তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। একাধারে গায়ক, নায়ক, সুঠামদেহী আ্যথলিট, ফুটবল-বাস্কেটবল-বেসবল খেলোয়াড়, রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও কলম্বিয়া আইন স্কুলের কৃতি ছাত্র। পেয়েছিলেন রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভ্যালেডিক্টোরিয়ান স্টুডেন্ট’-এর সম্মান। ছাত্রজীবনে এই মানুষটি আমেরিকান ফুটবল টিমের সদস্য হিসেবে খেলার সুযোগ পান। আবার ব্রডওয়েডে একটানা ২৯৬ রজনী ওথেলোর ভূমিকায় অভিনয় করার রেকর্ডটিও তাঁর দখলে। গায়ক হিসেবেও পেয়েছেন জগৎজোড়া খ্যাতি। তাই তাঁর টুপিতে যুক্ত হয়েছে গ্র্যামি লাইফটাইম আ্যচিভমেন্টের পালক। কুড়িটির বেশি ভাষা জানতেন তিনি। মানুষটি আর কেউ নন, আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ গায়ক পল রোবসন। এই বিপুল গুনসম্পন্ন মানুষকে ‘ট্রু আমেরিকান হিরো’ ছাড়া আর কী-বা বলা চলে! এই বছর তাঁর জন্মের ১২৫ বছর।

    এহেন একজন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব তাঁর নিজের দেশে গায়ের রং ও নিজস্ব মতাদর্শের কারণে অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি কৃষ্ণাঙ্গ এবং সব মানুষের সমানাধিকারের কথা বলতেন। তাঁর জন্মস্থান আমেরিকার প্রিন্সটন শহর হওয়া সত্ত্বেও, কেবলমাত্র গায়ের রঙের কারণেই পড়াশোনার জন্য প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার পান নি। যেতে হয় রাটগার্স  বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমেরিকান ফুটবল দলের সদস্য হয়েও সতীর্থদের সঙ্গে একসাথে সফর করতে পারতেন না। মনেপ্রাণে একজন আমেরিকান হয়েও রোবসন জানতেন যে, তাঁর নিজের দেশে কালো মানুষদের জন্য সমানাধিকার তখনও দূর অস্ত্। সমানাধিকারের জন্য অনুরাগ ও প্রকাশ্য সওয়ালের অভিযোগে ১৯৫০ সালে তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করে দেয় আমেরিকার সরকার।

    স্তালিন জমানায় ১৯৩৪ সালে রুশ চলচ্চিত্রকার সের্গেই আইজেনস্টাইনের আমন্ত্রণে রাশিয়া সফরের সময় রোবসনের অভিব্যক্তি ও প্রতিক্রিয়ায় ফুটে ওঠে বর্ণভেদ সঞ্জাত মনোবেদনা।রাশিয়ার মাটিতে পা রেখে রোবসন বলেছিলেন, সেখানে তিনি আর নিগ্রো নন। জীবনে প্রথমবার একজন মানুষ হিসাবে সম্মান ও স্বীকৃতি পেলেন তিনি। রাশিয়ার ভেদাভেদহীন শ্রমিকশ্রেণিকে দেখে প্রাণিত হন রোবসন। এর দু’বছর পরে রেকর্ড করেন দুনিয়াজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী গান ‘ওল’ম্যান রিভার’। যে গানে শ্রমিকদের যন্ত্রণা, শোষণের কথা ফুটে উঠেছে তাঁর ব্যারিটোন গলায়।

    পল রোবসনের জন্ম আমেরিকার নিউ জার্সির প্রিন্সটন শহরে ১৮৯৮ সালের ৯ এপ্রিল। তাঁর পুরো নাম পল লেরয় রোবসন। রোবসনের বাবার নাম উইলিয়াম ড্রু রোবসন ও মায়ের নাম মারিয়া লুইসা বাস্টিল। বাবা উইলিয়াম শৈশবে ছিলেন ক্রীতদাস। পরে হয়েছিলেন গীর্জার পাদ্রী। রোবসনরা ছিলেন তিন ভাই ও এক বোন। স্কুলজীবনেই পড়াশোনার সাথে সাথে খেলাধুলো, অভিনয় ও গান গাওয়া শুরু করেন রোবসন। কালক্রমে সেগুলি দক্ষতার মহীরুহে পরিণত হয়।

