লুটের রাজনীতিতে মানুষ যন্ত্রণায় কাতর ও ক্ষুব্ধ হলেও তাঁদের প্রতিবাদকে সংগঠিত হতে দিচ্ছে না লুটেরা পুঁজিবাদ। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এরাজ্যের মানুষকে তারা হয় তৃণমূল, নয় বিজেপি এই দুই পক্ষের মধ্যে বেঁধে রাখতে চাইছে, যারা কেউই লুটের পথ বন্ধ করবে না। সোমবার সিপিআই(এম)’র বীরভূম জেলার ২৩তম সম্মেলনের উদ্বোধন করে একথা বলেছেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আভাস রায়চৌধুরি। 

কোভিড মহামারী পরিস্থিতিতেও আম্বানিদের মতো পুঁজিপতিদের সম্পদ কীভাবে বেড়েছে এবং বিপরীতে বেকারি ও দারিদ্র কীভাবে বেড়েছে সেই তথ্য উল্লেখ করে আভাস রায়চৌধুরি বলেছেন, সম্পদের লুট হচ্ছে, বৈষম্য বাড়ছে দেশজুড়ে। আমাদের রাজ্যের মানুষের অবস্থা কি তার থেকে আলাদা নাকি! রোজগার না থাকায় বেকাররা দুর্দশায়, মজুরি হ্রাসে শ্রমিকরা দুর্দশায়, ফসলের দাম না পেয়ে কৃষকরা আত্মহত্যা করছেন। বীরভূম জেলাতেই দেউচা-পাঁচামী দেখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে প্রকৃতি এবং এলাকার মানুষকে বিপদে ফেলে লুটের বন্দোবস্ত হচ্ছে। কিন্তু তার মানেই এই নয় যে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়ে যাবে। লুটে যারা লাভবান হচ্ছে, লুটের রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখার বন্দোবস্তও তারাই করে রাখছে। তারাই তৃণমূল বনাম বিজেপি, এই মেরুকরণে মানুষকে আটকে দিচ্ছে, দুই পক্ষের যেই জিতুক তাদের লাভ নিশ্চিত থাকবে।

তিনি বলেন, লুট আর গরিববিরোধী কাজে বিজেপি’র সঙ্গে তৃণমূলের কোনও ফারাক আছে নাকি! তৃণমূলও তো এখানে শ্রমিকবিরোধী শ্রমকোড আর কালা কৃষি আইন প্রয়োগই করে ফেলেছে। হ্যাঁ, বিজেপি’র সঙ্গে অন্য কোনও বুর্জোয়া দলের তুলনা চলে না, কারণ তাদের পিছনে আছে ফ্যাসিবাদী আরএসএস। কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গেও অন্য কোনও আঞ্চলিক দলের তুলনা চলে না। 

কেবলমাত্র বামপন্থীরাই যে লুটের রাজনীতি বন্ধ করে বিকল্প দিতে পারে সেকথা প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছেন আভাস রায়চৌধুরি। তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের খারাপ অবস্থা দেখে আত্মসমালোচনা করা, হতাশ মন্তব্য করা সহজ কাজ। কিন্তু এর মধ্যেও সম্ভাবনাটাকে দেখতে পাওয়া, দরকার হলে খুঁজে বের করে সামনে নিয়ে আসাটাও আমাদের কাজ। পুঁজির শোষণ যতদিন চলবে ততদিন কমিউনিস্ট পার্টিকে কেউ খতম করতে পারবে না। শ্রম আর পুঁজির দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত, সেটা ব্যবহার করেই আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারি। পরিস্থিতি খারাপ হলেও মোটেও সম্ভাবনাহীন নয়, পুরোপুরি সম্ভাবনা রয়েছে। তবে শুধু প্রত্যয় বুকে নিয়ে ঘরে বসে থাকলে সেটা হবে না। কেবল আনুষ্ঠানিক কিছু কর্মসূচিতেও হবে না। দুর্দশায় ক্ষুব্ধ মানুষের সমর্থন পাওয়ার মতো করে আন্দোলন করতে হবে।

কিন্তু সেই কাজটাই যাতে সফল না হয়, তার জন্য মিডিয়া সহ সবরকম প্রচারের ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে মানুষের মনে তৃণমূল বনাম বিজেপি’র যুদ্ধ যুদ্ধ ভাবকে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন আভাস রায়চৌধুরি। তিনি বলেছেন, অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য কেবল মানুষের দুঃখ দুর্দশাই যথেষ্ট নয়, তাঁদের মধ্যে বাইরে থেকে চেতনা নিয়ে যাওয়ার কাজটা কমিউনিস্টদেরই করতে হবে। মানুষের বিশ্বাস ভরসা যদি অর্জন করতে না পারি তাহলে সেটা করা যায় না, এমন আন্দোলন কর্মসূচিই নিতে হবে যাতে মানুষের ভরসা আমরাই পেতে পারি। মানুষ তো এমন রাজনৈতিক শক্তিকেই খুঁজছে। 

