রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমগ্র জীবনব্যাপী আন্তর্জাতিকতাবোধ, শান্তিচেতনা ও সৌভ্রাতৃত্বের দর্শন, ধর্ম ও জীবনবোধে ভাস্বর ছিলেন। সারা জীবন ধরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুনিয়ার দেশে দেশে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন কেবলমাত্র অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখা বা ভ্রমণের আনন্দে নয়। তাঁর বিশ্ব পরিক্রমা একদিকে সৌহার্দ্য, শান্তি ও মৈত্রীর দূত হিসেবে ভূমিকা পালনে সহায়ক হয়েছে, অপরদিকে বিভিন্ন  দেশের আর্থসামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক বিষয়বস্তসমূহের ওপর তাঁর অকপট বিশ্লেষণ ও মতামতও প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর বিভিন্ন কবিতা, রচনা ও পত্রাবলীতে। সেই দিক থেকে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর সমসাময়িক রাষ্ট্রনেতা ও রাজনৈতিক নেতাদের থেকে কোনও অংশে কম আয়তনের বলে মনে হয় না। যদিও তিনি স্বয়ং এই তুলনায় কোনোভাবেই আগ্রহী ছিলেন না। বরং এই প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বকবি অভিধা সর্বার্থে সঠিক ও প্রাসঙ্গিক। কবির নিজস্ব অনুভবেও সেই স্বীকৃতির প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় :

         আমি পৃথিবীর কবি

       যেথা তার যত উঠে ধ্বনি

          আমার বাঁশির সুরে

        সাড়া তার জাগিবে তখনই।

                     লেনিন বলেছেন, “সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়”। কারণ পুঁজিবাদ টিকে থাকে মুনাফাকে উপজীব্য করে।তার জন্য তাকে পররাজ্য গ্রাস ও লুন্ঠনের পথে তথা সাম্রাজ্যবাদের পথে যেতে হয়। আর রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন আন্তর্জাতিকতার সবচেয়ে বড়ো বিপদ সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ। তাই তিনি সারা জীবন দৃঢ়তার সাথে তাঁর অজস্র গান, কবিতা, রচনা, সাহিত্যকীর্তি ও বক্তৃতায় ওই দুই বিপদের বিরুদ্ধে প্রচার করেছেন। তিনি কখনো আহ্বান জানান :

“আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া

বুকের মধ্যে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।”

আবার বিলেত যাবার আগে লেখেন :

“বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার

সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো।”

কারণ বিশ্বের সাথে পরিচয় সাধনের জন্যই তাঁর বিলেত যাত্রা। দেশকে বন্দনা করতে গিয়ে বিশ্বের কবি, পৃথিবীর কবি অনুভব করেন স্বদেশের মধ্যে ‘বিশ্বময়ীর, বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।’

         পৃথিবীর যেকোনো দেশে প্রবলের উৎপীড়ন, আর্তের ক্রন্দন তাঁকে বিচলিত করত। তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে সর্বক্ষেত্রেই কলম ধরেছেন—কন্ঠ সোচ্চার করেছেন। রবীন্দ্রনাথই ছিলেন প্রথম ভারতীয় সাহিত্যিক যিনি ফ্যাসিবাদের ভয়ানক আগ্রাসী ও বর্বর রূপ উপলব্ধি করে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর সোচ্চার কন্ঠ ও তীক্ষ্ণ লেখনিকে হাতিয়ার করে। বিশ্ব মানবতার পক্ষে তাঁর দৃঢ় অবস্থান ও সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদের পররাজ্য গ্রাসের ও লুন্ঠনের বর্বর অভিযানের বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র বিষোদগার তাঁকে যথার্থভাবেই পৃথিবীর কবি রূপে উত্তীর্ণ করেছে।

