একদা এক দরিদ্র কৃষক ছিল। সে ধনপতি জমিদারের গৃহে গমন করল। ছোটবেলা থেকেই আমরা এরকম গল্পে অভ্যস্ত। কৃষক গরীব হবে, জমিদার ধনবান। কৃষকের গৃহে বৃদ্ধ অসুস্হ পিতা মাতা। বৃদ্ধ অসুস্হ পিতা মাতা কি জমিদারের বাড়িতে থাকতে পারেন না? থাকলেও সমস্যা নেই, কারণ জমিদার অর্থবান। আমরা এই সমীকরণে আমাদের মস্তিষ্কে কোডিং করে নিই শৈশবে। দারিদ্র থেকে উত্তোরণ জীবনভোর দেখা স্বপ্নালু গল্প হয়। আমাদের অবচেতন মনের স্বপ্নকে চলচ্চিত্র নির্মাতারা আমাদের কাছে বিক্রী করেন। এই সামাজিক ও অর্থনৈতিন পরিকাঠামোকে ধরে রাখতে রাজনীতিবিদ খলনায়ক হবেন। আদর্শবান বিপ্লবী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে সরু গলির ভিতর অন্ধকারে নীরবে পেট চিরে দেবে, কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদের সাথে নায়কের লড়াই হবে ডার্বি ম্যাচ। অনেক ফাঁকা ড্রাম উল্টেপাল্টে একাকার। পেটোয়া গুন্ডারা একে একে সঙ্ঘর্ষে ঘায়েল হলে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতার পালা। হাততালি। দর্শক অন্ধাকার পেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে বিকট বাস্তবে বিলীন হয়ে যায়। ড্রেনে পড়ে থাকে সিনেমার টিকিট।

পুলিশ অসৎ হবে কিন্তু সরকার ওঠাপড়াতেও সৎ হবে না। সেনাবাহিনীর জওয়ান কিন্তু লড়াকু চরিত্র। সরকারী ব্যাঙ্ক, বীমা সহ পরিষেবামূলক সংস্হাগুলো বেসরকারী প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে মোকাবিলা করতে পরিবর্তন আনবে। সিবিআই বা ইডির সে সমস্যা নেই। কোন কাউন্টারে দাঁড়িয়ে তদন্তকারী সংস্হার কর্মীকে দু চার কথা শুনিয়ে দিতে পারবেন না। কোন অপরাধের তদন্ত ধীর হয়, তারপর শুরু হয় দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া। আমরা এসবে অভ্যস্ত। কিন্তু কোন বিচারপতি যদি তদন্তকারী সংস্হাকে বলেন, “আপনাদের কাজ কি মানুষকে বোকা বানানো? … এই মামলায় আর কোন আধিকারিকের প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রীকে প্রয়োজন।” তাহলে মনে হতেই পারে, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। বিচার ব্যবস্হা দ্রুত জনগনের থেকে কেড়ে নেওয়া অধিকারের নিষ্পত্তি চাইছেন। তদন্তকারী সংস্হা চাইছে না। সে দায় তিনি কোন আধিকারিকের ঘাড়ে চাপাচ্ছেন না। উনি প্রধানমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় হাজির করছেন। প্রধানমন্ত্রী কোন ব্যক্তি নয়। মসনদের ক্ষীর খাওয়া ক্ষমতার ধারাবাহিক শোষনের রক্ত ও ঘামের চিহ্ন।

