাজেম চাচা ও মোহনদা কোথায়, জিজ্ঞেস করায় সবুর বলে ,তারা কালেকশন করতে বেরিয়েছে। তাদের অপেক্ষায় কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর দুজনেই চলে এলেন। দেখলাম চ্যাঙারি আর থলে। আমি বলার আগেই নাজেম চাচা বলতে শুরু করল,”সকাল থেকে আটটা বুথ ঘোরা হবে,না খাওয়ালে হয় , সেজন্য চাল, আলু ঘরে ঘরে তুলতে বেরিয়েছিলাম। অনেকেই কিছু কেমন টাকাও দিয়েছে। খাওয়ানো হয়ে যাবে। কাল সকাল সকাল চলে আসবেন। জিজ্ঞেস করলাম কোথায় খাওয়ানো হবে। মোহনদা বলল ,শিবতলায় শেষ হবে –ওখানেই খাওয়ানো হবে।বেশ তাই হোক বলে চলে এলাম। পরদিন ১০।০১।২৩ তারিখে আমরা কয়েকজন নেতৃত্ব নাজেম চাচার গ্রামে সকালে চলে এলাম। উল্লেখ্য এই গ্রামেই খাস জমি দখল করার লড়াইয়ে ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে জোতদারদের গুন্ডাবাহিনীর হাতে মালতী রায় মহিলা কর্মী খুন হয়েছিলেন।তখন এই গ্রামের যা অবস্থা ছিল আর এখন এই গ্রামের অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে।যাক লোকজন জমছে।যদিও অন্যান্য পদযাত্রার তুলনায় কম।যা জুটেছে তাই নিয়েই বেলা দশটা নাগাদ পদযাত্রা শুরু হল।ভয়, ভীতি, আশংকার মধ্যে পদযাত্রা এগিয়ে চলেছে নির্দিষ্ট রুট দিয়ে। নাজেম চাচা কিছুটা হেঁটে মোটরবাইকে উঠে পড়ল। আমারও তাই। আমাদের কয়েকজন নেতৃত্ব সবটাই হাঁটলেন। পদযাত্রা শেষে খাওয়া দাওয়া শুরু হল। আমি সকলের উদ্দেশ্যে বললাম, খাওয়া দাওয়া সেরে গল্প করা হবে। সকলেই রাজি হয়ে গেল। নাজেম চাচা বলল,”আমার ডাইরির লেখাটা আবার কবে পড়া হবে। ” আমি বললাম,এবার তোমরা জড়ো হয়ে ছেলে মেয়ে দের শোনাবে। আমি একটা পুরোনো কাগজ এনেছি , সেটা গল্প করতে করতে পড়ে শোনাব।

সকলেই রাজি হয়ে গেল। যেহেতু খাওয়ানোর ব্যবস্থা ছিল সেই কারনে কিছু বাড়তি লোকজন হয়েছে।সকলে একসাথে খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে ,পুরনো দিনের কথা ও পুরানো কাগজ পড়া শুরু হল। নানান কথার মাঝে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা এই স্কুলের SC/ST হোস্টেলের খবর কি? হোস্টেল বন্ধ হয়ে গেছে। একজন বয়স্ক মানুষ বলতে শুরু করলেন, সরকার টাকা দিচ্ছে না। সবই বন্ধ হয়ে যাবে। উনি বললেন,২০০৭ সালে গোঘাটে SC/S T ছাত্রদের জন্য   মহকুমার কেন্দ্রীয় সিধু কানু ছাত্রাবাস উদ্বোধন হয়েছিল। মোট ৮০ টি  সিট।  ২০০৮ –০৯ সালে প্রায় ১০০ জন ভর্তি হয়। ২০১০ সাল পর্যন্ত ওইরকমই ছাত্র ভর্তি হয়েছিল। ২০১১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর ছাত্র কমতে শুরু করে। ২০২৩ এর জানুয়ারি মাসে ৩০ জনে এসে নেমেছে। এর থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, সারা রাজ্যে এস সি –এস টি হোস্টেলগুলির কি দুরবস্থা চলছে।আমাদের আমলে হোস্টেল গমগম করত।আর এখন বন্ধ। অথচ এই স্কুলের হোস্টেলে থেকেই আমার ছেলে লেখাপড়া শিখেছে।  ছেলে –মেয়েদের আর লেখা পড়া হবে না ,এই বলে বিরক্তি প্রকাশ করে ক্ষোভ উগড়ে দিলেন তারাপদ রায়। প্রায় ৭২–৭৩ বছর বয়স। বহুদিনের কর্মী। পদযাত্রাতেও হাঁটলেন। তারাপদ দা বলতে শুরু করলেন,ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হাতে চওড়াফোন আবার কি সব ট্যাব দিচ্ছে। বেশীরভাগ ছেলে মেয়ে বিকালে বেড়াতে বেরিয়ে রাস্তার ধারে,জমির আলে, খেলার মাঠে, সব গ্রুপ করে বসে ফোনে আঙ্গুল ঠিলছে। আজেবাজে ছবি দেখছে, পাপজি খেলছে, আরো সব কি করছে। আর গ্রামে নানান ঘটনা ঘটছে। আর এখনকার ছেলেরা  তো বিভিন্ন নেশায় বুঁদ হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে মদের ঠেক, গাঁজার ঠেক। আবার শোনা যাচ্ছে, রাজ্যে ব্যাপক মদের দোকান খোলার জন্য রাজ্য সরকার লাইসেন্স দিচ্ছে।