               ১৮৭৮ সালে সদ্য তরুণ রবীন্দ্রনাথ বিলেত রওনা হন ব্যারিস্টার হবার উদ্দেশ্যে। ইংল্যান্ডের ঐশ্বর্য, প্রবল প্রতাপ ও উজ্জ্বল পরিবেশ তাঁকে যতটা প্রভাবিত করে তার থেকে বেশি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তাদের পরদেশ শাসনের কলঙ্ক। তাঁর সেই প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয়েছে ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’গুলিতে : ‘এখানকার অলিতে গলিতে যে জন, জেমস, টমাসগণ   কিলবিল করছে, যাদের মা, বাপ, বোনকে একটা কসাই, দরজি, কয়লা বিক্রেতা ছাড়া আর কেউ  চেনে না, তারা ভারতবর্ষের যে অঞ্চলে পদার্পণ করে সে অঞ্চলে ঘরে ঘরে তাদের নাম রাষ্ট্র হয়ে যায়, যে রাস্তায় তারা চাবুক হস্তে ঘোড়ায় চড়ে যায় (হয়তো সে চাবুক কেবলমাত্র ঘোড়ার জন্যেই ব্যবহার হয় না) সে রাস্তাসুদ্ধ লোক শশব্যস্ত হয়ে তাদের পথ ছেড়ে দেয়। তাদের এক একটা ইঙ্গিতে ভারতবর্ষের এক-একটা রাজার সিংহাসন কেঁপে ওঠে-এরকম অবস্থায় সে ভেকদের পেট উত্তরোত্তর ফুলতে ফুলতে যে হস্তীর আকার ধারণ করবে আমি তো তাতে বিশেষ অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পাইনে।’ অর্থাৎ ইঙ্গ ভারত সম্পর্ক সমমর্যাদাসম্পন্ন না হয়ে একের উপরে অন্যের আধিপত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দরুণ দু তরফেই যে মনুষ্যত্বের বিড়ম্বনা ঘটেছিল তার কোনোটিই তরুণ কবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়ায়নি সেদিন।

             ১৮৮১ সালে ‘চীনে মরণের ব্যবসায়’ প্রবন্ধে চীনদেশে ইংরেজের আফিম ব্যবসার প্রতিবাদে তরুণ রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘একটি সমগ্র জাতিকে অর্থের লোভে বলপূর্বক বিষপান করানো হইল। এমনতর নিদারুণ ঠগীবৃত্তি কখনো শুনা যায় নাই।—অর্থ সঞ্চয়ের এইরূপ উপায়কে ডাকাইতি না বলিয়া যদি বাণিজ্য বলা যায়, তবে সে নিতান্ত ভদ্রতার খাতিরে। ইহা আর কিছু নয়, একটি সবল জাতি দুর্বলতর জাতির নিকটে মরণ বিক্রয় করিয়া কিছু লাভ করিতেছেন।’

          দ্বিতীয়বার ইউরোপ যাত্রা বিষয়ে রচিত ‘য়ুরোপযাত্রীর ডায়েরী’তে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘—অপ্রতিহত ক্ষমতার দম্ভ জাতীয় চরিত্রের মূলে আক্রমণ করে। যে স্বাধীনতাপ্রিয়তার ভিত্তির উপর তোমার জাতীয় গৌরব প্রতিষ্ঠিত, তলে তলে সেই স্বাধীনতাপ্রিয়তার বিশুদ্ধতা নষ্ট করে।’ তিনি ‘য়ুরোপযাত্রীর ডায়েরী’র আর এক জায়গায় লেখেন, ‘সভ্যতা আপনাকে রক্ষা করতে চায় তো প্রতিবেশীকে আপনার সমান করে তুলুক। দুটো  শক্তি যত একসঙ্গে সাম্য রক্ষা করে কাজ করে ততই মঙ্গল-যেমন আকর্ষণ বিকর্ষণ, স্বার্থ এবং পরার্থ, আপনার উন্নতি ও চতুষ্পার্শের উন্নতি-নইলে চতুষ্পার্শ তার প্রতিশোধ তোলে, বর্বরতা সভ্যতাকে ধ্বংস করে।’