সেই বিচারপতি হয়ত আগামী বছর অগাষ্ট মাসের পর এক সাধারণ নাগরিক হয়ে যাবেন। প্রধানমন্ত্রীর টুপিতে ঐতিহাসিক পালক লাগিয়ে দিলেন। এই প্রধানমন্ত্রী যে রাতারাতি শুধরে নেবেন, তা কিন্তু নয়। রাজা রামমোহন রায় তাঁর নিজস্ব সামাজিক প্রতিষ্ঠার উপর দাঁড়িয়ে সতীদাহ রদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেছেন। ১৮২৯ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক আইন না করলে আরো দীর্ঘ কাল হয়ত বহু নারীর পোড়া মাংসের গন্ধে ভরপুর থাকত সমাজ। কিংবা বিধবা বিবাহের পক্ষে বিদ্যাসাগর জনরব তোলেন। ১৮৫৬ সালে লর্ড ডালহৌসি সংখ্যালঘুদের দাবীকে মান্যতা দিয়ে আইন মোতাবেক বিধবা বিবাহকে সিদ্ধ ঘোষণা করেন। ভাল হবার একটা সামাজিক রানওয়ে দরকার, উড়তে দরকার সুদক্ষ বৈমানিক। ১৯৯৬ সালে সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায় লোকসভায় মহিলা সংরক্ষণের বিল প্রথম পেশ করেন। ২৭ বছর পর লোকসভায় গৃহীত হল ৪৫৪-২ ভোটে। এত সমর্থন থাকলে মানুষের বুঝতে ৭৬ বছর লাগল কেন? এখানেই গোলকধাঁধা। সবাই বলছেন, সঠিক তদন্ত ও দ্রুত বিচার চাই। তবু প্রধানমন্ত্রীকে খুঁজতে হয়।

প্রধানমন্ত্রীর রামমন্দিরের প্রয়োজন ছিল। গুজরাত দাঙ্গা থেকে চিরতরে মুক্তির প্রয়োজন ছিল। বিলকিস বানুর ধর্ষকদের খালাসের প্রয়োজন ছিল। এসব হয়েছে। জটিল নোটবন্দী কিংবা তালি থালি বাজিয়ে করোনা দূর করার পরিকল্পনা ছিল। বাদ যায়নি। তাহলে হয়নি কোনটা? চিটফান্ডের তদন্ত সাড়ে ৯বছরে হয়নি। সেখানে অনেক দলিল দস্তাবেজের প্রয়োজন ছিল। নারদ কান্ডে বিভিন্ন ব্যক্তির ঘুষ নেবার তদন্ত সাড়ে ৭বছরে হয়নি। যা হবার নয়, তা চোখের আড়ালে থাকলেও হবে না, চোখের সামনে থাকলেও হবে না। এমনকি দুর্ঘটনা বশতঃ যাতে সে ছবি দেখতে না হয়, তাই এথিক্স কমিটি বসতেই পারল না। অথচ প্রধানমন্ত্রীর দল দামামা বাজিয়ে রাজ্য দপ্তরে বসে ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো দেখলেন। তাই বিচারপতি বলছেন, “প্রধানমন্ত্রীকে প্রয়োজন।” সহজার্থে “প্রধানমন্ত্রীর কী প্রয়োজন?” কয়লা, গরু, বালি পাচার যদি প্রধানমন্ত্রীর প্রয়োজন হয়, তাহলে কমবেশী চলবে। দেশের জনগন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিতে ভোট দেন, স্বার্থপর জনগন ভাবেন না, প্রধানমন্ত্রীর কী প্রয়োজন? বিচারপতি এক নয়া ভাবনার জন্ম দিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর অধীনে থাকা এক সংস্হাকে বিচারপতির ভর্ৎসনা, “… মনোভাব ঢিলেঢালা। কোর্ট নির্দেশ দিলে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়েছে। স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে কিছু করেনি। … এক বছর আগে নির্দেশ দিয়েছি। কিছুই হয়নি।” এক বছর তো দূরের কথা, দশ বছর আগের প্রতিশ্রুতি ছিল প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে পনেরো লাখ, বছরে দু কোটি কর্মসংস্হান। এবার প্রতিশ্রুতির ম্যানিফেস্টো বানিয়ে ভোট চাইতে আসলে জনগন প্রশ্ন করুক, প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর কী প্রয়োজন। জনগন যদি সে প্রয়োজন পূরণ করতে না পারেন, তাহলে ভোট দেবেন না। প্রধানমন্ত্রীর যদি প্রয়োজন হয় নীরব মোদী, মেহুল চোক্সি বা ললিত মোদী থেকে বিনয় মিশ্রদের নাদির শাহের মত লুঠ করে ভারতছাড়ো আন্দোলন, তবে সে চাহিদা জনগন পূরণ না করতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রী নিরলস সাহিত্য সেবা করবেন, হেলিকপ্টার ভ্রমণ করবেন, বিদেশে মর্নিং ওয়াকের ছবি তুলবেন, পুজো কমিটিকে ৭০হাজার অনুদান দেবেন। ভোটার ভাববেন সেই ব্যয় ভার তাঁরা বহন করতে পারবেন কিনা! নয়ত কার্নিভালের নায়কদের বিদায় দিন।