    পল রোবসনের মতো মানুষ আমেরিকার ইতিহাসে কমই এসেছে। কিন্ত  তিনিই ছিলেন আমেরিকা সরকারের মাথাব্যথার কারণ। বর্ণবৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর আপসহীন লড়াই। তবুও ঠান্ডা যুদ্ধের ম্যাকার্থি জমানায় আমেরিকা সরকার তাঁকে কমিউনিস্টপন্থী বলে মনে করত। কিন্ত কোনও কমিউনিস্ট দলে তিনি নাম লেখান নি কখনও। তাঁর কন্ঠে ছিল কালো মানুষের মুক্তির কথা, উপনিবেশবাদ বিরোধী কথা, সমতা ও মানবাধিকারের কথা, সর্বোপরি মানবমুক্তির কথা। ভিয়েতনামের বিপ্লবী হো চি মিনের পত্রিকায় লেখালেখি করা,  বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা ও তাদের আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা, সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে  আমেরিকার রাষ্ট্রযন্ত্র তাঁকে  কোনওদিনও রেয়াত করে নি। পরিণামে তাঁর ওপর নেমে এসেছে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন। যেমন-পাসপোর্ট বাজেয়াপ্তকরণ ও কুখ্যাত আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফ বি আই)-এর কড়া নজরদারি। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত এফ বি আই-এর কড়া নজরদারির আওতায় অন্তরীণ থাকতে হয় তাঁকে। আমেরিকার ইতিহাসে অভূতপূর্ব নজিরবিহীন নজরদারির শিকার হতে হয় এই গণশিল্পীকে। তবুও তাঁর লড়াই থেমে থাকে নি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে তিনি ছিলেন আইনের কৃতি ছাত্র। রাষ্ট্রের সাথে দীর্ঘদিন মামলা লড়ে ১৯৫৮ সালে ফিরে পান পাসপোর্ট এবং বেরিয়ে পড়েন ইউরোপ, অষ্ট্রেলিয়া, রাশিয়া সফরে তাঁর গান নিয়ে রাজনৈতিক সংগ্রাম সংঘবদ্ধ করার লক্ষ্যে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ১৯৫৬ সালে উপরোক্ত মামলায় ‘আমি কমিউনিস্ট নই’ এই এফিডেভিটে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন রোবসন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ায় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির  আত্মপ্রকাশ ও সাফল্যে ‘লাল ভুত’-এর আতঙ্কে অস্থির হাউস কমিটি অন  আন- আমেরিকান আ্যক্টি্ভিটিস (HUAC)-এর সঙ্গে রোবসনের সওয়াল জবাব একটি ঐতিহাসিক দলিল রূপে স্বীকৃত দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের কাছে।

     পল রোবসন বলেছিলেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শিল্পীদের পক্ষ নেওয়া উচিৎ। যেমন পিট সিগার গেয়েছিলেন, ‘হুইচ সাইড আর ইউ অন?’ কোন দিকে সাথি তুই, কোন দিক বেছে নিবি বল? ১৯৩৭ সালে মস্কো থেকে দুনিয়ার শিল্পী-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানীদের কাছে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল পল রোবসনের আবেদন। তাঁর আহ্বান ছিল, আজ নিরপেক্ষ থাকার দিন নয়, ‘ফ্যাসিবাদ আর মুক্তির মধ্যে পক্ষ নিন। প্রতিটি শিল্পী, প্রতিটি বিজ্ঞানীর এখন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ কার পক্ষে তিনি দাঁড়াবেন। তাঁর কাছে এছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই। এখানে নেই কোনও নিরপেক্ষ দর্শক। সর্বত্র যুদ্ধক্ষেত্র। কোথাও কোনও আশ্রয় নেই।—শিল্পীদের তাই পক্ষ নেওয়া উচিৎ। আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমার আর কোনও বিকল্প ছিল না’। ফ্যাসিবাদী নাৎসি হিটলার দ্বারা বিতাড়িত আমেরিকায় অভিবাসী  মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সঙ্গে ছিল তাঁর অসীম হৃদ্যতা।

    এবারে আসা যাক রোবসনের সৃষ্টিশীল কর্মকান্ডের আলোচনায়। আমেরিকা তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম আফ্রো- আমেরিকান চলচ্চিত্র তারকা ছিলেন রোবসন। তার আগে ছিলেন একজন পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়। বিশ শতকের বহু সিনেমায় অভিনয় ও গান করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও খ্যাতিলাভ করেন তিনি। মোট ১২টি সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। তিনি ছিলেন শেকসপিয়রের ওথেলো চরিত্রে অভিনয় করা প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা। কিছুদিনের জন্য ব্রিটেনে গিয়ে লন্ডনের দর্শকদেরও মাতিয়ে তুলেছিলেন তিনি। পরে আবার আমেরিকায় ফিরে এসে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন।