            রবীন্দ্রনাথের বিশ্বচেতনা পরিব্যপ্ত গভীর হৃদয়াবেগ, মনুষ্যত্বের অবমাননার বিরোধিতা, রাজনৈতিক বিষয়াবলী তথা শিক্ষা ও সংস্কৃতি চিন্তা প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রে সর্ব আঙিনায়।পুঁজিবাদী সমাজের সমস্যায় বিশেষভাবে ভাবিত রবীন্দ্রনাথ ‘স্ত্রী মজুর’ প্রবন্ধে ১৮৯১ সালে নারী শ্রমিকদের অর্থনৈতিক  ও সামাজিক সমস্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘দেখা যাইতেছে য়ুরোপে আজকাল প্রধান সমস্যা এই, জিনিসপত্র,  না মনুষ্যত্ব, কাহার দাম বেশি’। ‘কর্মের উমেদার’ প্রবন্ধে ওই একই বছরে একই প্রসঙ্গে লিখছেন, ‘লোহার কলের সঙ্গে সঙ্গে রক্ত মাংসের মানুষকে সমান খাটিতে হইতেছে। কেবল বণিক সম্প্রদায় লাভ করিতেছেন এবং ধনী সম্প্রদায় আরামে আছেন ‘। ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত ‘রাজনীতির দ্বিধা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘য়ুরোপীয় জাতি য়ুরোপে যত সভ্য, যত সদয়, যত ন্যায়পর, বাহিরে ততটা নয়—।’ ক্ষমতায় মদমত্ত ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিকে তিনি ধিক্কার জানিয়েছেন এইভাবে।

       গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত  বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়টিও তাঁর বিশ্বচেতনার ফসল। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এটি স্থান বা বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে নামাঙ্কিত  হয়নি। ‘বিশ্বভারতী’ এই শব্দের দ্বারা বিশ্বজনীন ধারণাই মূর্ত হয়ে উঠেছে। তখন ১৯১৪ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছে। জাতীয়তাবাদের উগ্রমূর্তি দেখা দিয়েছে দিকে দিকে। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে সংঘটিত যুদ্ধকে জাতীয়তাবাদের ভাবাবেগে ভাসিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে দেশে দেশে। রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা ও জাপান সফরে এই জাতীয়তা বা ন্যাশনালিজম্-এর উগ্রতার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনামূলক বক্তৃতা দিলেন। ন্যাশনালিজম্ যে বিশ্বশান্তির শেষ কথা নয়, একথা কবি স্পষ্ট করে ব্যক্ত করলেন। তাঁর ‘বিশ্বভারতী’ স্থাপনের চিন্তা এই প্রেক্ষাপটেই।

         ১৯১৬ সালে কবি আমেরিকা সফরকালে শান্তিনিকেতনে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে যে পত্র লেখেন তাতেই বিশ্বভারতী স্থাপনের প্রথম আভাস পাওয়া যায়। এর আগে ছিল শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় ও আশ্রম। কবি লিখলেন, ‘শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে-ওইখানে সার্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে-স্বাজাতিক সংকীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসছে-ভবিষ্যতের জন্য যে বিশ্বজাতিক মহামিলনযজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে তার প্রথম আয়োজন ওই বোলপুরের প্রান্তরে হবে।’

          এই ভাবনার কয়েক বছর পরে আশ্রমের তরুণ শিক্ষক সুহৃদকুমার মুখোপাধ্যায়কে কবি লেখেন, ‘ভারতের একটা জায়গা থেকে ভূগোল বিভাগের মায়াগন্ডি সম্পূর্ণ মুছে যাক-সেইখানে সমস্ত পৃথিবীর পূর্ণ অধিষ্ঠান হোক-সেই জায়গা হোক আমাদের শান্তিনিকেতন।’

            প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল ১১ই নভেম্বর, ১৯১৮ সাল। একমাস পরে ২৩শে ডিসেম্বর, ১৯১৮ শান্তিবাদ ও বিশ্বমৈত্রীর প্রতীক বিশ্বভারতীর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হল। ১৯২৩ সালের ২৩শে ডিসেম্বর কবি বিশ্বভারতীকে সাধারণের হাতে উৎসর্গ করার জন্য সভা আহ্বান করলেন। সেই সভায় তিনি বললেন, ”কোনো জাতি যদি স্বাজাত্যের ঔদ্ধত্যবশত ধর্ম ও সম্প্রদায়কে একান্ত আপন বলে মনে করে তবে সেই সত্য বিনষ্ট হয়ে যাবে।” সবরকম বিভেদের উর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত হল বিশ্বভারতী। বিশ্বভারতী ও বিশ্বমানবতাবাদ সমার্থক। এই কথা কবি স্পষ্ট করে বললেন ‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থে। তিনি বললেন, “ধর্ম একটাই-তা হচ্ছে মানুষের ধর্ম “। গান লিখলেন, ‘ওই মহামানব আসে’। এখানে মহামানব কোনো মহাপুরুষ নয়, সমগ্র মনুষ্যত্বের প্রতীক।

