পশ্চিমবঙ্গের মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জী উপস্থিত থাকলে  কোন সভা প্রশাসনিক আর কোন সভা রাজনৈতিক  এখন সত‍্যিই বোঝা মুশকিল। নবান্ন থেকে নেতাজী ইণ্ডোর স্টেডিয়াম – মুখ‍্যমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলন হোক অথবা ধর্মগুরুদের সভা কিংবা পুজো কমিটির সঙ্গে বৈঠক – সংকীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক প্রচারের অভ‍্যাস ছাড়তে পারেন না মমতা ব‍্যানার্জী। যত বেশি করে দুর্নীতি থেকে র‍্যাগিং তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত ব‍্যক্তিদের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে ততই এ বিষয়ে অসহিষ্ণুতা দেখা যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস সর্বাধিকনায়িকার। আদালতের নির্দেশে যে সংস্থাগুলি নিয়োগ দুর্নীতির  তদন্ত করছে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি যেমন কটুক্তি করছেন,তেমনি সিপিআই(এম) কেও মিথ‍্যা দোষারোপ করছেন আবার পুজো কমিটি গুলির অনুদান একলাফে দশহাজার টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার পরেই মন্তব্য করেছেন,” বাইরে কিছু

আরশোলা বসে আছে যারা হয়ত পিআইএল করে দেবে এই অনুদান কেন দেওয়া হচ্ছে,তাই নিয়ে!” সমালোচক ও বিরোধীপক্ষকে তিনি কি নজরে দেখেন প্রতিদিন বোঝা যায়। এখন মুখ‍্যমন্ত্রী হিসাবে এবং অতীতে বিরোধী নেত্রী হিসাবে কখনোই গণতান্ত্রিক মূল‍্যবোধের ধার ধারেন নি মমতা ব‍্যানার্জী। মুখ‍্যমন্ত্রীর আসনে বসে সংবিধানকে অগ্রাহ‍্য করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার নজিরও রয়েছে।

দুর্গাপূজার আর দু মাস ও বাকি নেই। তাই গত ২২শে আগষ্ট নেতাজী ইণ্ডোর স্টেডিয়ামে রাজ‍্যের বিভিন্ন  দুর্গাপূজা কমিটির কর্মকর্তাদের  সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনিক কর্তাদের বৈঠক ডেকেছিলেন মুখ‍্যমন্ত্রী। সেখানেই ঘোষণা করা হয়, এ বছর পুজো কমিটিগুলোর অনুদান সত্তর হাজার টাকা করে করা হল। গত বছর এই অনুদানের অঙ্ক ছিল ষাট হাজার টাকা করে। গত বছর মোট ৪২ হাজার  ২৮ টি পুজো কমিটি এই অনুদান পেয়েছিল। এছাড়া গত বছরের মত এ বছরও পুজো মণ্ডপের বিদ‍্যুতের খরচের মাত্র ৩৩ শতাংশ দিতে হবে পুজো কমিটিগুলোকে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন দপ্তর আলাদা করে বিজ্ঞাপন দেবে পুজোমণ্ডপে। তার জন‍্য আলাদা অর্থও দেওয়া হবে পুজোকমিটিগুলিকে। মুখ‍্যমন্ত্রী মনে করিয়ে দিয়েছেন, দুর্গাপূজার সময়   ষাট হাজার কোটি টাকার বাজার তৈরি হয়। এই যুক্তিতে বিভিন্ন এলাকার সার্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটিকে আর্থিক অনুদানের বরাদ্দ অর্থ প্রতিবছর বাড়িয়ে চলা যায় কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর  মুখ‍্যমন্ত্রী স্বয়ং ও তাঁর অনুগামীরা দিতে  পারবেন। তবে এই ঘোষণার সময় মুখ‍‍্যমন্ত্রীর সঙ্গে একই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন রাজ‍্যের দুই মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও সুজিত চক্রবর্তী। এই ঘোষণায় তাঁদের মুখে তৃপ্তির হাসি ফোটা  অস্বাভাবিক নয়।  দমকল মন্ত্রী সুজিত বসু লেকটাউন এলাকার একটি বড়ো পূজোর প্রধান কর্মকর্তা এবং বিদ‍্যুৎ,ক্রীড়া ও যুবকল‍্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের কাঁধে নিউ আলিপুরের পুজোর পুরোন দায়িত্বের  সঙ্গে এখন নাকতলার একটি বিখ্যাত   দুর্গাপূজার দায়িত্ব। কারণ জেলবন্দী প্রাক্তন মন্ত্রীর অনুগামীরা অভিভাবকহীন আর কতদিন থাকতে পারেন? ২০১৮ সালে দশ হাজার টাকা অনুদান পাঁচ বছরের মধ‍্যে সত্তর হাজারে পৌঁছে গেল যে রাজ‍্যে সেই রাজ‍্যের মুখ‍্যমন্ত্রী প্রায়ই হাহাকার করেন আর্থিক অনটনের। সঙ্গত কারণেই বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা কমলেশ্বর মুখোপাধ‍্যায়  সোশ‍্যাল মিডিয়ায় বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেছেন, ৭০০০০ টাকায় সরকারি বিদ‍্যালয়ে বই  খাতা দেওয়া যেত। বড় বড় পুজোর বাজেট তো কোটিতে হয়। আর পুজোর  দাদার  খাটের নীচে কয়েকশো কোটি টাকা  পাওয়া যায়।