   ভারতের জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী ভূপেন হাজারিকার কন্ঠে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে পল রোবসনের বিখ্যাত গান ও’ল ম্যান রিভার (ওল্ডম্যান রিভার)। যার বাংলা সংস্করণ ‘বিস্তীর্ণ দুপারে’ গানটি। মূল গানটি মিসিসিপি নদীকে নিয়ে অসংখ্য আফ্রো-আমেরিকান শ্রমজীবী মানুষের জীবন সংগ্রামকে ঘিরে রচিত। অসমিয়া অনুবাদে ব্রহ্মপুত্র নদ এবং বাংলা ও হিন্দি অনুবাদে এসেছে গঙ্গা নদীর কথা। এছাড়া আমাদের কাছে পরিচিত আর একটি গান হল ‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না, নিগ্রো ভাই আমার পল রোবসন’। এই বাংলায় সাতের দশকে বাক স্বাধীনতার অধিকার রক্ষার সংগ্রামে গানটি বহুবার গীত হয়েছে। গানটির গীতিকার ও সুরকার প্রখ্যাত গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস। আবার এই গানটিই আমরা ভাষার সামান্য হেরফেরে শুনেছি আর একজন প্রখ্যাত গণসংগীত শিল্পী অজিত পান্ডের কন্ঠে। তবে গানটির মূল রচয়িতা কিন্তু তুরস্কের প্রতিবাদী কবি নাজিম হিকমত।যাঁর জীবনটিও রোবসনের মতো সংগ্রামী জীবন। যিনি দীর্ঘ তেরো বছর জেলে কাটিয়েছেন। হারিয়েছেন তুরস্কের নাগরিকত্ব। অপরাধ মানুষের দাবি ও অধিকারের পক্ষে কথা বলা। সারা পৃথিবীর গায়ক-কবি-সাহিত্যিকদের আন্দোলনে কারামুক্ত হন। জাঁ পল সাত্র, পল রোবসন, পাবলো নেরুদা তাঁর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। তাঁর ‘জেলখানার চিঠি’ শীর্ষক কবিতার কথা আমরা অনেকেই জানি। ব্রেটল্ট ব্রেখট, পাবলো নেরুদা, পল এলুয়ার, পাবলো পিকাসো, এলিয়া এরিনবুর্গ, পল রোবসন, ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর প্রিয় কবিদের প্রথম সারিতে ছিলেন নাজিম। নাজিমের একটি কবিতা এভাবে আশা প্রকাশ করেছে, ‘আমি মরতে চাই না, কিন্তু যদি মৃত্যু আসে, তবু আমি বেঁচে থাকব তোমাদের মাঝে, আমি বেঁচে থাকব আরাগঁ-র কবিতায়—। আমি বেঁচে থাকব পিকাসোর সাদা কবুতরে, আর রোবসনের গানে’। ১৯৫০ সালে পাবলো নেরুদা তাঁকে এই বলে সম্মানিত করেছিলেন, ‘নাজিমের কবিতায় সমগ্র বিশ্বের কন্ঠস্বর বেজে ওঠে’।

     আফ্রো-আমেরিকান সহ তামাম দুনিয়ার ভাই, নিগ্রো ভাই পল রোবসনের বর্ণময়-কর্মময়-সংগ্রামমুখর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৭৬ সালের ২৩ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায়। শরীরী মৃত্যু ঘটলেও শিল্পীর মৃত্যু নেই। পল রোবসন বেঁচে থাকবেন দুনিয়া জোড়া  সংগ্রামী মানুষের গানে।

     নিবন্ধের ইতি টানা যাক কবি শঙ্খ ঘোষ অনূদিত পল রোবসনের একটি গীতি কবিতার  উল্লেখের মধ্য দিয়ে।

      আমেরিকার জন্য গান

এই আমাদের দেশের প্রবল, 

এই আমাদের দেশের নবীন

এই আমাদের দেশের মহান গান এখনও হয় নি গাওয়া

প্রতারণার ভিতর থেকে, কোলাহলের ভিতর থেকে

হত্যা ও অত্যাচারের ভিতর থেকে

ফাঁপা কথার ভিতর থেকে, দেশোদ্ধারের ভিতর থেকে

জাগবে আবার গান।

জাগবে আবার সেই আমাদের অভিযানের গান,

প্রিয় সুরের মতো সহজ, উপত্যকার মতো গভীর

পাহাড় চূড়ার মতো উঁচু 

এবং তাদের মতোই প্রবল

বানায় যারা সেই আমাদের গান।