        যদিও এই প্রশ্নের অবতারণা করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে বিশ্বভারতীর বর্তমান পরিচালকমণ্ডলী গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সযত্নলালিত চিন্তাধারা থেকে অনেকটাই সরে যান নাই কি? গৌরবের ক্রমঅধঃপতন, সংকীর্ণ রাজনীতির অপরিসরতা আজকের বিশ্বভারতীকে অনেকখানি কালিমালিপ্ত করে ফেলেছে। কবির নোবেল পদকটিও রক্ষা করার যোগ্যতা তাঁরা দেখাতে পারেন নি।

              প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, বিজেতা-বিজিত দেশের নরনারীর হাহাকার, বিপুল সম্পদহানি ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা কবির মনকে নাড়া দিয়েছিল নানাভাবে, চঞ্চল করেছিল তীব্রভাবে। যার ফসল তাঁর বেশ কিছু কবিতার সৃষ্টি। জার্মানির বিরুদ্ধে বেলজিয়ামের প্রতিরোধ সংগ্রামে বেলজিয়ানদের বীরত্ব তাঁকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। ওই ঘটনা স্মরণে রেখে তিনি লেখেন :

‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই, মরতে হবে

পথ জুড়ে কি করবি বড়াই,সরতে হবে।

লুট করা ধন করে জড়ো

কে হতে চাস সবার বড়ো-

এক নিমেষে পথের ধূলায় পড়তে হবে,

নাড়া দিতে গিয়ে তোমায় নড়তে হবে।

              ১৯৩৫ সালে ফ্যাসিস্ট ইতালি আফ্রিকার সুপ্রাচীন দেশ আবিসিনিয়া (অধুনা ইথিওপিয়া) আক্রমণ করলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মর্মবেদনার কথা প্রথম জানান তাঁর বন্ধু এন্ড্রুজকে লেখা চিঠিতে। পরে তিনি রচনা করেন ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি। ছায়াবৃতা আফ্রিকার প্রতি কবির সহানুভূতি ও হাহাকার শত সহস্র কন্ঠে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে :

        সভ্যতার বর্বর লোভ

নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।

         তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে

           বাষ্পাকুল অরণ্যপথে

               পঙ্কিল হল ধুলি

তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে।

ফ্যাসিস্ট ইতালি ও জার্মানির মদতপুষ্ট জেনারেল ফ্রাঙ্কো ১৯৩৬ সালে স্পেনের গণতন্ত্র ধ্বংস করে স্বৈরশাসন চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করলে সমগ্র স্পেনে তার প্রতিবাদে ও প্রতিরোধে সংগ্রাম শুরু হয়। আমরা জানি স্পেনের যুদ্ধে পপুলার ফ্রন্টের হয়ে রণাঙ্গনে সামিল হয়েছিলেন বিভিন্ন দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতি কর্মীরা। রবীন্দ্রনাথও তাঁর বয়সের ভারকে উপেক্ষা করে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন। স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়ে তিনি পপুলার ফ্রন্টের পক্ষে বিবৃতি দিলেন : “স্পেনের জনগণের কঠিন পরীক্ষা ও যন্ত্রণার সময় আমি মনুষ্যত্বের বিবেকবোধের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি স্পেনের ‘পপুলার ফ্রন্ট’কে সাহায্য করুন,  স্পেনের জনগণের সরকারকে সাহায্য  করুন, লক্ষ কন্ঠে আওয়াজ তুলুন-প্রতিক্রিয়ার শক্তি তফাৎ যাও। গণতন্ত্র রক্ষায়, সভ্যতা ও সংস্কৃতির অগ্রগতি রক্ষায় লাখো লাখো শান্তিকামী মানুষ সামিল হোন।” (বঙ্গানুবাদ)

      ১৯৩৭ সালে লেখা সেঁজুতি কাব্যগ্রন্থে ‘চলতি ছবি’ কবিতায় স্পেনের গৃহযুদ্ধের ছবি ফুটে উঠেছে :

