এশীয় শক্তির উত্থানের চেয়ে বড়ো ঘটনা এখনো পর্যন্ত কাতার বিশ্বকাপে ঘটেনি। চার বারের বিশ্বচ‍্যাম্পিয়ন জার্মানিকে প্রথ=ম ম‍্যাচে ২-১ গোলে পরাজিত করেছে জাপান এবং দ্বিতীয় ম‍্যাচে ওয়েলসকে ২-০ গোলে হারিয়ে ইরান চমকে দিয়েছে তাবৎ ফুটবল বিশ্বকে। আসলে ইউরোপে পেশাদার ফুটবলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিভাবান ফুটবলারের এখন নিয়মিত খেলেন। এশিয়ার উন্নত ফুটবল রাষ্ট্রের খেলোয়াড়েরাও তাঁদের মধ‍্যে রয়েছেন। ইউরোপীয় ফুটবলে এশীয় দেশের মধ‍্যে জাপান,ইরান,দক্ষিণ কোরিয়ার খেলোয়াড়েরা সংখ‍্যায় বেশি। আপাতত ইরানি স্ট্রাইকার মেহেদি তেরেমি, দুই মিডফিল্ডার সামান ঘুদ্দোস, আলি রেজা জাহানবকশ, ডিফেন্ডার সাদেক মোহরামি ইউরোপে নজর কেড়েছেন। জাপানের ফুটবলতারকা অবশ‍্য ইপিএলে সংখ‍্যায় বেশি। তাকেহিরো তোমিসায়ূ,তাকেফুসা কুবো, তাকুমি মিনামিনো,মায়া ইয়োশিদা যাঁরা জার্মানির বিরুদ্ধে নজর কেড়েছেন তাঁরা অনেকেই ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে নিয়মিত খেলেন। রাইট উইঙ্গার কুবো খেলেন স্পেনে। জার্মানির ন‍্যয়ারের মত গোলরক্ষককে একেবারেই অপ্রস্তুত করে দুরূহ কোণ থেকে গোল করে টাকুয়ামা আসানো বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রথমবারের মতো কোনো ইউরোপীয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিজের দেশকে জিতিয়ে দিলেন। অথচ বত্রিশ মিনিটে গুন্দোগান যখন পেনাল্টি কিকে প্রথম গোল করে জার্মানিকে যখন এগিয়ে দিয়েছিলেন তখন কেউই ভাবতে পারেন নি যে পঁচাত্তর মিনিটে ডোয়ান গোল শোধ করে দেবেন এবং তিরাশি মিনিটের গোলে এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রথম ম‍্যাচে হারতে হবে জার্মানিকে। ইরানের প্রথম ম‍্যাচে অবশ‍্য কোন চমক ছিল না। শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ইংল‍্যাণ্ডের কাছে ৬-২ গোলে পরাজিত হয়েছিল তারা। কিন্তু গ্রেট ব্রিটেনে ইংল‍্যাণ্ডের প্রতিবেশী ওয়েলসের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ম‍্যাচে অন‍্যচেহারায় দেখা গেল ইরানকে। পর পর আক্রমণে গিয়ে কার্লোস কুইরোজের প্রশিক্ষিত দলটি গ‍্যারেথ বেলের মত সুপার স্টার ফুটবলার সমৃদ্ধ ওয়েলসকে বিভ্রান্ত করে দেয়। গ‍্যারেথ বেলকেও নিষ্প্রভ দেখালো গোটা ম‍্যাচে। ধৈর্য হারিয়েই ইরানের স্ট্রাইকার মেহেদি তারেমিকে বিশ্রী ফাউল করে লাল কার্ড দেখেন ওয়েলসের গোলরক্ষক রেনেসি। এর ফলেই ছন্দ হারিয়ে ফেলে ওয়েলস। খেলার অতিরিক্ত সময়ে রাউজবের চেশমি ও রামিন রাজেয়ান পর পর দুটি গোল করেন।

