জ্যোতি বসু সবার জ্যোতি বাবু। একটা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কিন্তু আপনারা দেখেছেন কখনো সমস্ত রাস্তার ধারে কিংবা ধাপার মাঠে ঝাঁ চকচকে বড়ো বড়ো হোডিং-এ ফোন নম্বর দিয়ে দাদাকে বলো! কখনো শুনেছেন প্রকাশ্যে রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে বলতে আমার ২৯৪ টা সিটই চাই। কখনো কোনো ‘অনুপ্রেরণা’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করেননি। ক্ষমতায় আসার প্রথম দিনেই বলেছিলেন, রাইটার্স থেকে সরকার চলবে না। গ্রামের উন্নয়ন গ্রামের মানুষ ঠিক করবেন। তিনটি স্তরে বেঁধে দিয়েছিলেন গ্রামীণ উন্নয়নের রূপরেখা। পঞ্চায়েত প্রধান হলেন গ্রামের চাষিও। গ্রামের মানুষেরাই তৈরি করলেন গ্রামের উন্নয়নের পরিকল্পনা। কোথাও কৃতিত্ব নিতে যাননি। পঞ্চায়েত বা পুরসভার কাজে ফিতে কাটতে যাননি। কারণ, প্রচারের ঢক্কানিনাদ ছিল না। সরকারে আসার এক বছরের মধ্যে ভূমি সংস্কারের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেননি। শুধু সিদ্ধান্ত নিয়েই ক্ষান্ত হননি, কঠোরভাবে রূপায়ণ করেছেন। চোদ্দ লক্ষ একর জমি বিলি হয়েছে প্রান্তিক চাষিদের মধ্যে। আবার যখন শিল্পের প্রয়োজন, তখনও সময়ের দাবি মেনে অগ্রাধিকার বেছে নিতে ভুল করেননি। রাজারহাটের মতো আস্ত উপনগরী নিঃশব্দে হয়ে গেল। কেউ টেরও পাননি। কেন্দ্রে বন্ধু সরকার ছিল, এমন নয়। বরং, নানা কাজে বাধা এসেছে বিস্তর। কিন্তু তারজন্য জ্যোতি বাবুকে কোনোদিন আঁতাতের পথ অবলম্বন করতে হয় নি। মদ খেয়ে মরে গেলে টাকা বরাদ্দ করতে হয় নি, ধষর্কের হয়ে ধর্ষিতার চরিত্র হনন করে রেট বেঁধে দেননি, প্রকল্পের নামে যুব সমাজকে অক্ষম করার জন্য সুকৌশলে ব্লু-প্রিন্ট করতে হয়নি জ্যোতি বাবুকে। রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে ভিক্ষাকে বৃত্তি হিসাবে দেখিয়ে নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে অক্ষমতাকে ঢাকতে হয়নি। কখনও পাওনাগন্ডা নিয়ে দরকষাকষি করতে হয়নি। রাজনীতির মঞ্চে দাঁড়িয়ে সমালোচনাও করতে হয়নি। যেটা বোঝেন না, জোর করে বুঝি প্রমাণ করার চেষ্টা করেননি।

সাংবাদিকদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বাবুর বিশেষ কোনো মাথাব্যথা কোনোদিন ছিলো না। কোন কাগজ কী লিখল অন্তত প্রকাশ্যে সেভাবে তাতে উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। চূড়ান্ত সমালোচনা করলেও বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যায়নি। কিন্তু তিনি বুঝতেন মানুষের কোনটা প্রয়োজন। মানুষ কী চায় বোঝার জন্য ভনিতা করতে হয়নি। ভোটের পাওয়ার জন্য সেদিন জ্যোতি বাবুকে, ‘লা আল্লা ইলাহি’ আওড়ে, চণ্ডীপাঠের মন্ত্র পাঠ করে ঘোমটার নীচে ক্ষ্যামটা নাচ নাচতে হয়নি। ১৯৭৭ সালের পর থেকে একের পর এক কাজ করে গেছে বামফ্রন্ট সরকার কিন্তু তার জন্য সারা শহর জুড়ে বিজ্ঞাপনের মোড়কে রাঙাতে হয়নি সি এম জ্যোতি বাবুকে। ৩৪ বছর ছিলো বাংলার অগ্রগতির ইতিহাস। ভারতের সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে লড়াই করার ইতিহাস এবং স্বাধীন ভারতে কোনও বামপন্থী প্রতিষ্ঠান বিরোধী দলের দীর্ঘতম রাজ্য সরকার পরিচালনার ইতিহাস। ১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর বিখ্যাত ‘নোমা’ পুরস্কার পেয়ছিলো পশ্চিমবঙ্গ। সরকার আসার আগে সাক্ষরতার হার ছিলো ৩৮.