               যুদ্ধ লাগল স্পেনে

চলছে দারুণ ভ্রাতৃহত্যা শতঘ্নীবাণ হেনে।

এই সময়েই ‘লীগ এগেনষ্ট ফ্যাসিজম এন্ড ওয়ার’ নামে একটি সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। মূল উদ্যোক্তা ছিলেন কবির ভ্রাতুষ্পুত্র সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ এই সংঘের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। এই সংঘের অন্য সদস্যরা ছিলেন জওহরলাল নেহরু, জয়প্রকাশ নারায়ণ,  কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়,এস এ ডাঙ্গে, এন জি রঙ্গ প্রমুখ।

           তিনের দশকে জাপানের চীন আক্রমণ ও আগ্রাসনের ঘটনা রবীন্দ্রনাথ মেনে নিতে পারেন নি। এই প্রসঙ্গে তাঁর অনুরাগী জাপানি কবি নোগুচির সঙ্গে খোলা চিঠি আদান প্রদানের মাধ্যমে দীর্ঘ বিতর্ক চলে। জাপান তাঁর ভালোবাসার দেশ হলেও তার রাজ্যলিপ্সাকে তিনি ক্ষমা করতে পারেন নি। তাদের জন্য তাই শুভেচ্ছার বদলে তিনি অভিসম্পাতই বর্ষণ করেছিলেন।

          দুঃখের হলেও সত্যি, আবিসিনিয়া, স্পেন ও চীন রণাঙ্গন-প্রায় সর্বত্রই ফ্যাসিস্টদের  আক্রমণের মুখে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবিরোধী মুক্তিফৌজের পরাজয়ের খবর আসছিল। এই সময় কবি তাঁর অবিস্মরণীয় দুটি কবিতা রচনা করেন :

নাগিনিরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,

শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস

       বিদায় নেবার আগে তাই

              ডাক দিয়ে যাই

দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে

     প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।

       অপর কবিতাটির (‘যেদিন চৈতন্য মোর’) অবিস্মরণীয় কয়েকটি লাইন আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে :

     ——মহাকালসিংহাসনে-

সমাসীন বিচারক, শক্তি দাও, শক্তি দাও মোরে,

কন্ঠে মোর আনো বজ্রবাণী, শিশুঘাতী নারীঘাতী

কুৎসিত বীভৎসা ‘পরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন

নিত্যকাল রবে যা স্পন্দিত লজ্জাতুর ঐতিহ্যের

হৃৎস্পন্দনে, রুদ্ধকন্ঠ ভয়ার্ত এ শৃংখলিত যুগ যবে

নিঃশব্দে প্রচ্ছন্ন হবে আপন চিন্তার ভস্মতলে।

           জাপানের একদল সৈনিক চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আগে ভগবান বুদ্ধের মূর্তির সামনে যুদ্ধের জয় কামনা করছে এই মর্মে সংবাদপত্রে একটি সংবাদ দেখে কবি খুবই ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত  হয়ে পড়েন। শান্তির দূত বুদ্ধের সামনে অন্যায় যুদ্ধের সাফল্য কামনার ভণ্ডামিকে তীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে আক্রমণ করে ওই সময়েই কবি লেখেন ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ শীর্ষক বিখ্যাত কবিতাটি।

           ১৯৩৮ সালের মে মাসে কবির জন্মদিনে ফ্যাসিস্টদের বিশ্বগ্রাসী বীভৎস পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও ধিক্কার জানিয়ে ‘জন্মদিন’ শীর্ষক বিখ্যাত কবিতাটি কবি রচনা করেন :