হতে পারে শিল্পপতিদের বিশেষ প্রধানমন্ত্রীকে প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে কোন গোপন বন্ধুদের প্রয়োজন। বিকল্প প্রধানমন্ত্রীরও সেই বন্ধুকেই প্রয়োজন। বন্ধু তখন কী করবেন? এক দিকে আম, দই, কুর্তা, পাজামা, পদিপিসির বর্মীবাক্স নিয়ে যাবেন, আবার বিকল্প প্রধানমন্ত্রীকে মাই ফেভারিট বলে সাত তারা হোটেলে মধ্যমণি হয়ে বসবেন। এসব খরচ কিন্তু ভোটারদের বইতে হয়। আপনি ঢাকের দায়ে মনসা বিকোবেন কিনা ঠিক করুন। আজকাল সরকারী আধিকারিকদের ঘাড়ে TAT বা Turn Around Time চাপিয়ে দেওয়া হয়। যে কোন কাজে নির্ধারিত সময়সূচী থাকবে। ভোটাররা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরির বর্ণচ্ছটা দেখেন কিন্তু TAT উল্লিখিত থাকে না। জনগন প্রধানমন্ত্রীকে কবে প্রশ্ন করবেন, কাজটা হল না কেন? কোন আধিকারিককে নয়। আধিকারিকদের দিয়ে কাজটা সম্পন্ন করবেন বলেই তো প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার স্বতন্ত্র। নইলে পাঁচ বছর পর একই প্রতিশ্রুতি কপি অ্যান্ড পেস্ট করে উপস্হাপিত করবেন। প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীরও প্রয়োজন স্পষ্ট উল্লিখিত থাক।

মুখ্যমন্ত্রীর যদি আকাঙ্খা থাকে সাহিত্য একাডেমি পুরষ্কার, দ্রুততার সাথে জনগনকে বইয়ের রয়ালটি বাড়িয়ে সাহিত্যের উৎকর্ষতাকে গগনচুম্বী করতে হবে। তার একটা TAT থাকবে। অপরদিকে জনগনের দাবী যদি হয় সরকারী শূণ্যপদে দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ, তারও TAT থাকবে। জনগন কেবল শস্তায় ভোট দিচ্ছেন, হিসাব করে অধিকার বুঝে নিচ্ছেন না। অবশ্যই তাঁর পরিবারের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু তার ভগ্নাংশ বৃদ্ধি আপনার সম্পদের হল কিনা মেপে নিন। তাহলে আর কোন দিদিকে বলার দরকার নেই, দুয়ারে সরকারের দরকারও নেই। দরকারটা দুয়ারে আসবে। আপনার স্বপ্ন, চাহিদা, ভবিষ্যতের দামের ভাড়া মাসিক ৫০০ বা হাজার টাকা হতে পারে না। একবার এই বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে ক্রমশঃ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। এবার সব রাজনৈতিক দলগুলো জনগনকে নিলামে তুলবে। ৫০০ থেকে আড়াই হাজার দর উঠবে, গোয়া হলে পাঁচ হাজার। তার বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর কি চাই জেনে সেই বিনিময় প্রথা মনপসন্দ হল কিনা দেখুন। বিচারপতির বক্তব্যে গভীর সারবত্তা ও দিক নির্দেশ আছে।