৮৬% তা ২০১১ তে বেড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ৭৭%। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে মাদ্রাসার শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ ছিলো ৫ লক্ষ ৬০ হাজার, যা ২০১০ সালে বাম সরকার বরাদ্দ করেছিলো ৬১০ কোটি টাকা। বাম সরকারের উদ্যোগেই ২০০ টির বেশি নতুন কলেজ হয় এবং বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই চালু হয়েছিলো ৭৩ টি ডিগ্রি কলেজ। ১৯৭৭ সালে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সংখ্যা ছিলো ১৩২৬ টি যা ২০১০ বেড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ১২ হাজার। ১৯৭৭ সালের আগে পৌরসভা থাকলেও, ছিলো না প্রশাসনিক ক্ষমতা,ছিলো না আর্থিক বল। বামফ্রন্ট সরকার আসার পর এগুলোকে স্বায়ত্বশাসিত সংস্থায় পরিণত করেছিলো। অর্ধেক আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করেছিলো এবং তফসিলী জাতি, আদিবাসীদের জন্য জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে আসুন সংরক্ষণ করেছিলো। অদ্ভুত বিষয় হলো নীল সাদার হিড়িকে নামের পরিপাটিতে মুড়ে দিলেই যে কখনোই কারুর কীর্তিত অন্যের সাফল্য হয়ে যায় না তা যে এখনকার সরকারের মস্তিষ্কের বায়োলজিক্যাল সমস্যা সেটা ওনাদের কে বোঝাবেন। আসলে এই সরকারের অবস্থা কি জানেন, ওই যে বাবা দোতলা বাড়ি করে দিয়ে গেছে কিন্তু রং টা ছেলে করে বলে বেড়াছে আর বলো না বাড়ি করতে লাখ লাখ খরচা হয়ে গেলো। শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই নয় বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এনেছিলেন অভূতপূর্ব পরিবর্তন। কোন জেলায় কে কোন কমিটিতে থাকবেন, সে ব্যাপারে মাথা গলানোর চেষ্টা কোনোদিনই করেননি ততৎকালিন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। সংগঠন যাঁরা বোঝেন, তাঁদের হাতেই ছেড়ে রেখেছিলেন। তাই দল আর প্রশাসনকে আলাদা করতে পেরেছিলেন। কোনটা দলের মঞ্চে বলতে হয়, কোনটা প্রশাসনিক মঞ্চ থেকে বলতে নেই, এই পরিমিতি বোধটা ছিল তাঁর। সেই সময় এখনকার মতো দূর্নীতিবাজদের আক্রা ছিলো না সরকার। তত্ত্বসত্বেও বলাবাহুল্য কীভাবে দুর্নীতি আটকাতে হয়, সেটাও জানতেন। লোক দেখানো ভাষণে নয়, কাজে করে দেখিয়েছেন। প্রশাসকের চেয়ারে বসে কেন্দ্র–রাজ্য সম্পর্কের বিন্যাসেও নতুন মাত্রা এনেছেন। এতগুলো দলকে নিয়ে কোয়ালিশন সরকার ছিল। অথচ, কোনও শরিকই বলতে পারবে না তারা বঞ্চিত হয়েছে। বরং, যতখানি গুরুত্ব প্রাপ্য, তাকে ততটাই দিয়েছেন। এই উদারতা ও সমন্বয় আর কোথায় পাবেন! তাঁর আমলেও পাহাড় অশান্ত হয়েছিল। গোর্খাল্যান্ডের নামে হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। দক্ষ ও দূরদর্শী প্রশাসকের মতোই সামাল দিয়ে পাহাড়ে শান্তি ফিরেছিল। কিন্তু ঢাক পিটিয়ে ‘পাহাড় হাসছে’ উন্নয়নে ভাসছে হোর্ডিং দিতে হয়নি। সেখানে উন্নয়নের কৃতিত্বের ভাগিদার হতে যাননি। সেই সময়েও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা কম হয়নি। এই প্রসঙ্গে ছোট্ট একটি ঘটনা না বললেই নয়, নয়ের দশকে জ্যোতিবাবু মহাকরণ থেকে বেরিয়ে আসছেন সাংবাদিকরা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ঘোষণা করেছে, এক বছরের মধ্যে তারা রাম মন্দির গড়বে আপনরা প্রতিক্রিয়া? জ্যোতি বাবু ঘুরে দাঁড়িয়ে চেনা ভঙ্গিমায় সুস্পষ্ট উত্তর দিলেন–‘আমি কী করব? মাথায় করে ইট বইব নাকি?’