               ক্ষুব্ধ যারা, লুব্ধ যারা,

মাংসগন্ধে মুগ্ধ যারা, একান্ত আত্মার দৃষ্টিহারা

শ্মশানে প্রান্তচর, আবর্জনাকুণ্ড তব ঘেরি

বীভৎস চিৎকারে তারা রাত্রিদিন করে ফেরাফেরি,

        নির্লজ্জ হিংসায় করে হানাহানি।

                      শুনি তাই আজি

মানুষ-জন্তুর হুহুঙ্কার দিকে দিকে উঠে বাজি।

           ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মানির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ‘মিউনিখ চুক্তি’। আসলে এই চুক্তি  ছিল হিটলারের সব দাবি মেনে নিয়ে তাকে তুষ্ট করার এক নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতার চুক্তি এবং সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়াকে একঘরে করে কেন্দ্রীভূত ফ্যাসিস্ট আক্রমণে যাতে সে ধ্বংস হয়ে যায় তার ব্লুপ্রিন্ট। এই চুক্তির  পরিণামে চেকোশ্লাভিয়া পুরোপুরি ফ্যাসিস্টদের কবলে চলে যায় এবং ফ্যাসিস্ট আক্রমণ পূর্বমুখী অর্থাৎ সোভিয়েতমুখী গতি লাভ করে। ষড়যন্ত্রের শিকার সোভিয়েত রাশিয়াকে কৌশলগত কারণে ফ্যাসিস্ট আক্রমণ সাময়িক ঠেকিয়ে রাখতে ও চূড়ান্ত আক্রমণের আগে নিজেদের গুছিয়ে নিতে জার্মানির সঙ্গে ১৯৩৯ সালে অনাক্রমণ চুক্তি ও সন্ধি সম্পাদন করতে হয়। যদিও দুই বছর পরে ১৯৪১ সালের ২২শে জুন ফ্যাসিস্ট জার্মানি সোভিয়েতকে আক্রমণ করে এবং সাম্রাজ্যবাদী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জনযুদ্ধে পরিবর্তিত হয়ে যায়। অর্থাৎ মিউনিখ অর্ঘ্য দিয়েও নাৎসি হিটলারের জঠরানলকে প্রশমিত করা যায়নি। কারণ সোভিয়েত আক্রমণের আগে ক্রমান্বয়ে পোল্যান্ড, ফ্রান্স,আলবেনিয়া ফ্যাসিস্ট কবলে চলে যায়। মিউনিখ বিশ্বাসঘাতকতায় কবি এতটাই বিচলিত ও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন অন্য কোনো ঘটনায় আগে হননি।

           বন্ধু অমিয় চক্রবর্তীর উদ্দেশ্যে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘দেখলুম দ্বারে বসে ব্যথিত চিত্তে, মহাসাম্রাজ্যশক্তির রাষ্ট্রমন্ত্রীরা নিষ্ক্রিয় ঔদাসীন্যের সঙ্গে দেখতে লাগল জাপানের করাল দ্রংষ্ট্রাপংক্তির দ্বারা চীনকে খাবলে খাওয়া।—দেখলুম ওই স্পর্ধিত সাম্রাজ্যশক্তি নির্বিকার চিত্তে আবিসিনিয়াকে ইটালীর হাঁ- করা মুখের গহ্বরে তলিয়ে যেতে দেখল, মৈত্রীর নামে সাহায্য করল জার্মানির বুটের তলায় গুঁড়িয়ে ফেলতে চেকোশ্লোভাকিয়াকে, দেখলুম নন-ইন্টারভেনশনের কুটিল প্রণালীতে স্পেনের রিপাবলিককে দেউলে করে দিতে, দেখলুম ম্যুনিক প্যাক্টে নতশিরে হিটলারের কাছে একটা অর্থহীন সই সংগ্রহ করে অপরিমিত আনন্দ  প্রকাশ করতে।—এই যুদ্ধে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স জয়ী হোক একান্তমনে এই কামনা করি। কেননা মানব ইতিহাসে ফ্যাসিজমের নাৎসিজমের কলংকপ্রলেপ আর সহ্য হয়না।’

          বিশ্বপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েত রাশিয়া কর্তৃক ফিনল্যান্ড আক্রমণের ঘটনাটিকেও ভালো চোখে দেখেন নি। এই ঘটনায় তাঁর মনোবেদনা প্রকাশ পায় ‘অপঘাত’ কবিতায় :

