এক

২০১১ সালে ও ২০১৪ বিশেষ করে ২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসে অবদি তৃণমূল আর বিজেপি যা সব কাণ্ড করছে, তাকে এককথায় বলা যায় স্বৈরতান্ত্রিক কতৃত্ববাদী অরাজকতা। 

এদের দুস্কর্মের শেষ নেই। এক্ষুনি যা মনে আসছে তাই লিখি। 

ভোট লুঠ চলছে, গণতন্ত্রের বহ্নুৎসব বিরামহীনভাবে সমবায়, স্কুল ম্যানেজিং কমিটি, কলেজ ছাত্র সংসদ, সমবায়, পঞ্চায়েত – এরকম সব জায়গায় চলছে। গরিব চাষিকে ফসলের দাম, রেশনকার্ড, খাদ্য সরবরাহ, বেকার সমস্যা সমাধান, নারীদের সম্মান দেওয়া, ১০০ দিনের কাজ দেওয়া – এসব করনীয় কার্যাবলি থেকে হাত উঠিয়ে নিয়েছে দু’টো দলের সরকারই। প্রকৃত প্রস্তাবে পরিযায়ীদের নিধনের ব্যাপারে দুটি দলই একই রকম নিষ্ঠুর। বেকার সমস্যা বাড়ছে, অর্ধাহার – অনাহার শুরু হয়ে গিয়েছে। পানীয় জলের তীব্র সংকট। আগুনের লেলিহান শিখার মতো প্রতিদিনের প্রয়োজনের জিনিসের দাম বাড়ছে।  শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ( আই সি ডি এস) –এদের এজেণ্ডার বাইরে। শিক্ষা করে জাতির মেরুদণ্ডকে বিকল করে দেওয়া ওদের রাজনৈতিক কার্যক্রম।  ওদিকে আদানীদের মতো সব রাঘববোয়াল পুঁজিপতি, তো এদিকে অভিষেকের মতো মাফিয়ারা।

নারদ, চিটফাণ্ড, নিয়োগ, কয়লা, বালি, গরুপাচার, কাটমানি, সিণ্ডিকেট – ইত্যাদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যাতে সি বি আই-ইডি ব্যবস্থা না নেয়, তার বন্দোবস্ত করে দিচ্ছেন মমতা। ওদিকে আদানী শেয়ার কেলেংকারী ঘটিয়ে যে ২০ লক্ষ কোটি টাকা বাজার থেকে হাওয়া করে দিলো, সুপ্রিম কোর্ট উষ্মা প্রকাশ করলেও, মোদীজি ভাবলেশহীন। দুটো দল একই বিষবৃক্ষের পল্লবের ডাঁটায় ঝুলে থাকা দুটি বিষ ফল। তাই ওদের দুই দলেরই কাজ–কারবার একই।

দুই

মানুষে মানুষে বিভেদ বাঁধানো, পশ্চাতৎপদ দলিত মানুষকে কোণঠাসা করা, মুসলমানদের নস্যকস্য জ্ঞান করা, তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে আক্রমণ করা হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে – যেসবকে এককথায় বলে জিঘাংসা, তা চালানো হচ্ছে। এবং  এটা পরিকল্পনা করেই করা হচ্ছে।  সংখ্যালঘু মানুষের ওপর অত্যাচার, হত্যা, নারীদের অপমান, ধর্ষণ, হত্যা, বিজেপি’র নীতির যারা বিরোধী সেই সব মুক্তমনা মানুষকে হত্যা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছিয়ে পড়া সমাজের ছাত্রকে হত্যা, আবার কাউকে দেশদ্রোহী ছাপ মেরে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। দিনের পর দিন ফাটকে আটকে রাখা হচ্ছে দানবীয় আইনে।  