লোকে বলছে,”দিদি,” দুয়ারে মদ” প্রকল্প চালু করছে। এই প্রজন্মের মেরুদন্ডটাকে ভেঙে দিচ্ছে ওই মহিলা। আমি সকলের উদ্দেশ্যে বললাম,”এই সব অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের এই সর্বনাশা পথ থেকে তো সরিয়ে আনতে হবে। “পথ কি? সকলেই বলে উঠলেন, আগের মত আন্দোলন করতে হবে। এবার থেকে আমরা সব বেরুবো। আর তোমাদেরকেও (নেতৃত্ব) আগে যেভাবে আসতে,এখন থেকে সেভাবেই আসতে হবে, ঘরে ঘরে ঘুরতে হবে। আমাদের এক নেতা কন্যাশ্রী বিষয়ে জানতে চাইলেন। আমি সুযোগ পেয়ে গেলাম। এ বিষয়ে আমার কাছে তথ্য আছে, আমি তাহলে কাগজটা পড়ছি বলে পড়া শুরু করলাম। বামফ্রন্ট সরকার দুস্থ ছাত্রীদের পড়াশোনার জন্য, “বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা”প্রকল্প চালু করে। এই প্রকল্পে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ৩০০ টাকা, চতুর্থ শ্রেণীতে ৫০০ টাকা, পঞ্চম শ্রেণীতে ৬০০ টাকা, ষষ্ঠ সপ্তম শ্রেণীতে ৭০০ টাকা, অষ্টম শ্রেণীতে ৮০০ টাকা ,নবম ও দশম শ্রেণীতে বার্ষিক ১০০০ টাকা সরকারি অনুদান পেতো। এটাই ছিল বাম আমলের “বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা “।সেই নামটাকে চাপা দিয়ে কন্যাশ্রী নাম দিয়ে চালাচ্ছে এই সরকার। আবার ছোট ছোট মেয়েরা স্কুলের পোশাক পেত।  বুক  গ্র্যান্ট ছিল ।সেই টাকায় পড়াশোনার যাবতীয় জিনিসপত্র কেনা যেত। প্রাথমিক ও জুনিয়র বেসিক স্কুলের সব ছাত্রীদের বিনামূল্যে পোশাক দেওয়া হতো। ২০০৫–০৬ সালে এই বাবদ সরকার ২৮ কোটি টাকা খরচ করেছিল । এটা শোনার পর রামগতি পোড়েল আমাদের বয়স্ক কর্মী, আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করলেন, এখনতো গড়ে সকলকেই এই টাকা দিচ্ছে।

আবার একাদশ শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর মধ্যে এই সরকার ২৫,০০০ টাকা দিচ্ছে। মিল মালিক, হিমঘর মালিক, অধ্যাপক, শিক্ষক, উচ্চমাধ্যবিত্ত, যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের মেয়েরাও এই ২৫ হাজার পাচ্ছে। এই টাকাটা সরকার অপচয় করছে। আমাদের পাড়ায় উচ্চবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ের বিয়েতে ওই ২৫ হাজার টাকার মদ খাওয়ানো হয়েছে কাজের লোকেদের। এটা শিক্ষার নামে বেয়াদবি হচ্ছে।এটা বন্ধ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে যাদের পাওয়া দরকার তাদেরকেই এই টাকা দেওয়া প্রয়োজন। আমি এরপর বললাম, বামফ্রন্ট সরকার এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই “বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা” চালু করেছিল। এই সরকার এসে নাম বদলে কন্যাশ্রী চালু করে। শিক্ষা ও কৃষিতে ভয়াবহ অবস্থা বলে ২০২২ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবর পড়তে শুরু করলাম। খবরটি হল, “পিছিয়ে থাকা ছাত্র ছাত্রীদের অংশ এবং কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন ঋণ থেকে– ভাতা দিয়ে খুশি রাখছেন মমতা। ধুঁকছে কৃষি, স্বনির্ভরতার ক্ষেত্র “। এস সি, এস টি হোস্টেল গুলি কোথাও বন্ধ ,কোথাও অল্প সংখ্যক ছাত্র আছে কিন্তু সময়ে তারা টাকা পাচ্ছে না। স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের -অবস্থা শোচনীয় ।দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যে চালু আছে নানান ধরনের শিক্ষা ঋণ। চলতি আর্থিক বছরে ৫৩ ,৩৮৩ জন ছাত্রকে  ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ।আর কয়েকদিন বাকি আছে আর্থিক বছর শেষ হতে। আর ঋণ পেয়েছেন ১৮,১৫৫ জন- ৪৯২ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা। লক্ষ্যমাত্রা আছে ৩৬১৯ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা। লক্ষ্যমাত্রার ১৮  শতাংশ ঋণ  পেয়েছে ছাত্ররা।কৃষি ক্ষেত্রের অবস্থা ভয়ংকর। পঞ্চাশ শতাংশের কম ঋণ পেয়েছে কৃষকরা। “পদযাত্রা শেষে দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর এই সবই চর্চা হচ্ছিল। কয়েকজন বলল,আজ এখানেই শেষ কর। বাড়ি ফিরতে হবে, তোমাদেরও অনেক দূর যেতে হবে। তবে আর একদিন পুরানো দিনের কথা আর বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্যগুলো নিয়ে বসতে হবে। আমরা এখনকার ছেলেমেয়েদের কয়েকজনকে আনার চেষ্টা করব। তাই হবে বলে আমরা চলে এলাম। (চলবে ——–)