       টেলিগ্রাম এল সেই ক্ষণে

            ফিনল্যান্ড চূর্ণ হল

        সোভিয়েত বোমার বর্ষণে।

       এইক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে, কবি সোভিয়েত রাশিয়াকে সম্পূর্ণ অন্য চোখে দেখতেন। ১৯৩০ সালে রাশিয়া ভ্রমণ ছিল তাঁর কাছে ‘এ জন্মের তীর্থ দর্শন’। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন,  ‘অন্য কোনো দেশের মতোই নয়, একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলেছে।’ আন্তর্জাতিকতা বোধকে রবীন্দ্রনাথ চিরকালই উগ্র স্বাজাত্যবোধের উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত আন্তর্জাতিকতার স্বরূপ সন্ধান  বোধহয় পেয়েছিলেন রুশ বিপ্লবের মধ্যেই। তিনি লিখেছেন, ‘একদিন ফরাসি বিদ্রোহ ঘটেছিল এই অসাম্যের তাড়নায়। সেদিন সেখানকার পীড়িতেরা বুঝেছিল এই অসাম্যের অপমান ও দুঃখ বিশ্বব্যাপী। তাই সেদিনকার বিপ্লবে সাম্য, সৌভ্রাত্র ও স্বাতন্ত্র্যের বাণী স্বদেশের গণ্ডি পেরিয়ে উঠে ধ্বনিত হয়েছিল। কিন্তু টিকল না। এদের এখানকার বিপ্লবের বাণীও বিশ্বব্যাপী। আজ পৃথিবীতে অন্তত এই একটা দেশের লোক স্বাজাতিক স্বার্থের উপরেও সমস্ত মানুষের কথা চিন্তা করছে।’ এহেন সোভিয়েত রাশিয়ার আগ্রাসী ভূমিকা তিনি সমর্থন করেন নি।

          এখন প্রশ্ন হল সোভিয়েত ফিনল্যান্ড আক্রমণ করল কেন? ফিনল্যান্ড ছিল নাৎসি জার্মানির পক্ষে। নাৎসি জার্মানির  সঙ্গে যৌথভাবে তারা ম্যানারহাইম দুর্গশ্রেণি গড়ে তুলেছিল এবং সোভিয়েতের লেনিনগ্রাদ থেকে মাত্র ২১ মাইল দূরে দুর্গের অংশে অনেক ভারী কামান সাজানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। এছাড়াও ফিনল্যান্ড ব্রিটেন কর্তৃক প্রচুর অস্ত্রসম্ভারেও সজ্জিত ছিল। তাই বিশ্ববাসী, সোভিয়েতের মানুষ ও বিশ্বব্যাপী প্রকৃত শান্তি ও গণতন্ত্রের স্বার্থে নাৎসি বাহিনীকে সোভিয়েত সীমান্ত থেকে অনেকটা দূরেই প্রতিহত করার স্বার্থেই সোভিয়েত রাশিয়াকে ফিনল্যান্ড আক্রমণ করতে হয়।

          কবির পক্ষে এতটা জানা সম্ভব ছিল না। কিন্তু তাঁর সমগ্র জীবনব্যাপী রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বারবার উত্তরণের পথে পাল্টেছিলেন বলেই তাঁর শুভাকাঙ্খীদের কাছে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হয়ে পরবর্তী সময়ে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সোভিয়েত জয়যুক্ত হবেই  এই প্রত্যয়ে বলীয়ান থেকেছেন এবং অন্য সকলকেও সেই আশাবাদে উজ্জীবিত করেছেন। একইভাবে প্রথমদিকে ইতালির শাসক মুসোলিনী সম্পর্কেও তিনি মোহগ্রস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু অচিরেই সেই মোহগ্রস্ততা কাটিয়ে প্রকৃত সত্য অনুধাবনে তাঁর মতো সত্যদ্রষ্টা কবির অসুবিধা হয়নি। ১৯২৭ সালে বিখ্যাত ফরাসি মনীষী ও সাম্যবাদী নেতা অঁরি বাঁরবুস ও ফরাসি দার্শনিক  রোঁমা রোঁলার  মধ্যে মত বিনিময়ের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীগুনীদের কাছে ‘স্বাধীন আত্মাদের প্রতি’ শীর্ষক আবেদনপত্র পাঠান, তাঁদের অনুমোদনের জন্য। যার মূল সুর ছিল ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার। ওই আবেদনের সমর্থন জানিয়ে লেখা জবাবে দ্বিধাহীনভাবে ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা প্রকাশ হওয়া ছাড়াও প্রকট হয়ে উঠেছিল ফ্যাসিবাদের অন্তর্নিহিত জরাগ্রস্ত অবস্থা সম্পর্কে কবির দৃঢ় প্রত্যয়।

 হিটলার-মুসোলিনীর মতো দানবদের ছবি আঁকেন কবি এই ভাষায় :