২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জী মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে বাংলায় একের পর এক RSS এর ছোট বড়ো সংগঠন ব্যঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে এবং বিজেপির বাড়বাড়ন্ত বেড়েছে যা ৩৪ বছরে হিম্মত হয়নি। দীর্ঘদিন ধরেই সুচতুর ভাবে ধর্মের নামে জিগির তুলে মানুষকে ভাগ করার চক্রান্তে মমতা ব্যনার্জী মোদীর সাথ দিয়ে আসছে তার প্রমাণ আজ যারা তৃণমূল কাল তারা বিজেপি আবার তারাই তৃণমূল। দুদিন আগে সচেতন ভাবে বিজেপি নেতা নুপূর শর্মার ভাষার উস্কানীর জেরে সারা রাজ্য জুড়ে প্রতিকি FIR করা হয় । ঘটনা অন্তত তারই বার্তা বহন করে। সেই ঘটনাই মনে করিয়ে দেয় ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ভাঙার কথা। দেশের নানা প্রান্তে যখন দাঙ্গা হচ্ছিল তখন এই বাংলায় তার আঁচও পড়তে দেননি। প্রশাসকের নমনীয়তা ও দৃঢ়তা, দুটোই সেদিন দেখেছিল বাংলা। এবং দাঙ্গা প্রসঙ্গে একটা টিভি ইন্টারভিউতে জাভেদ আখতার তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার রাজ্যে দাঙ্গা হয় না কেন? এক কথায় উত্তর দিয়েছিলেন, ছোট্ট একটি বাক্য, যার ব্যপ্তি ছিল বিশাল—“সরকার না চাইলে ,দাঙ্গা হয় না”।

তার এতো বিশাল ব্যক্তিত্ব আজও বাংলার গর্ভ নয় “গর্ব” তফাৎ কিন্তু রয়েই গিয়েছে। এই দৃঢ়তা তাঁকে আজও সবার থেকে আলাদা করে রেখেছে। তার জন্য ওঁনাকে কখনো শিক্ষার্থীদের সিলেবাসে নিজেকে ঢোকাতে হয় নি, তাঁকে কখনো দলের লোককে দিয়ে প্রচার করতে হয়নি বাংলা নিজের ছেলেকে চায়,প্রচার করাতে হয়নি দাদাকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চাই। ১৯৯৬ সালে সারা দেশের বিজেপি বিরোধী সমস্ত দল একবাক্যে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর দল চাইলেই আর কোথাও কোনও বাধা ছিল না। কিন্তু ওই আমাদের শৃঙ্খলা ছাড়া হারাবার কিছু নেই। সেই শৃঙ্খলাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে শেষমেষ দলের সিদ্ধান্তই মেনে নিলেন অনুগত সৈনিকের মতো। তার চার বছর পর স্বেচ্ছায় মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকেও ইস্তফা দিলেন। এ দেশের রাজনীতিতে এমন উদাহরণ বিরল।

অতি দুঃখ এবং ঘৃণার সাথে বলতে হচ্ছে গণতন্ত্র-কে কারাগারে বন্দি করে ; দুহাতে চলছে নিধন। নারী সম্ভ্রম আজ লুণ্ঠিত। গণতন্ত্রের বুক চিরে শাণিত হচ্ছে বেদনা। জমে জমে তৈরী হচ্ছে আগ্নেয়গিরি ; অগ্ন্যুৎপাত হতে খুব দেরী নেই। ৮- ৮০ কে লাঞ্ছিত করে সদর্পে হেঁটে চলছে। যদি ভেবে থাকে শাসন; উল্লাসে উল্লসিত হবে ; তাহলে আরো একবার চোখে চোখ রেখে বলব সময়ের চাকা কিন্তু ঘুরছে ; অন্তত ইতিহাস তাই বলে। তাই বলব দলমত নির্বিশেষে সকলকে এই প্রতিরোধী আহ্বানে আমন্ত্রণ।