অবশ‍্য কাতারে বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে অনেক হিসাব উল্টে দিয়ে। অবশ‍্যই দুই বড়ো টিম আর্জেন্টিনা ও জার্মানির পরাজয় যদি অঘটন বলে গণ‍্য করা হয় তাহলে আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারানো সৌদি আরব এবং জার্মানিকে ২-০ গোলে হারানো জাপানকে কুর্ণিশ জানাতে হয় অসাধারণ ফুটবল খেলে জায়ান্ট কিলার হিসাবে নিজেদের প্রমাণ করার জন‍্য। মরক্কো কার্যত গতবারের রানার্স আপ ক্রোয়েশিয়াকে আটকে দিয়েছে এবং টিউনিশিয়া ডেনমার্ক কে ইংল‍্যাণ্ড নেদারল্যান্ড ,স্পেন, ফ্রান্স,পর্তুগাল,বেলজিয়াম ও ব্রাজিলের প্রথম ম‍্যাচে জয় প্রত‍্যাশিত ছিল। আবার দ্বিতীয় ম‍্যাচেই আটকে গেল ইংল‍্যাণ্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। জনপ্রিয় তারকাদের মধ‍্যে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, আর্জেন্টিনার মেসি,ডি মারিয়া হতাশ করেছেন, হতাশ করেছেন জার্মানির মূলার, গোৎসে, ক্রোয়েশিয়ার লুকা মড্রিচের মতো খেলোয়াড়েরা কিন্তু যা লক্ষ‍্যনীয় তা হল প্রথম দিন থেকেই কাতার বিশ্বকাপের আসর গণতান্ত্রিক অধিকার, লিঙ্গসাম‍্যের অধিকারের পক্ষে এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মঞ্চে পরিণত হয়েছে। কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক দেশ হিসাবে নিজেদের কঠোর সামাজিক ও ধর্মীয় রীতির বিশেষ পরিবর্তন ঘটায়নি। সমকামী,রূপান্তরকামীদের মর্যাদা দূরে থাক মান‍্যতা দেয়না কাতার। ফলে প্রতীকি প্রতিবাদ স্বরূপ অংশগ্রহণকারী অনেক দেশের খেলোয়াড় ও সমর্থকদের জার্সিতে,পতাকায় রামধনু রঙ, One Love লেখা থাকছে। জার্মানির মন্ত্রী ন‍্যান্সি ফিজার ওয়ান লাভ লেখা ব‍্যাণ্ড বাহুতে পরে ছিলেন দর্শকাসনে। স্টেডিয়ামে মদ‍্যপান নিষিদ্ধ করার সপক্ষে অবশ‍্য খোদ ফিফা দাঁড়িয়েছে কাতারের পাশে।

তবে প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশে সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন ইংল‍্যাণ্ডের সঙ্গে প্রথম ম‍্যাচে ইরানের ফুটবলারেরা। শাস্তি হবে জেনেও ইরানের ফুটবলাররা জাতীয় সংগীত না গেয়ে প্রতিবাদ করছেন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। যদিও ওয়েলসের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ম‍্যাচেই দেশের মৌলবাদী শাসকের কঠোর শাস্তির হুমকির ফলে মৃদু স্বরে কন্ঠ মিলিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু শরীরীভাষাতেই বোঝা যাচ্ছিল তাঁদের প্রবল অনিচ্ছা ও শাসকের প্রতি ঘৃণা।সেদেশের জনপ্রিয় ফুটবলার ভোরিয়া ঘাফৌরি জেলে রয়েছেন শাসকের সমালোচনা করার অপরাধে। তাঁকে বাদ দিয়েই বিশ্বকাপে দল পাঠিয়েছে ইরান। এই উদাহরণ দেখিয়েই রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে ইরানের ধর্মান্ধ শাসক। কিন্তু হিজাব নিয়ে জোরজুলুম এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্তব্ধ হয়নি কাতার বিশ্বকাপে। ধর্মীয় মৌলবাদীদের শাসানি ফুৎকারে উড়িয়ে ইরানের মেয়েরা এসেছেন গ‍্যালারিতে হিজাব না পরেই পশ্চিমী পোশাকে। তুলে ধরেছেন উওম‍্যান, লাইফ ফ্রীডম লেখা প্ল‍্যাকার্ড। হিজাব বিরোধী আন্দোলনে নিহত শহীদ মাহেশা আমিনি র সম্মানে এই প্ল‍্যাকার্ড। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন এই লড়াই আরও অনেক দূরে নিয়ে যাবেন ইরানের প্রগতিশীল নারী সমাজ ও আন্তর্জাতিক মানববাধিকার কর্মীরা। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে মাঠেই মুখে হাত দিয়ে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিল গোটা জার্মান দল। কাতার প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে হাতে রামধনু ‘ওয়ান লাভ’ ব্যান্ড পরে মাঠে দাঁড়িয়েই প্রাক ম্যাচ রিপোর্টিং করেন ইংল‍্যাণ্ডের প্রাক্তন জাতীয় ফুটবলার ও সাংবাদিক অ্যালেক্স স্কট।

এখনো এই প্রতিযোগিতার অনেক খেলা বাকি। চ‍্যাম্পিয়ন যে ই হোক,এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল প্রথমবারের মত কোন গণতান্ত্রিক কাঠামোর রাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত না হওয়ার কারণে যে রাজনৈতিক প্রতিবাদের আবহ তৈরি হয়েছে তা সারা পৃথিবীর রাজনীতিতে অবশ্যই বিরাট প্রভাব রেখে যাবে।