সেদিন তেভাগার দাবীতে ঝড় উঠেছিল বাংলার গ্রামগুলিতে।দুই-তৃতীয়াংশ ফসলের উপর কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার এই লড়াই দেশ ভাগের পরেও কিছু কিছু জায়গাতে চলেছিল। তেভাগার দাবীতে নাচোলে(পূর্ব পাকিস্তান)যে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কমরেড ইলা মিত্র। জোতদার জমিদারদের লেঠেল বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্দেশ্য সাঁওতাল ও ভূমিহীনদের একত্রিত করে গড়ে তুলেছিলেন তীরন্দাজ ও লাঠিয়াল বাহিনী।ইলা মিত্রের নেতৃত্বে নাচোলের গ্রামগুলিতে তেভাগার দাবীতে কৃষকদের এই  আন্দোলন ভাঙ্গতে জোতদার জমিদারদের সাহায্য করতে শুরু হয় পুলিশের অত্যাচার। জনতা পুলিশ সংঘর্ষে ১৯৫০সালের ৫ই জানুয়ারি নিহত হয় এক পুলিশ কর্তা সহ পাঁচজন কনস্টেবল। এই ঘটনার পর আরও তীব্র হয় আক্রমণ পুলিশ -সেনার যৌথ আক্রমণে প্রাণ হারায় অসংখ্য গ্রামবাসী।১৯৫০সালের ৭ই জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আসবার সময় পাকিস্তান পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি।শুরু হয় তাঁর উপর অকথ্য অত্যাচার।যৌনাঙ্গে গরম ডিম ঢুকিয়ে,গোড়ালিতে লোহার পেরেক ঢুকিয়ে চলে পাশবিক অত্যাচার। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য এই নরপশুরা তাঁকে ধর্ষণ পর্যন্ত করে।কৃষকের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সেদিন কমরেড ইলা মিত্র কে সইতে হয়েছিল অকথ্য অত্যাচার, থাকতে হয়েছিল কারাবন্দী।কিন্ত এত অত্যাচার সহ্য করেও কমিউনিস্ট নেত্রী ইলা মিত্র কৃষক সংগ্রামের প্রতি ,শ্রেণীর প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতা করেন নি।কোনও তথ্য তাঁর কমরেডদের বিরুদ্ধে দেননি পুলিশের কাছে।জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কমরেড ইলা মিত্র রয়ে গেছেন লাল ঝান্ডার সৈনিক।    

কমরেড ইলা মিত্রদের লড়াইয়ের যে ঐতিহ্য সেই ঐতিহ্যর উওরাধিকার বহন করছেন কমরেড ফুল্লরা মন্ডল। এ রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার তথা সিপিআই(এম)বিরোধী ষড়যন্ত্রের এক ঝটিকা কেন্দ্র ছিল নেতাই।জঙ্গলমহলের এই অংশে জনগণের মধ্যে পার্টির যোগাযোগ ছিল অত‍্যন্ত গভীর। এই যোগাযোগ নষ্ট করবার জন্য সেই সময় ওই অঞ্চলে আমাদের কমরেডদের উপর নামিয়ে এনেছিল ভয়ংকর সন্ত্রাস।সাড়ে তিনশো কমরেড কে সেই সময় ওই অঞ্চলে হারাতে হয়েছিল আমাদের। সেই সন্ত্রাসের দিনগুলিতে জঙ্গলমহলের এই অংশে মাও তৃণমূলের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ  করবার জন্য যে সমস্ত কমরেড মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কমরেড ফুল্লরা মন্ডল। ওই জেলার মহিলা আন্দোলনের নেত্রী একই পার্টির জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। উপরে উপরে ভেসা থাকা নয় একেবারে মাটির সঙ্গে সম্পর্ক থাকা নেত্রী ছিলেন তিনি।মাও তৃণমূলের সন্ত্রাসের দিন গুলিতে ভয় পাননি তিনি।তীব্র সন্ত্রাসের সময় মানুষের পাশে থেকে বুক চিতিয়ে লড়ে গেছেন তিনি।এমন একজন কমিউনিস্ট নেত্রী তো শাসকের রোষানলে পড়বেন ই।নেতাই কাণ্ডের পর তৈরি হয়েছিল ফুল্লরা মন্ডল কে জেলের ভিতরে রাখবার চিত্রনাট্য। একজন পঞ্চাশের উপরে বয়সের মহিলা(ফুল্লরা মন্ডল)নাকি হার্মাদের সশস্ত্র ক্যাম্প থেকে গুলি চালাতে চালাতে মানুষ খুন করতে করতে বেলাটিকরির দিকে পালিয়েছিল। ষড়যন্ত্র করতে গিয়ে সেদিন যে চিত্রনাট্য রচনা করা হয়েছিল তা হার মানায় বলিউডের কোনও রোমহর্ষক সিনেমাকেও।একজন ৫৬বছর বয়সী মহিলার পক্ষে এইভাবে গুলি চালিয়ে জঙ্গল পেরিয়ে খাল ,বিল পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে হয়ে যাওয়া সম্ভব কীনা তা আগামীদিনে আদালতেই প্রমাণ হবে।   

  শাসকের ষড়যন্ত্রের শিকার ফুল্লরা মন্ডলের আট বছরের জেল জীবন কেমন ছিল?এই সময় জেলে তাঁর উপরে চলেছিল অকথ্য মানসিক অত্যাচার। জেল বন্দি অবস্থাতেই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর মায়ের কিন্ত মায়ের শেষকৃত্যে অংশ নেওয়ার জন্য প্যারোলে মুক্তি মেলেনি তাঁর। জেলে থাকাকালীন তাঁকে দেওয়া হয়নি প্রয়োজনীয় ওষুধ। আট বছর ধরে বন্দি থেকেছেন, মেলেনি জামিন। অবশেষে জামিন মিলেছে তিনি এসেছেন জেলের বাইরে।   শুধুমাত্র  সিপিআই(এম)করবার অপরাধে ই তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল এতো অত্যাচার। তাহলে জামিনে মুক্ত হয়ে তো আর  সিপিআই(এম)-র ছায়া মাড়াবে না এই তো গড়পড়তা মধ্যবিত্তের চিন্তায় আসে।কিন্ত ফুল্লরা মন্ডলরা যে অন্য ধাঁচের মানুষ। তাঁরা যে কমিউনিস্ট। তাই জেল থেকে বেরোনোর পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান “যে সাড়ে তিনশো কমরেড শহীদ হয়েছেন তাঁদের সবার পরিবারের পাশে আমি থাকবো,এই শহীদ কমরেডদের অনেক কে আমি কোলে পিঠে মানুষ করেছি,শহীদ কমরেডদের রক্ত ঋণ শোধ করবো না।শহীদেরা আমাদের সাহস দিয়ে গেছেন। কোনও প্রতিশোধ নয় শ্রেণীহীন, শোষনহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই শহীদের ঋন শোধ হবে”।   

 এই হচ্ছেন কমরেড ইলা মিত্রের প্রকৃত উত্তরাধিকারী কমরেড ফুল্লরা মন্ডল শত সহস্র অত্যাচার সহ্য করে তিনি রয়ে গেছেন লাল ঝান্ডার সঙ্গে শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সৈনিক হিসেবে।