মমতা মুসলমানদের মশিহা এটা দেখাতে গিয়ে যা সব ভড়ং করছে, একটু বুদ্ধি-বিবেচনা যাদের আছে, তাদের কাছে এসব অসহ্য। যখন তখন অর্থ না বুঝে ইনসাল্লাহ বলা, ‘আল্লা তুমি দোয়া করো’র মতো উদ্ভট কথা বলা, মাথায় চাদর পড়া, ভরপেট খেয়ে রোজার মাসে ইফতার পার্টিতে বসে পরা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষ পছন্দ করেন না। ইমামভাতা, মোয়াজ্জেমভাতা কোন দিন মুসলমানেরা চান নি। এসব মুসলমানদের নাগরিক হিসাবে না দেখে ভোটার হিসাবে দেখে, মুসলমান মানুষকে ঘুষ দেবার শামিল। এটা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একটা অবিশ্বাস সৃষ্টি করার অপকৌশল। তাছাড়া এই কাজটা কতটা শরিয়ত সম্মত এনিয়েও অনেক প্রশ্ন মুসলমান মানুষই তুলেছেন। আর এইসব দেখনদারি কাজ করতে গিয়ে মুসলুমানের ‘দশসমাজ’কে অনেক গ্রামে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। অনেক মুসলমানভাই প্রশ্ন করছেন – ইমামদের পেছনে দাঁড়িয়ে যাঁরা নামাজ আদায় করেন, সেই কৃষক-মজুর-গরিব মানুষের জন্য মমতার কর্মসূচী কী?  সেই সব খেটেখাওয়া  মুসলমানদের জন্য মমতা তোমার মমতা কোথায়?

মাদ্রাসা, মুসলিম হোস্টেল, ইত্যাদি ধরনের মুসলমানদের জন্য হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা বলে যেসব বাত ঝাড়া হয়েছিল, সে সবের কী হলো? এসব প্রশ্ন একদা মমতা সঙ্গী মুসলমান নেতারাই করছেন। 

তৃণমূল বিজেপি’র প্রায় সব অপকর্মকে গ্রহণ করে নিয়েছে- যেমন মন্দির বানানো, সন্ধারতি দেওয়া, অস্ত্র সহ রামনবমীর মিছিল ইত্যাদি। দলিত, নারীকে অপমান করার ব্যাপারে, ধর্ষণ ও খুনের ব্যাপারে, মুসলমান যুবক খুনের ব্যাপারে (আনিস হত্যাকাণ্ড)  একই রকম কাজ-কর্ম করে চলেছে। এসব দুষ্কাণ্ড করার সময় তৃণমূল একটা আবরণ দিয়ে রাখে। সেই আচ্ছাদন খুলে খুলে পরে। আর বিজেপি’র কোন পর্দা থাকে না।  

তিন

আসলে তৃণমুল –বিজেপি’র মধ্যে একটা গড়াপেটা খেলা হয়। এই রাজ্যটার নাম পশ্চিমবঙ্গ। তাই সব চক্রান্ত যে হাসিল করতে পারে, তা নয়। কিন্তু কাজ হাসিল করার মতো ভোটটা যদি ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়, তাহলে একই গোত্রের দুই দলের শাসন বজায় থাকবে। বামেরা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। বামেদের অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া ওদের দুই দলেরই ঘোষিত মূল কর্মসূচী। এই মতলব নিয়ে এরা চলে। চলে মানে চালায় – এই দুই দলেরই গুরু আর এস এস। স্বাধীনতা সংগ্রাম বিরোধী, গান্ধীজির হত্যাকারি, প্রতিনিয়ত নিচের মহলের মানুষকে অপমান করার কারিগর   আর এস এস-এর কোন বীভৎসতার বিরোধিতা মমতা করে না। তামিলনাড়ুতে উদয়নিধি যা বলতে পারেন, তা বলার ক্ষমতা নেই মমতার। পক্ষান্তরে আর এর এস- এর প্রশংসায় তিনি পঞ্চমুখ, সেই সংগঠনের কর্তা মোহন ভাগবতকে তিনি পাঠান দুধ-কলা- ইত্যাদির ফলার।   

আমরা ছোট বেলায় দাদাদের মুখে একটা শ্লোগান শুনতাম –‘যখনই আমরা চাই বস্ত্র ও খাদ্য/ সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য’। যুদ্ধন্মোদনা তো বিজেপি’র পেটেণ্ট। এখন শুধু সীমান্তে নয়, দেশের মধ্যেও মানুষে মানুষে যুদ্ধ লাগিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। হয়েছে আমাদের রাজ্যের অলিতে গলিতে। সেখানে সঙ্গ দিচ্ছে তৃণমূল। সাধারণ মানুষের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছে।

বামেরা বার বার সতর্ক করে বলে, একটা দুশমনের হাত থেকে রক্ষা পাবার আশায় আরেকটা দুশমনের হাত ধরবেন না। ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনানে পড়ার শামিল হবে তা। কিন্তু এমনভাবে ঐ দুই দল লেকচার দেয়, এমনভাবে ওদের ভাড়াখাটা মিডিয়া প্রচার তুলে দেয় যে,  কারও কারও মনে হয়, দুটি দল পরস্পর কত না শত্রু! এই ভাব-ভঙ্গিতে  মানুষ যে বিভ্রান্তও হন, তা প্রমাণিত।