  প্রাথমিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ  রাষ্ট্রের কোন অঙ্গরাজ‍্যে নির্দিষ্ট কোন ধর্মীয় উৎসবে সরকারের কোষাগার থেকে অর্থ অনুদান হিসাবে দেওয়া আইনসিদ্ধ বলে বিবেচিত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ২০১৮ সালের দুর্গাপূজার আগে পুজো কমিটিগুলোকে  এই অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত চ‍্যালেঞ্জ করে  আদালতে যাওয়া হলে কলকাতা হাইকোর্টে রাজ‍্যসরকারের অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করা “অসাংবিধানিক ” বলে খারিজ করে দিলেও সুপ্রীম কোর্টে এই মামলা পুর্নবিবেচনা করা হয়। সর্বোচ্চ আদালত এই অনুদানের  সিদ্ধান্তের ওপর অন্তর্বর্তীকালীন  স্থগিতাদেশ না দিলেও আর্থিক অনুদানের খরচের হিসাবে  পুলিশের নজরদারি থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টে রাজ‍্য সরকারের হলফনামা দাখিল করেছিল যে পুজো উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের  ” সেভ ড্রাইভ :- সেফ লাইফ”  পরিবহন ও যাত্রী সুরক্ষা প্রচারের জন‍্য পুজো কমিটিকে এই অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। তথ‍্যটি কতটুকু সঠিক ছিল তা নিয়ে সংশয় থাকলেও পুজো কমিটির আড়ালে থাকা ক্লাব গুলির তহবিলে অন্তত দেড়লক্ষ  টাকার যোগান নিশ্চিত করার পাকা বন্দোবস্ত করার রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্য রয়েছে তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। ২০১১ সালের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন  পাড়ার ক্লাব থেকে কলকাতা  ময়দানের নামজাদা ক্লাবের কার্যকরি সমিতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের  আধিপত্য বিস্তারের অন‍্যতম একটি কারণ, বিনা পরিশ্রমে সরকারের তহবিলের টাকা রোজগারের প্রলোভন তো বটেই। স্বার্থান্বেষী রাজনীতির টানাপোড়েনের সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ যা সম্প্রতি নিয়োগদুর্নীতি তদন্ত চলাকালীন সামনে এলো,তা হল অন‍্যতম অভিযুক্ত হিসাবে জেলবন্দী কালিঘাটের কাকু ওরফে সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র তাঁর পাড়ার একটি ক্লাবের কার্যকরি সমিতিতে ঢোকার জন্য ভোট নিশ্চিত করতে একজন যুবকের সরকারি  চুক্তি ভিত্তিক চাকরির ব‍্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। মোট কথা, মমতা ব‍্যানার্জীর মুখ‍্যমন্ত্রীত্বে পশ্চিমবঙ্গে বহু যুগ্ম যাবৎ পাড়া ও ক্লাবের সংস্কৃতি বিনা পরিশ্রমে রোজগারের লোভ আর গা জোয়ারির  রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের মোহে অনেকটাই নষ্ট করা হয়েছে।  পুজো কমিটির অনুদান সেই আধিপত্য বিস্তারেরই অংশ। কর্মসংস্থানের ন‍্যূনতম ব‍্যবস্থ‍্যা করতে ব‍্যর্থ এই সরকার যুব সমাজকে বোঝাতে  চাইছেন পুজো করে, উৎসব  করে রোজগার করো।

গত বছর এই অনুদানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটি আইনজীবী সংগঠন হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন, পুজোর অনুদান বাবদ এত বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করা হলে রাজ‍্য সরকারি কর্মীদের প্রাপ‍্য ডি এ দেওয়া হচ্ছে না কেন- এই প্রশ্ন তুলে। বিচারপতি প্রকাশ  শ্রীবাস্তব এবং বিচারপতি   রাজর্ষি ভরদ্বাজ মামলার শুনানি চলাকালীন অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশ দিয়েছিলেন,নির্দিষ্ট কিছু বিষয় খতিয়ে দেখে শর্তসাপেক্ষে এই অনুদান বিতরণ করার জন‍্য। তাঁরা ছয়টি নির্দেশিকাও তৈরি করে দিয়েছিলেন যদিও শাসক দলের আনুকূল্যে চলা ক্লাবের কর্মকর্তারা জানতেন শাসকদলের নেতা নেত্রীদের সঙ্গে বোঝাপড়া থাকলেও সেই নির্দেশিকাগুলো না মানলেও খুব ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। 

এ বছরও তাই নিয়োগের দাবিতে অবস্থানরত কর্মপ্রার্থী যুবক যুবতীদের চোখের সামনে দিয়ে বাছাই করা প্রতিমা বিসর্জনের যে কার্ণিভ‍্যালের প্রস্তুতি দেখবেন সেই প্রতিমার পূজার জন‍্য সত্তর হাজার টাকা খরচ করা হবে। প্রতিবাদ করলেই আপনাকে দুর্গাপূজা বিরোধী বলে চিহ্নিত করে দেওয়া হবে শাসকদলের পক্ষ থেকে।