সিউড়ির রবীন্দ্র সদনে অনুষ্ঠিত এই জেলা সম্মেলনে সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করার সময়ে সিপিআই(এম) বীরভূম জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক গৌতম ঘোষও বলেছেন, দেউচা পাঁচামীর মানুষ উচ্ছেদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাঁদের প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংগঠিত করতে হলে সেখানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। নইলে মানুষের মন স্পর্শ করা যাবে না। 

সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের ওপরে আলোচনার সময় জেলার বিভিন্ন এরিয়া কমিটির প্রতিনিধিরা বলেছেন, ত্রুটি ও ঘাটতি আছে, কিন্তু পার্টিকর্মীরা মানুষের প্রতিবাদকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। সমস্যা হলো, সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের শাসকদলের দুষ্কৃতীবাহিনী এবং পুলিশের আক্রমণ নেমে আসছে।

এই প্রসঙ্গে আভাস রায়চৌধুরি বলেছেন, ওরা তিন কায়দায় আক্রমণ করবে, তার মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। প্রথমত, সরকারে থাকার সুবাদে নানারকম হামলা নামিয়ে আনবে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের ওপরে। দ্বিতীয়ত, শ্রমজীবী গরিব মানুষকে ধর্মের নামে, জাতি ও ভাষার নামে ভাগাভাগি করে দেবে। তৃতীয়ত, ব্যক্তি সুবিধাভোগী তৈরির নামে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের সামনে ভালোভাবে জীবনযাপনের এক ধরনের গাজর ঝুলিয়ে রাখবে। দুয়ারে সরকার থেকে হরেক রকমের শ্রী এবং ভাণ্ডারের যে গল্প সরকারের থেকে বলা হচ্ছে সেগুলোর সুবিধা সব মানুষ পাচ্ছে না, কিন্তু সবাই ভাবছে প্রতিবাদে সমবেত হতে গেলে যদি আমাকে এর থেকে বঞ্চিত করে দেয়। সুবিধা থেকে বাদ যাওয়ার আশঙ্কা বুনে দিয়ে মানুষকে চুপ করিয়ে রাখার কৌশল এটা।

সিপিআই(এম)’র সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, সরকারী প্রকল্পের টাকা কোনো মন্ত্রী বা নেতার পৈতৃক সম্পত্তি নয়, তার হক সবার। তাহলে আমরা সব সরকারী প্রকল্পের সুবিধা যাতে সব মানুষ পায় তার জন্য ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করবো না কেন? আমরা গরিবের পাশে দাঁড়িয়ে দাবি করবো তাঁদের সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী প্রাপ্য দেওয়ার জন্য। নিশ্চিতভাবে বলা যায় দিতে ওরা পারবে না, কারণ লুটের রাজনীতিতে সরকারী তহবিলের অবস্থাও ভালো নয়। কিন্তু কেবল আমাদের ইতিবাচক হস্তক্ষেপেই মানুষের মোহভঙ্গ হতে পারে। 

সোমবার দুপুরে সিউড়ি শহরের রেডক্রশ থেকে  সিপিআই(এম)’র জেলা সম্মেলন উপলক্ষে একটি মিছিল বের হয়। পার্টির রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রামচন্দ্র ডোম, আভাস রায়চৌধুরী, রাজ্য কমিটির সদস্য গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি, শ্যামলী প্রধান, ভারপ্রাপ্ত জেলা সম্পাদক গৌতম ঘোষ সহ নেতৃবৃন্দ ও সম্মেলনের প্রতিনিধিরাও এতে অংশ নেন। মিছিল রবীন্দ্র সদনে এসে পৌঁছনোর পরে সম্মেলন উপলক্ষে পার্টির রক্তপতাকা উত্তোলন করেন সূর্য মিশ্র। পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমও সম্মেলনে উপস্থিত রয়েছেন। শহীদ বেদীতে মাল্যদানের পরে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছে, শেষ হবে মঙ্গলবার। পার্টির বীরভূম জেলার নেতা ভরত পাল, দুকড়ি রাজবংশী, পল্টু কোড়া, মহম্মদ কামালউদ্দিন ও কবিতা রায়কে নিয়ে গঠিত সভাপতিমন্ডলী সম্মেলন পরিচালনা করছে।

সুত্র- গণশক্তি