ইতোমধ্যে লাগাতার লড়াইয়ের ফলে দু’টি বিষয় ঘটেছে – এক মানুষের অনেকটা মোহমুক্তি। বিজেপি সম্পর্কে, তৃণমূল সম্পর্কে। আর বামেদের আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়া।  শ্লোগান উঠেছে জোরদার – তৃণমূল হঠাও – রাজ্য বাঁচাও, বিজেপি হটাও – দেশ বাঁচাও। মানুষ এই শ্লোগানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে ভরসা করতে শুরু করেছেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রীরা কী চুপ করে থাকে! তারা আরও ভয়ংকর পথ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত ভোট পর্বের ও ভোট পরবর্তি ভয়ংকর ঘটনাগুলি তার প্রমাণ। 

চার

কতো বিরাট বিরাট আন্দোলন! কতো মিছিল বিশাল বিশাল! ব্লক, এস ডি ও ডি এম অফিস ঘেরাওয়ে কত বিপুল মানুষ! মানুষের কি তেজ, কি জেদ!    এসবের প্রস্তুতিতে, মানুষ জোটানোর জন্য মানুষের কাছে তো যেতে হয়ই। রাজ্য জুড়ে জালের মতো আমাদের সংগঠনগুলির বিস্তার। বিভিন্ন জায়গা থেকে বেশি মানুষ, কম মানুষ এ সব প্রোগ্রামে আসছেন। আবার কোন জায়গা থেকে অবহেলায় আসছেনও না। তাতেই সামগ্রীকতার বিচারে জমায়েত ভালো হচ্ছে। আমরাও সন্তুষ্ট হচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ গানে যেমন বলেছিলেন – তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ উঠে। উঠে আবার মিলায়ে যায় কিনা এটাই দেখার। মানুষের সঙ্গে নিরন্তর সম্পর্ক থাকছে কিনা সেটাই চিন্তার।  

যুবরা ৭ই নভেম্বর শুরু করে দু’মাস জুড়ে কাকদ্বীপ থেকে কলকাতা মাতিয়ে ৭ জানুয়ারি ব্রিগেড জমায়েতের প্রোগ্রাম নিয়েছেন।

এলাকার পর এলাকা মাতানোর জন্য কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় বৈঠক, আর বাড়ি বাড়ি লিফলেট বিলি করে, পরিবারগুলির লোকদের সঙ্গে কথা বলার বিষয়টা অবশয়ই রাখতে হবে। আমরা অযাচিত ভাবেই পরামর্শটা দিলাম। নিজগুনে ক্ষমা করবেন সংশ্লিষ্ঠ সাথিরা, এই অনুরোধ।

মানুষের মধ্যে কত কথা! কাল হাটে গিয়েছিলাম। পেছন থেকে এক সাথি  আমাকে উদ্দেশ্য করেই বললেন – ‘ভালো করি হাট ঘোরো/ মমতার সাথ ছাড়ো। মমতা আইচে নিজে বাঁচিবার তনে।‘

এরকম কত প্রশ্নের জবাব দেওয়া, মানুষকে  আস্বস্ত করা,  আমরা যে মানুষের সঙ্গে কোনদিন বেমাইনি করি নি, কখনও করবো না, বিজেপি, তৃণমূলের মতো দলগুলো কেন জনশত্রু, তা আমাদের গভীর ও নিবিড় আলোচনার মাধ্যমেই মানুষকে বুঝিয়ে, তাদের মনে বামপন্থীদের সম্পর্কে আস্থা সৃষ্টি করার দায় আমাদের ওপর বর্তেছে। তা সম্ভব মানুষের সঙ্গে ধৈর্য ধরে ধারাবাহিক যোগাযোগের মাধ্যমে।

সেজন্য চাই নিবেদিত প্রাণ কর্মী বাহিনী। যুব বয়সের কর্মী বাহিনীই মূল। আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়, ২০১১ সালের পরে যাঁরা আমাদের বৃত্তের মধ্যে এসেছেন, তাঁদেরই বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু অন্যান্যরা অপাংক্তেয় নয়, তাও আমাদের মনে রাখতে হবে।

এখন আমাদের বিপুল জনতরঙ্গ ওঠাবার সময়, এখন আমাদের বিপুলভাবে লাল লাল ফুল ফোটানোর সময়। যা আগামীর ইতিবাচক পরিবর্তনের নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহন করবে।