চিটফান্ড থেকে নারদ, কয়লা-বালি-গরু পাচারের দ্রুত তদন্ত প্রধানমন্ত্রীর প্রয়োজন ছিল না বলে হয়নি। সে কৈফয়েৎ কোন আধিকারিককে দিতে হবে না। চন্দ্রযান-৩ কি প্রধানমন্ত্রী উৎক্ষেপণ করেছেন? ইসরোর বৈজ্ঞানিকদের দীর্ঘ দিনের কঠিন পরিশ্রম ও মেধার ফসল। যখন সেই অভিযান চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করল, তখন ভাগ্যক্রমে কেউ দেশের প্রধানমন্ত্রী বা বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ঠিক সেই রকম তদন্তকারী সংস্হাগুলিকে যদি উদ্যমী হবার সুযোগ দেওয়া হত, প্রধানমন্ত্রী নির্বিশেষে সঠিক সময়ে কাজ শেষ হত। আফশোস, যথা সময়ে কার্যকাল শেষ হবে অচিরাচরিত বিচারপতিদের। শেষ কয়েকটা বল ব্যাকফুটে খেলে আবার স্টেপ আউট করে ছক্কা মারবেন এই শ্লথ প্রধানমন্ত্রী। নেতারা জানবেন, দুর্নীতির জাহাজ বিচার ব্যবস্হার হিমশৈলে ধাক্কা খেলেও ডোবে না। চারা ঘোটালার স্টিমার ভাগ্যদোষে ডুবতে পারে তবে সেটা ব্যতিক্রমী। বিচারপতি শুদ্ধিকরণে দ্রুত বিচার চান, তা ব্যতিক্রমী। তদন্তকারী সংস্হা জনহিতে কাজ করবে, তাও ব্যতিক্রমী। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে তৎপর হবেন- কষ্ট কল্পনা।

কেউ কেউ সময়ের আগে কথা বলেন। তাঁদের দার্শনিক বা পাগল বলা হয়। “প্রধানমন্ত্রীকে প্রয়োজন” শব্দবন্ধের অর্থ উদ্ভাবন করতে পারলে নিশ্চিত হওয়া যাবে, দেশ অগ্রগতির পথে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরে প্রধানমন্ত্রী পাচিল তুলে দারিদ্র ঢাকবেন, নাকি সমভোগে দারিদ্র দূরীকরণ করবেন, তা নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর কী প্রয়োজন। পুরোহিত-মৌলবী ভাতা নাকি মেধা ভিত্তিক নিয়োগ, সেটাও মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়োজন। তবে এটা খুব স্পষ্ট কথা, মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে উন্নয়ন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে চান না। প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর ভোটের প্রয়োজন সরকার গঠনের জন্য। মানুষের দুয়ারে সরকার দরকার নয়, উন্নয়নটা চাই। কেন তদন্তকারী সংস্হাগুলি শ্লথ, কোথায় ব্যর্থতা তা প্রধানমন্ত্রীর এগিয়ে এসে বলা দরকার। মুখ্যমন্ত্রীর পাঠানো নয়া কুর্তা পাজামা পরে সম্ভব নয়। ওখানেই উন্নয়নের হাওয়া মোরগ। তার মুখ ঘুরে আছে কালীঘাটের সম্পদের দিকে, আম্বানি-আদানির প্রাসাদ থেকে জয়শাহের বিপুল সাফল্যে। আর কোন আধিকারিকের প্রয়োজন নেই, প্রধানমন্ত্রীকে প্রয়োজন। তেমনই প্রধানমন্ত্রীর তল্লাশে দেশ।