রক্তমাখা অস্ত্রহাতে যত রক্ত আঁখি

শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি।

         ফ্যাসিস্ট আক্রমণে ফ্রান্সের পতনের সংবাদে রবীন্দ্রনাথ এতটাই  উত্তেজিত ও বিচলিত  হয়ে পড়েন যে, মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জরুরী তারবার্তা পাঠিয়ে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করতে আহ্বান জানান। এ যেন সারা বিশ্ববাসীর প্রতিনিধি হিসেবে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলা ও যুদ্ধে আমেরিকাকে অবতীর্ণ হবার অনুরোধ। যদিও ইতিহাস অন্য পথে চলেছিল। ফ্যাসিস্টদের প্রতিরোধে দুই কোটি মানুষের জীবন আহূতির মাধ্যমে বীরত্বপূর্ণ  ভূমিকা পালন করেছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া।

         ফ্যাসিস্ট জার্মানির সঙ্গে সোভিয়েতের মরণপণ সংগ্রামের খবর রোগশয্যায় শায়িত কবি খুবই আগ্রহের সঙ্গে রাখতেন। ‘বাইশে শ্রাবণ’ গ্রন্থে রানী মহলানবিশের বর্ণনা থেকে জানা যায়, সংবাদপত্রে যেদিন জার্মানদের অগ্রগতিতে একটু ভাটার খবর থাকত সেদিন কবি মুখের কাছে কাগজখানা ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। আর যেদিন জার্মান সৈন্যর সাফল্যের খবর থাকত সেদিন হেডলাইন পড়া শেষ হলেই কাগজখানা ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দিতেন। যেদিন কবির দেহে অপারেশন হয়, সেই কালান্তক অপারেশনের দিনে, ৩০শে জুলাই ১৯৪১ সাল, সোভিয়েত বাহিনী হিটলারের বাহিনীকে প্রতিহত করতে শুরু করেছে। অপারেশন থিয়েটারে যাবার ঠিক আগে রোগগ্রস্ত কবি খুব খুশি হয়ে বললেন, “পারবে পারবে, ওরাই পারবে। ভারি অহংকার হয়েছে হিটলারের! গোয়েরিং গোয়েরিং, এখন দেখুক গোয়েরিং কি হয়। দুশমনরা।

            আর একটি বিবরণে মৈত্রেয়ী দেবী বলছেন, “মনে পড়ে  প্রত্যেকদিন রেডিওতে যুদ্ধের খবর শুনে, খবরের কাগজ হাতে নিয়ে মানুষের এই হিংস্রতায় এই কলঙ্কে কি বেদনা পেতেন। আমাদের কাছে দূর দেশের যুদ্ধ অনেকটা পরিমাণেই যুদ্ধের গল্প ছিল। কিন্তু সকল দেশ সকল মানুষ যাঁর আপন, তাঁর কাছে আর্ত মানুষের দুঃখ প্রতিদিন অত্যন্ত প্রত্যক্ষ হয়ে পৌঁছত। এত কষ্ট পেতেন যে ইচ্ছে করত না তাঁকে খবর শোনাই। কিন্তু উপায় ছিল না।”

      তাই গভীর  বেদনা নিয়েই কবি লিখেছিলেন, ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’, আহ্বান করেছিলেন  অনন্ত পুণ্যের আবির্ভাব। আবার বেদনাপূর্ণ হৃদয়েই বিদ্রুপ করে লিখেছিলেন:

   ঐ শোনা যায় রেডিওতে

   বোঁচা গোঁফের হুমকি,

   দেশ বিদেশে শহর গ্রামে

    গলাকাটার ধুম কি!

   গোঁ গোঁ করে রেডিওটা

    কে জানে কার জিত,

    মেশিনগানে গুঁড়িয়ে দিল

      সভ্য বিধির ভিত।

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা ও দেশের পরাধীনতার গ্লানি বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব মানবতাবাদের এই কবি তাঁর শেষ রচনা ‘সভ্যতার সংকট’-এ উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে।’

         ক্রান্তদর্শী কবির ভবিষ্যদ্বাণী বিফলে যায়নি। ফ্যাসিবাদী শক্তির  পরাজয় ঘটেছে।পৃথিবীর দেশে দেশে পরাধীনতার শৃংখল মোচনের সংগ্রাম জয়যুক্ত হয়েছে। পুঁজিবাদী শোষণের শৃংখল মোচনের বিপ্লবী সংগ্রামেও সফল হয়েছে বেশ কিছু দেশ ।